somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল)
নিজেকে বোঝার আগেই মনের মধ্যে একটা চেতনা তাড়া করে ফিরতো। এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে বদলাতে হবে, একটা বিপ্লব দরকার। কিন্তু কিভাবে?বিপ্লবের হাতিয়ার কি? অনেক ভেবেছি। একদিন মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে উঠলো একটি শব্দ, বিপ্লবের হাতিয়ার 'কলম'।

বরফে ঢাকা আল্পস ভ্রমণের দিনগুলো (পর্ব-১)

০১ লা জুন, ২০২২ রাত ২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভ্রমণ ফরাসি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দীর্ঘদিন এই সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করে আমরাও কিছু কিছু বিষয়ে ফরাসিদের মত অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।ব্যক্তিগত ভাবে আমি ভ্রমণ করতে পছন্দ করি, সেই সাথে আমার স্ত্রী সুমি তারও নতুন জায়গা ঘুরে দেখা অন্যতম পছন্দের বিষয়।যার কারণে প্রতি বছর গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা পরিবারের তিনজন মিলে কয়েক দিনের জন্য দূরে কোথাও চলে যাই। নতুন স্থানের রঙ রস উপভোগ করে নতুন উদ্দাম নিয়ে ফিরে আসি আপন গৃহে।এটা এখন আমাদের জীবনের বাৎসরিক রুটিনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।সর্বশেষ ২০১৯ সালে আমরা চার দিনের জন্য গিয়েছিলাম ফ্রান্সের সমুদ্রবর্তী অঞ্চল পেই দো লা লোয়ার রেজিওতে।ঐ বছরের শেষের দিকে চীনের উহান শহরে নেমে আসে কোভিড নামক অদৃশ্য দৈত্যের কালো ছায়া।কিছু দিনের মধ্যে সেই ছায়া গ্রাস করে ফেলে সমস্ত পৃথিবীকে।স্থবির হয়ে পড়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন। কোভিডকে প্রতিহত করার কৌশল হিসেবে মানুষকে বেঁধে ফেলা হয় নানা নিয়ম কানুনের বেড়াজালে।সম্মুখ যুদ্ধের মতই প্রায় দুই বছর ধরে চলে এই প্রতিরোধ লড়াই।বেঁচে থাকার সংগ্রামে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যে মানুষ ত্যাগ স্বীকার করেছে শখের অনেক কিছু। ভ্রমণ করা, সিনেমা হল ও থিয়েটারে যাওয়া,রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি।নিয়মের বাধ্যবাধকতার কারণে আমরাও প্যারিস থেকে দূরে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করতে পারছিলাম না।২০২১ এর শেষের দিকে ফ্রান্সের অধিকাংশ মানুষ ভ্যাক্সিনের আওতায় আসায় অনেক নিয়ম কানুন শর্ত সাপেক্ষে শিথিল হতে থাকে। ভ্যাক্সিন নেওয়ার সনদ প্রদর্শন সাপেক্ষে সরকার জনগণকে দূরবর্তী এক শহর থেকে অন্য শহর, ইউরোপের এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার অনুমোদন দেয়।এরপর থেকে মানুষ দীর্ঘদিনের শৃঙ্খলিত জীবন যাপন থেকে নিজদের মুক্ত করতে ছুটতে শুরু করে।বছরের শেষের দিক ভ্রমণের মৌসুম না হলেও এই শীতের তীব্রতার মধ্যেই অনেকে অবকাশ যাপনের জন্য সময় বের করে নেয়।

আমি জুনের দিকে বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসলেও এই দুর্যোগকালীন দুই বছরে মিশেল ও সুমির যাওয়া হয়নি কোথাও। তাই ওদেরকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসার ভীষণ তাগিদ অনুভব করছিলাম,সেই সাথে সুমির পক্ষ থেকেও জোর দাবী উঠছিল কিছুদিন কোথাও গিয়ে থাকার।যেহেতু শীতের সময় তাই যেতে হবে কোন শহরে অথবা পাহাড়ে স্কি করতে।সেই লক্ষ্যে অক্টোবর মাস জুড়ে আমাদের ভ্রমণ বাজেট অনুযায়ী আলোচনা চলল পাহাড় না শহর হবে আমাদের শীতকালীন ভ্রমণের স্থান। পাহাড়ে ঘোরাঘুরিতে খরচ বেশী, শহরে ভ্রমণ খরচ তুলনামুলকভাবে কম। ইচ্ছে ও বাজেটের মধ্যে সমন্বয় করা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।আমার দীর্ঘদিনের শখ পাহাড়ের ছবি তোলার আর সুমির ইচ্ছে স্কি করার।ভ্রমণ খরচ বাজেটের বাইরে চলে গেলেও কিছুটা সাহস করে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আল্পসের চূড়ায় উঠার।

