গতকাল মাদ্রাসায় বড়দের নির্যাতন নিয়ে লেখাটিতে মন্তব্য করে অনেকেই মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তুলে দেয়া উচিত কিংবা মাদ্রাসা শিক্ষায় জাতী কি পাচ্ছে... ইত্যাদি অনেক ধরনের প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে ব্লগে এই মন্তব্যের সংখ্যা বেশী।
যারা এই নির্যাতন ইস্যুকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসা শিক্ষার বিষয়টাকে প্রশ্ন তুলেছেন তাদের বলছি; আমার মাথা ব্যাথা হলে কি মাথাটাই কেটে ফেলবেন, নাকি চিকিৎসা করাবেন?
গতানুগতিক শিক্ষার থেকে মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রদের প্রতি নির্যাতনের ঘটনা একটু বেশী। এটা মেনে নিতে হবে। বিশেষ করে হাফেজী মাদ্রাসাগুলোতে এটাই ধারনা যে, 'না মারলে হাফেজ হয় না।'
কিন্তু এটা নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ঘোলা করার চেষ্টা কতটা ঠিক?
আচ্ছা! আপনার বাড়ির পাশের মসজিদের ঈমাম কিংবা মুয়াজ্জিনের মাসিক বেতন কত? জানেন? একজন বেসরকারী মাদ্রাসার শিক্ষক তার পাঠদানের বিনিময়ে কত টাকা বেতন পান সেটা জানেন?
হাফেজী মাদ্রাসার হুজুর, যিনি কিনা তার পরিবারকে অনেক দূরে রেখে মাসে মাত্র ৫ থেকে ৮ হাজার টাকার বিনিময়ে বছরে ১০-১৫ জন হাফেজ তৈরি করেন। কিন্তু এই টাকায় তার সংসার কিভাবে চলে সেটা প্রশ্ন করেছেন?
হুজুর এখন এই সেবার পাশে একটা আরবি প্রাইভেট পড়াবেন। কারন হুজুর আরবি ছাড়া আর কিছু জানেন না এটাই আপনাদের ধারনা। যাইহোক সেখানে গিয়েও আরবি নাম শুনেই আপনিই তার বেতনের অফার শুরু করেন ৩০০ টাকা থেকে, আর সেটা ৫০০ তে গিয়ে স্বাক্ষর করেন। অথচ অন্য বিষয়ের শিক্ষকে শুরুই করেন ২ হাজার থেকে।
বাবা-মাকে জান্নাতে পাঠাতে দরকার হলেই হুজুরকে ডাকেন। ২ টা মুরগীর পিছ খাইয়ে মনে করেন হুজুর শুধু খায়। আর হাতে ২০০ টাকা ধরিয়ে দিয়েই মনে করেন হুজুরকে কিনে নিয়েছেন।
হুজুর ইমামতি করবে। সমাজের নেতা হবে। কিন্তু মিম্বারে দাঁড়িয়ে কাউকে একটু ইঙ্গিত করলেই বলেন হুজুর রাজনীতি করে। পরের দিন তাড়িয়ে দেন। চাকরীর কোন নিরাপত্তা দিতে পারেন নাই।
আরো কত কিছুই না করেন হুজুরের সাথে। অনেকেটা হুজুরের জামাটা সাদা বিধায় একটু দাগ বেশীই দেখা যায়।
কিন্তু কখনও হুজুরের সাথে এম্পেথি করেন নাই। তার বন্ধু না হয়ে তাকে সমাজের ২য় শ্রেনীর মানুষ মনে করেছেন। হুজুর কিছু একটা ভুল করলেই সেটাকে সুযোগ বানিয়েছেন। পাঞ্জাবী পরিহিত হুজুর মনের ভুলেও রাস্তায় কোন নারী দিকে তাকালে তাকে তিরস্কার করেন। আর নিজেরা করলে আধুনিকতা মনে করেন। আবার নিজেকে খাটি মুসলিম দাবী করে তৃপ্তির ঢেহুক তুলেন।
আপনার রাষ্ট হুজুরদের কি দিয়েছে?
আমি এমন অনেক শিক্ষক চিনি যারা এমপিও হবে সেই আশায় ২০ বছর বিনা বেতনে চাকরী করে যাচ্ছেন। স্কুল এমপিও দেন ১০০০ হাজার মাদ্রাসায় আসলেই ১০ টাও নাই। কি বিচার!