ছোট বেলায় ভূগোল বই পড়তে গিয়ে জেনেছি আল্পস পর্বতের কথা ।পৃথিবীর অন্যতম এই পর্বতটি স্বচক্ষে দেখবো তা ঐ সময় কল্পনা করিনি।নম্বর তোলার লক্ষ্যে পরীক্ষার উত্তর পত্রে আল্পস সম্পর্কে মুখস্ত লিখেই সন্তুষ্টির ঢেঁকুর গিলেছি।কিন্তু, আমার জীবন জীবিকা এক সময় আল্পস পর্বতের দেশ ফ্রান্সে হবে সে কথাও তখন কল্পনা করিনি।কিন্তু আজ এটাই বাস্তব। অথচ,ফ্রান্সে বসবাসের এগারো বছরের জীবনে আল্পসের বুকে পা রাখা শুধুই অপেক্ষা হয়ে থেকেছে।

পর্বত এবং বনভূমি আমার প্রিয় স্থান।যাত্রা পথে বাসে জানালা দিয়ে পর্বত চূড়া দেখেছি অনেকবার,কিন্তু পর্বত চূড়ায় উঠে ভূমি দেখার আক্ষেপের ইতি টানতে পারছিলাম না।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভ্রমণের দিন নির্ধারণ হল ২০ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী অনলাইনে ট্রেনের টিকেট বুকিং করা হল এবং বাসস্থানের জন্য এয়ারবিএনবি’র(airbnb)মাধ্যমে বাসাও ভাড়া করে ফেললাম। প্যারিসের শীতের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সাধারণত -২ থেকে -৩° ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে নামে না। তাও হঠাৎ কয়েক দিনের জন্য এমনটি ঘটে। কিন্তু আল্পস পর্বত এলাকায় শীতের মৌসুমে তাপমাত্রা সব সময় -১০° ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে অবস্থান করে। ফলে সমস্ত অঞ্চল বরফের আবরণে ঢাকা থাকে।তাই, প্যারিসের ঠাণ্ডার পোশাক আর আল্পস অঞ্চলের ঠাণ্ডার পোশাকের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। একদিন সময় করে আমরা তিনজন ফ্রান্সের একটি নামকরা খেলাখুলার দোকানে গিয়ে আল্পস পর্বত অঞ্চলের বরফের মধ্যে চলাফেরা করার জুতা,জ্যাকেট,টুপি, ইনার সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার কাজও সেরে ফেললাম।

আমাদের পরিবারে মূলত চারজন সদস্য।একজনের নাম ফেলিক্স।আমাদের অতি আদরের বিড়াল।আমাদের আল্পসে যাওয়ার আগে ওকে কোথাও রাখা নিয়ে একটা ছোট সমস্যা তৈরি হল। অবশেষে আমাদের পরিচিত এক বন্ধুর মাধ্যমে পেরু থেকে পড়তে আসা এক ছাত্রীর বাসায় পঞ্চাশ ইউরো প্রদানদের শর্তে ফেলিক্সকে পাঁচদিনের জন্য রাখার ব্যবস্থাও হল।

আমাদের ভ্রমণ পূর্ব প্রস্তুতি বেশ ভালো ভাবে সম্পন্ন হল।

২০ ডিসেম্বর ভোর ৬:৪৭ মিনেতে আমরা প্যারিসের গার দো লিয় (Gare de lion) থেকে ট্রেনে আমাদের গন্তব্য ছা জারভে লে বাঁ’র St-Gervais-les-Bains উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয়। ১০:৩০ মিনিটে আমরা আনছি Annecy স্টেশনে পৌঁছাই।এখানে পঁয়ত্রিশ মিনিটের বিরতির পর আমাদেরকে আরেকটি ট্রেনে উঠতে হয়। আনছি থেকে যাত্রা শুরুর পর কয়েক স্টেশন পাড়ি দিতেই আমরা বুঝতে পারি নতুন ভূপ্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করেছি।মেঘাচ্ছন্ন আকাশ,হিম শীতের আভা প্রকৃতে বিরাজমান। ভূমির উপর বরফের স্তর পড়ে সাদা হয়ে আছে চারিধার, স্থানীয় বাড়ির উঠান বা বারান্দায় কোন মানুষের আনাগোনা নেই।শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রেনের ভেতর থেকেই অনুভব করলাম বাইরের ঠাণ্ডার তীব্রতা কেমন হবে।উঁচু নিচু পাহাড়ি এলাকার কোথাও ঘন বনভূমিতে তুষার পড়ে থোকা থোকা সাদা ফুলের মত হয়ে আছে। গহীন পাহাড়ি বনের মধ্য দিয়ে কোথাও নালার মত বয়ে গেছে ,তার মধ্যে শান্ত স্রোতের ধারা। যাত্রা পথেই অনুমান করতে পারছিলাম সামনের চার দিন আমাদের কেমন প্রকৃতির মধ্যে কাটাতে হবে।

প্রায় চল্লিশ মিনিটের যাত্রা শেষ করে আমাদের ট্রেন এসে থামল লা রোশ সু ফোরো La Roche sur Foron স্টেশনে।প্লাটফর্মের উপর নেমেই মনে হল আমরা অদ্ভুত প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করছি।কুয়াশা ও মেঘ প্রকৃতিকে এমন ভাবে ঢেকে রেখেছে যে দূরে তাকালে সাদা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। সূর্য মাঝে মাঝে মেঘ ভেদ করে উঁকি দেবার চেষ্টা করছে।হঠাৎ উপরের দিকে তাকাতেই চোখে ধরা দিলো অসম্ভব সুন্দর এক দৃশ্য,কুয়াশা ঢাকা অস্পষ্ট প্রকৃতির মাঝে পাহাড়ের চূড়ার একটি অংশ রূপার মত চিকচিক করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃশ্যটি আবার আড়াল হয়ে গেলো। মনে হল, পাহাড় চূড়াটি এক মুহূর্তের জন্য মেঘ সরিয়ে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে গেলো।আমি ভেতরে দারুণ পুলক অনুভব করছিলাম, কারণ এমন দৃশ্য এত কাছ থেকে আমার জীবনে এই প্রথম দেখা।

এখান থেকে আবার ট্রেন বদল করে আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বিরতিহীন যাত্রায় আমরা চলে এলাম আমাদের গন্তব্য ছা জারভে লে বাঁ লো ফায়ে St-Gervais-les-Bains-le-Fayet ট্রেন স্টেশনে।স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাসা খুঁজে বের করতে গুগোল মাপের শরণাপন্ন হলাম। গুগোল ম্যাপের নির্দেশনা অনুযায়ী স্টেশন থেকে আমাদের বাসার ঠিকানা পাঁচ মিনিটের দূরত্বে।জনমানবের কোলাহলমুক্ত নীরব নিস্তব্ধ এলাকা।রাস্তা ছাড়া চারপাশে শুধুই সাদা বরফের স্তর।কেউ কেউ স্কি করার সরঞ্জাম হাতে ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তার দুইপাশের দোকানপাটগুলো বন্ধ।গুগল মাপকে অনুসরণ করে বাসার দিকে যাওয়ার পথে দেখছিলাম কোন রেস্তোরাঁ খোলা আছে কিনা।কারণ, বাসায় পৌঁছে আমাদের প্রথম কাজ দুপরের খাওয়ার ব্যবস্থা করা। একটা পিজার দোকানের দেখা মিলল কিন্তু প্রবেশ দরজা বন্ধ।