ইমাম বা মুয়াজ্জিন নিয়োগগুলো রাষ্ট্রীয়করন করতে পারেন নাই। এলাকার নেতাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। আবার সেই নেতাও আপনাদের দলের। কিন্তু একটা মুসলিম দেশ হিসেবে তাদের সবার চাকরীগুলো সরকারী হওয়া উচিত ছিল।
হুজুর দেখলেই নাক ছিটান । মাদ্রাসা বন্ধ করে দিতে বলেন। মারা গেলে আপনার জানাযা কে দিবে সেটা ভেবে দেখেছেন? হুজুর না থাকলে আপনার বাবা-মাকে জান্নাতে পাঠাতে দোয়ার জন্য কার কাছে যাবেন?
এবার শুনুন মাদ্রাসা ছাত্রদের সফলতার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে ভর্তি পরিক্ষায় ১ম হওয়াদের একটা তালিকা করেন। পেয়ে যাবেন। মেডিকেল, বুয়েট থেকে শুরু করে সুযোগ পাওয়া ছাত্রদের তালিকায় মাদ্রাসা ছাত্রদের সফলতা আর প্রচেষ্টা একটু বেশিই। দেশে বাহিরে এসেও দেখেছি। যতগুলো দেশে ঘুরেছি। যাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। বড় একটা অংশ ছিল মাদ্রাসার ছাত্র, যারা বিদেশেও সফল।
তবে দেশে তাদের সুযোগ দেন নাই। BCS দিবে হুজুর। এটা শুনলেও মুচকি হাসেন। শুরু থেকে শেষ অব্দি হুজুর বলে আর কত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন।
আর নৈতিকতা?
একটা মাদ্রাসা ছাত্রের কাছে যে নৈতিকতা আছে তা আপনি সাধারন ছাত্রের কাছে পাবেন? সাদা জামায় দাগ একটু বেশী দেখা যায় আর তাই অনৈতিকতা সামনে আসলে বেশীই ফুটে উঠে। কিন্তু সেটা বছরে ২-৩ বার।
কিন্তু খুন, রাজহানী, ধর্ষন, হানাহানি সহ দেশে যা যা ঘটে, তার কতগুলো মাদ্রাসার ছাত্র ঘটায়? তো যারা ঘটায়, তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলে তো দেশে মাদ্রাসা ছাড়া কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই থাকবে না।
এটা মানতে হবে মাদ্রাসা শিক্ষায় আধুনিকতার অভাব আছে। ধর্মকে সামনে রেখে নানান ভাবে বিভক্ত হয়েছে তারা। আর সবাই শুধুমাত্র তাদেরকেই সঠিক মনে করেন। এটা তাদের অগ্রগতিতে বাঁধা হয়ে আছে। চিন্তার মাঝে পরিবর্তন দরকার। কামিল পাশ করে মুয়াজ্জিনের চাকরী না খুজে দেশের সাধারনের সাথে মিশে যেতে শিখতে হবে। নিজেকে ছোট না ভেবে, বড়দের সাথে মিশে যেতে নিজেকে তৈরি করতে হবে। দেশেরও উচিত হবে তাদের সুযোগ করে দেয়া।
দরবার ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশী মনিটরিং করা উচিত। এই প্রতিষ্ঠান গুলো নিজেদের দরবারকেই শুধুমাত্র ধর্মের বাহক মনে করেন। ছাত্রদের জন্য পাব্লিক টয়লেট যেখানে কিনা লাইনে দড়িয়ে থাকতে হয়, খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা, আবার 'খাবারের প্লেটে পোকা না ভাসতে দেখলে আলেম হওয়া যায় না' সহ মাঝে মাঝে শিক্ষদের মুখে ছাত্রদের হেয় করে বলা কথা শুনে তারা নিজেদের ছোট মনে করতে শিখে। ছোট বেলায় ভেতরে জমে যাওয়া ভয়, বৃদ্ধ হলেও বিতারিত করতে পারে না।
সমাজের অন্যদের সাথে মিশে যেতে যা অনেক বড় সমস্যার কারন হয়। আবার সাধারন শিক্ষিত শিক্ষকরাও সেই দরবারী এজেন্ডার অংশ হয়ে যায়, না হলে সেখানে টিকে থাকা দায়।
কিন্তু এটাকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসা শিক্ষার অপ্রয়োজনীয়তা প্রমান করতে চাওয়া নিতান্তই মূর্খতা। দরকার ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিবর্তন। অসমতা তুলে দিলে মাদ্রাসা, পিছিয়ে থেকে বিষয়গুলোকে ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যেতে পারবে।।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০২১ দুপুর ২:৩১