গুগল তার দায়িত্ব শেষ করে গন্তব্যে পৌঁছে দিলেও আমাদের বাসার নম্বর খুঁজে পেতে পড়তে হল নতুন বিড়ম্বনায়।গুগল আমাদেরকে যে বিল্ডিঙয়ের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে তা আমাদের বাসা নম্বরের সঙ্গে মিলছে না।এতো দূরের পথ পারি দিয়ে গন্তব্যের কাছে এসেও গন্তব্য খুঁজে না পেয়ে মনটা অস্থিরতায় ভরে উঠলো।পাশের বিল্ডিং থেকে এক লোককে বাইরে আসতে দেখে আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম সাহায্য চাওয়ার জন্য।মনে হল, স্থানীয় হলে তার কাছে এই সমস্যার সমাধান মিলবে।লোকটিকে সমস্যা খুলে বলার পর সে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে সমাধানের চেষ্টা করলো,কিন্তু ফলাফল শূন্য।পাশাপাশি একই নক্সার কয়েকটি দালানবাড়ি।প্রতিটি দালান বাড়ীর হোল্ডিং নম্বর আমাদের বাসার হোল্ডিং নম্বরের কাছাকাছি, শুধু আমাদেরটা বাসার নম্বরের দেখা মিলছে না।উপায় না পেয়ে বাসার মালিকের নম্বরে ফোন দিলাম কিন্তু ভদ্রলোককে ফোনে পাওয়া গেলো না। হঠাৎ আমাদের সামনে একটি কার এসে থামল। মটরকার থেকে বেরিয়ে আসা মহিলাকে আমাদের বাসা নম্বর জিজ্ঞেস করতেই সে নম্বর দেখিয়ে বলল আপনারা আপনাদের বাসার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।লম্বা একটি দালানের দুই অংশের দুইটি হোল্ডিং নম্বর। অন্য অংশের হোল্ডিং নম্বর আমাদের চোখে পড়লেও আমাদেরটি চোখে না পড়ার কারণ হল, নম্বরটি বিল্ডিঙয়ে প্রবেশ পথের দেয়ালের সামনে না টাঙ্গিয়ে প্রবেশ দরজার পাশে এক কোনায় ছোট করে টাঙানো হয়েছে।নতুন যে কারো অতি সহজে নম্বরটি চোখে পরবেনা। মহিলাটি বলল, সেও আমাদের মত শীতকালীন অবকাশ যাপনের জন্য এখানে এসেছে এবং আমাদের একই বিল্ডিঙয়ে তার ক্ষণিকের ভাড়া এপার্টমেন্ট। সে বলল, নিজেও প্রথম দিন এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। আমরা ভদ্রমহিলাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে আমাদের এপার্টমেন্টে চলে এলাম।

বাসাটি আশ্চর্য রকমের ছোট।এয়ারবিএনবি’র বিজ্ঞাপনের ছবিতে যেমন দেখেছি ভেতরটা তার চেয়ে সুন্দর এবং সাজানো গোছানো। একটি পনের স্কয়ার ফিট জায়গার মধ্যে যে দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করে এই স্টুডিয়ো বাসাটি সাজানো হয়েছ তাতে আভ্যন্তরীণ নকশা প্রণয়নকারী প্রকৌশলীর কাজের মুনশিয়ানার প্রশংসা না করলেই নয়।এই ছোট্টও জায়গার মধ্যে প্রয়োজনীয় কোন কিছুর একটু কমতি নেই।কামরার এককোণে টয়লেট ও বাথরুম, দুটো চকি আকৃতির বিছানা দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করানো রয়েছে,এককোণে ছোট্ট রান্নার স্থান,পাশেই দেয়ালের সঙ্গে চিকন বেঞ্চের মত একটি তক্তা বসানো হয়েছে ডাইনিং টেবিল হিসেবে ব্যবহারের জন্য, সঙ্গে তিনটে লম্বা টুল রাখা হয়েছে যাতে বসে খাওয়ার যায়।চারপাশের দেয়ালের সঙ্গে পরিকল্পিত ভাবে কেবিনেট বসানো,ফাঁকে ফাঁকে পেইন্টিংয়ের ক্যানভাস ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।প্রতিটি কেবিনেটের মধ্যে প্রয়োজনীয় হাঁড়িপাতিল,থালা বাসন,তৈজসপত্র থরে থরে সাজিয়ে রাখা।বইয়ের তাকে সাজানো সারিসারি বই,বাচ্চাদের খেলার নানা উপকরণ। দেয়ালের সাথেই কেবিনেট আকৃতির কাপড়চোপড় রাখার আলমারি।
রেফ্রিজারেটর ও কিচেন কেবিনেটের মধ্যে কিছু চাল,স্প্যাগেটি,রান্নার মসলা,মদের বোতল সহ অনন্যা খাদ্য উপকরণ রাখা হয়েছে যাতে কোন পর্যটক এসে প্রাথমিক অবস্থায় খাবার সমস্যায় না পড়ে।

ঘুমানোর প্রয়োজন হলে আরাম কেদারাগুলো এককোনায় সরিয়ে রেখে দেয়ালে দাঁড় করানো ম্যাট্রেস লাগানো চকি নামিয়ে নিলেই বিছানা হয়ে যায়।দেয়ালের সঙ্গে চকি এমন ভাবে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে যে স্পেস তৈরি করার প্রয়োজন হলে চকি বিছানার একপাশে ধরে দাঁড় করিয়ে ধাক্কা দিলেই দেয়ালের সঙ্গে এমন ভাবে আটকে যায় যে কারো মাথার উপর পড়ে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই।বলা যাই, এই ছোট্ট জায়গাটির মধ্যে দেয়াল থেকে বিছানা নামালে বেডরুম হয়ে যায়,আবার তুলে রাখলে ড্রয়িংরুম হয়ে যায়। আবার একই রুম কিচেন ও ডাইনিং রুম হিসেবে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করা যাচ্ছে। ছোট্ট জায়গার এমন বৈচিত্র্যময় ব্যবহার অবাক করা মত।রাস্তার দিকের কাঁচের দেয়ালের ওপারে ছোট্ট একটি বারান্দাও রয়েছে। বারান্দায় ছোট্ট একটি বেঞ্চ আর টেবিল পাতা। টেবিলে উপর কয়েকটি বড় বড় মোমবাতি রাখা হয়েছে হয়তো পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মোমবাতির আলোয় বসে কফির চায়ের পেয়ালায় চুমুক অথবা ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করার জন্য।
এমন একটি বিচিত্র ও নতুনত্বে ভরা একটি এপার্টমেন্ট পেয়ে আমরা বেশ রোমাঞ্চিত হলাম।বুদ্ধি প্রয়োগ করলে ছোট্ট জায়গাকেও পরিপূর্ণ ভাবে ব্যাবহার করা যায় তার একটি বাস্তব নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন হল এখান এসে।

ভোরবেলা থেকে যাত্রার ধকল ও বাসা খুঁজে বের করতে যে হয়রানি হতে হয়েছে তাতে সবারই ক্ষুধার উদ্রেক আরও তুঙ্গে গিয়ে পৌঁছেছে। সুমিকে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র ব্যাগ থেকে বের করে গুছিয়ে রাখতে বলে দুপুরের খাবার কিনতে আমি বাইরে চলে গেলাম। প্রথমেই চিন্তা হল ট্রেন স্টেশনের পাশে অবশ্যই কোন পিজা বা স্যান্ডউইচের রেস্তোরাঁ খুঁজে পাবো তাই প্রথমে ওদিকে গেলাম।স্টেশনের আশেপাশে যে কয়েকটি পিজার রেস্তোরাঁ পেলাম তার সবকটি বন্ধ,দরজায় নোটিশ টাঙিয়ে লিখে রাখা হয়েছে সন্ধ্যা ছয়টার পর খোলা হবে। একজন স্থানীয় পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম, আশেপাশে কোথাও কাবাব বা পিঁজার রেস্তোরাঁ খোলা আছে কি? লোকটি একটি রাস্তা দেখিয়ে বলল, এই রাস্তা ধরে দশ মিনিট হাঁটলে একটি তুর্কি কাবাবের রেস্তোরাঁ খোলা পেতে পারেন। লোকটির নির্দেশনা মোতাবেক হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার দুই পাশে বেশ কটি রেস্তোরাঁ পেলাম।রেস্তোরাঁগুলোর বাইরের কাঁচের দেয়ালে বাহারি খাবারের ছবি ও মূল্য তালিকা লাগানো রয়েছে কিন্তু প্রবেশ দরজায় তালা ঝোলা। কাঁচের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকিয়ে মনে হল রেস্তোরাঁগুলো অনেকদিন ধরে বন্ধ রয়েছে।

দীর্ঘদিনের তুষার জমা ফুটপাত মানুষের পদচারণায় কঠিন বরফের স্তরে রূপান্তরিত হয়ে আছে।আমার পায়ে তুষারের উপর হাঁটার বিশেষ জুতা পরা থাকলেও দুবার পা পিছলে পড়ে গেলাম।এরপর আরও সাবধানতার সঙ্গে পা টিপে টিপে ফুটপাত ধরে অনেক দূর এগিয়ে গেলাম কিন্তু কোন লাভ হল না।রাস্তায় কোন মানুষজনও নেই জিজ্ঞেস করার। হঠাৎ আমার পাশে একটি গাড়ি এসে থামল,গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে এক যুবক জিজ্ঞেস করলো, মসীয় আশেপাশে কোথায় সুপার মার্কেট আছে কি বলতে পারেন। আমি দুঃখ প্রকাশ করে বললাম, আমি এখানে নতুন, কোন কিছুই চিনি না। ছেলেটি ধন্যবাদ জ্ঞাপন চলে গেলো। মনে হল, লোকটিও হয়তো নতুন এলাকায় আমার মত একই সমস্যায় পড়েছে।হতাশ হয়ে সুমিকে ফোন দিকে বললাম কোথাও কোন খোলা রেস্তোরাঁ পাইনি, আমি আর একটু খুঁজে দেখা চেষ্টা করছি।আরও কিছু দূর এগিয়ে মনে হলো ,পিচ্ছিল রাস্তায় এলোমেলো হেঁটে রাস্তা বাড়ানো ছাড়া কোন লাভ হবেনা।এবার রাস্তার অপর পাশের ফুটপাত ধরে বাসার দিকে এগুতে লাগলাম।একটি বড় বিল্ডিঙয়ের এককোণে একটি রেস্তোরার দেখা মিলল,ভেতরে আলো জ্বলছে। ভাবলাম, এবার পরিশ্রম সার্থক। রেস্তোরার কাছে এসে দেখি ভেতরে চেয়ার টেবিলগুলো পরিপাটি ভাবে সাজানো কিন্তু কোন লোক নেই। প্রবেশ দরজা বন্ধ। ধাক্কা দিয়ে মনে হল ভেতর থেকে তালা লাগানো।এখানেও একটি নোটিশ টাঙানো,লেখা রেস্তোরা সন্ধ্যা ছটার পর থেকে খোলা হবে।এর মধ্যে সুমির ফোন,ও জানালো খাবার না পেলে সমস্যা নেই, বাসায় চলে এসো,ফ্রিজে ডিম ও মশলার তাকে একটি ময়দার প্যাকেট পেয়েছি এগুলো দিয়ে কিছু চাপড়ি ও ডিমের অমলেট বানিয়ে আপাতত চালিয়ে নেয়া যাবে।

আমি রেস্তোরা খোঁজার চেষ্টা বাদ দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। বাসার ফিরে দেখি সুমি ইলেকট্রিক চুলা চালানোর চেষ্টা করছে।চুলায় সংযোগ বাতি জ্বলে আছে কিন্তু চুলা গরম হচ্ছে না। ও ব্যর্থ হয়ে আমাকে চেষ্টা করতে বলল। আমি চুলার প্রতিটি স্পর্শ বাটন বিভিন্ন ভাবে ব্যাবহারের করে ব্যর্থ হলাম।ঘড়ির কাটায় তিনতে বাজতে চলেছে কারো পেটে ভারী খাবার পড়েনি।এখানে আসার পর থেকেই কোন কিছু সহজ ভাবে হচ্ছেনা।শুরুর দিনই আনন্দের বদলে নিরানন্দে ছেয়ে ধরছে আমাদের ।মনে হল, কোন ভৌতিক জায়গায় এসে পড়লাম, সামনের দিনকটিতে আরও কি কপালে আছে তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম।

অবশেষে বাসার মালিকের মোবাইলে আবার কল করতে হল।বললাম, বাসার সবকিছু ঠিক আছে কিন্তু ইলেকট্রিক চুলা গরম হচ্ছে না। লোকটি একটি নির্দেশনা দিলো,সেই মোতাবেক চুলার বাটন চাপার পর চুলা গরম হয়ে হয়ে উঠলো।কপালে যে অনিশ্চয়তার যে ভাজ পড়ে ছিল তা মুহূর্তেই চলে গেলো। ইলেকট্রিকের গরম উনুনে তৈরি হল চাপড়ি আর ডিমের ওমলেট। তাই হয়ে উঠলো অমৃত,পেটকে শান্ত রাখার ঐ মুহূর্তের অন্যতম উপাদেয়।

খাওয়ার পর আমরা সবাই বিশ্রামে চলে গেলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি সন্ধ্যা নেমে এসেছে।বিল্ডিং সামনের সান্ধ্য বাতিগুলো জ্বলে ওঠায় পাসেজের উপর দিয়ে জমে থাকা সাদা তুষারের স্তর মুক্তার মত চিকচিক করছে।আমাদের সবার শরীরেও ফিরে এসেছে ফুরফুরে ভাব।দেহ মন শান্ত। সিদ্ধান্ত নিলাম, সবাই বাইরে বেরিয়ে এলাকার আশেপাশে হেঁটে দেখবো এবং আসার সময় একটি রেস্তোরাঁয় বসে খেয়ে বাসায় ফিরবো। সেই অনুযায়ী সবাই ভারী পোশাক পরে বেরিয়ে পড়লাম। বরফের উপর দিয়ে হাঁটতে ওদের দুজনের বেশ সমস্যা হচ্ছিলো তাই বেশী দূর যাওয়ার হলনা।দুপুরের আবিষ্কার করা তুর্কি রেস্তোরাঁয় ডুকে কাবাব ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে সেরে নিলাম রাতের ভোজ। রেস্তোরাঁটিতে কোন ভিড় নেই। হঠাৎ কেউ এসে খাবারের পার্সেল নিয়ে চলে যাচ্ছে, আবার কেউ টেবিলে বসে খাচ্ছে। নিজের মত করে একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম, এ এলাকায় কেন সারাদিন রেস্তোরাঁ খোলা থাকে না।

বরফে আবৃত এলাকা হওয়ার কারণে মানুষ ঘরের মধ্যে বৈদ্যুতিক হিটারের উষ্ণতায় সময় কাটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।তাছাড়া রাস্তার ফুটপাতগুলো বরফে ঢেকে থাকায় দুর্ঘটনা এড়াতে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে হাঁটতে বের হয়না। ব্যক্তিগত মটরগাড়ি এখানে চলাফেরার প্রধান বাহন।পাবলিক বাস থাকলেও সেগুলোতে দু চারজন পর্যটক ছাড়া স্থানীয়দের খুব একটা চলাচল নেই।

মানুষের বাহিরমুখি না হওয়ার প্রবণতার কারণে রেস্তোরাগুলোয় মানুষের তেমন আনাগোনা হয়না।।যার দরুন রেস্তোরা মালিকরা সারা দিন একটানা রেস্তোরা খুলে না রেখে কর্মচারীর মজুরি ও ইলেকট্রিক বিল সাশ্রয় করে।কারণ রেস্তোরা খোলা রাখলে বিক্রি না হলেও কর্মচারীর মজুরি ও বিদ্যুৎ বিল দিতেই হবে।যার কারণে, যে সময়টায় মানুষের খাবারের চাহিদা বেশী থাকে শুধু সেই সময়েই রেস্তোরা খোলা রাখে।স্থানীয় মানুষদের বিষয়টি জানা থাকায় তারা কোন বিড়ম্বনা ছাড়াই সময় অনুযায়ী রেস্তোরাঁয় গিয়ে আহার করতে পারে, কিন্তু আমাদের মত পর্যটকদের হঠাৎ এসে পড়তে হয় সমস্যায়।

বাসায় ফিরে আমাদের সামনের দিনগুলোতে কোথায় ঘুরতে যাবো তার একটি পরিকল্পনা করে নিলাম। প্রথম দিন ২১ ডিসেম্বর, ট্রামে করে আল্পস পর্বতমালার সবচেয়ে উঁচু পর্বত মোঁ ব্লতে ওঠার সিদ্ধান্ত হল আমাদের।এরপর কিছুক্ষণ গল্পগুজব তারপর ঘুম।

চলবে ……
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২২ রাত ৮:০৫
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×