- সিগারেট বাদ দিলে হয় না, রিয়াদ? দেখো! এই প্যাকেটের উপর স্পষ্ট করে লেখা আছে, “ধূমপান স্ব্যাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর”।
- তোমার কি মনে হয়, এই যে সিগারেট বা অ্যালকোহল এর উপর একটা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ লেখা আছে শুধুমাত্র কি সেটাই যথেষ্ট? আরো বেশ কিছু খাবার আছে, বিষয় আছে, ব্যক্তি-বস্তু আছে, এমনকি প্রাণী আছে যাদের উপর এই লেবেলিংটা করে রাখা উচিত।কারণ সময় সময় সিগারেট বা অ্যালকোহল এর চেয়ে ঐ সব অনেক বেশি ক্ষতিকর।
- তর্কের খাতিরে তর্ক করতে হবে ব্যাপারটা তো এমন নয়, রিয়াদ! বুঝতে চেষ্টা করো।
- কি? কি বুঝাতে চাও তুমি?
আনিকা এরপর উঠে দাঁড়ালো, তারপর রাস্তা ধরলো হোস্টেলের দিকে।কথাগুলো রিয়াদকে বুঝাতে না পেরে এর আগেও অনেকবার ব্যর্থ হয়েছে।তাই আজ আবার নতুন করে যুক্তি-তর্কের ঘেঁষাঘেঁষিতে সম্পর্ক ছিঁড়ে জানালা দিয়ে আবার পালিয়ে না যায় এজন্য এই স্পষ্ট এড়িয়ে যাওয়া।কারণ, আনিকার মতে, “সম্পর্ক ছেড়ে দেবার চেয়ে, ধরে রাখাটাই অনেক কঠিন”।হ্যাঁ, এতে যদি কেউ তাকে টিপিক্যাল বাঙালী মেয়ে বলে তাতে তার কোন আপত্তি নেই।থাকবার কথাও নয়, পড়াশোনা শেষ তারপর সংসার বাঁধলে রিয়াদের সাথেই সংসার বাঁধবে সুতরাং অন্যরা কি ভাবলো বা কি ভাবছে সেসব খুব একটা মানে রাখে না ওর কাছে।
রিয়াদ ভাবছিলো এমন করে বলাটা হয়তো ঠিক হলো না! তাই এই ভাবনার মস্তিষ্ককে শান্তি দিতে আরো তিনটে সিগারেট ব্যয় করে ফেললো।বেশ কিছু সময় পার্কের চারদিকে ঘোরাফেরা করলো।তারপর সুন্দর এই পার্কের পরিবেশ দেখে নিজের অজান্তে মনে মনে হাসতে লাগলো আর যেন আনিকাকে বললো, “আনিকা, এই পার্কের সামনেও একটা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ট্যাগ লাগাতে হবে, যা পরিবেশ এখানকার”।
চার বছর পর...
ওদের একসাথে দেখতে চেয়েছিলো ওদের পরিবার কিন্তু শেষমেশ সেটা হলো না।মাঝখানে আনিকার জেদ আর রিয়াদের যুক্তি-তর্ক সম্পর্কটাকে ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হলো।আনিকা এখন একজন ব্যাংকার আর রিয়াদ একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ত্ব।আরো স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, রিয়াদ একজন শিল্পী এবং ভালো অভিনেতাদের একজন।তৃতীয় পক্ষ থেকে কেউ এই ব্যাপারটা বিচার করলে হয়তো বলবে, দুজনেই দুজনের জায়গা থেকে যথেষ্ট ভালো করেছে।কিন্তু ভালো না হওয়ার মধ্যে যেটা হয়নি সেটা হলো তাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাওয়া।
যাইহোক, পরবর্তী অধ্যায় আসে রিয়াদের জীবনে।“জীবন থেমে থাকে না” – এই দর্শনে মেনে চলা মানুষগুলোরও সময় সময় জীবন থেমে যায় একটা ফুলস্টপ নিয়ে।কিন্তু রিয়াদ হয়তো ভাগ্যবান তাই শ্রেয়সীর মত একজনের সাথে দেখা হয়ে যায়।শ্রেয়সী একটা নাম, একটা প্রশংসাও।শ্রেয়সী একজন ডাক্তার।একটা থানার সরকারী হাসপাতালে শিশু ও গাইনী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে কাজ করছেন।কাজের সাথে তার সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ, এর বাহিরে গিয়ে তেমন একটা সময় পান না, একা থাকেন।কিন্তু সন্ধ্যায় ক্লিনিক হয়ে বাসায় ফিরে টিভিটা অন করেন আর একদিন এক চ্যানেলে রিয়াদকে দেখতে পান তিনি।একটা ইন্টারভিউ দিচ্ছিলো তখন রিয়াদ,
উপস্থাপিকাঃ কেমন আছেন?
রিয়াদঃ ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?
উপস্থাপিকাঃ জ্বী, আমি ভালো আছি।তা রিয়াদ ভাই এই পর্যন্ত মোট কয়টা গান শ্রোতাদের উপহার দিলেন?
রিয়াদঃ সবমিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশটা হবে।এছাড়াও কিছু সিনেমার গানও আছে।
উপস্থাপিকাঃ আপনার শ্রোতারা তো আপনার ভীষণ ভক্ত।তাছাড়া আজকাল সিনেমা এবং নাটকেও কাজ করছেন।তো শ্রোতা এবং দর্শক এই দুই দলকে আলাদা করে মূল্যায়ন করেন? না কি একই রকমভাবে মূল্যায়ন করেন?
রিয়াদঃ না, আলাদা করে মূল্যায়ন করি না।মূল্যায়ন করার কি দরকার আছে সেটাই আমি এখনো বুঝি না! আমি কাজ করি কেউ আমাকে পছন্দ করুক এজন্য নয়।আমি আমার জন্য কাজ করি আর হয়তো সেটা কারো পছন্দ হয়ে যায়।এবং তাদের প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ।কারণ, তাদের দ্বারাই আমার পেট চলছে।
উপস্থাপিকাঃ প্রিয় দর্শক, চলুন শুনে আসি আপনাদের পছন্দের শিল্পীর একটি গান।
................
সেদিনের এই ছোট্ট সংলাপে শ্রেয়সীর মেজাজটা খারাপ হয় গেছিলো।কিন্তু একদিক থেকে তো রিয়াদ ঠিকই বলেছে,
“আমরা তো আমাদের একান্ত নিজেদের জন্যই কাজ করি।ধূর ছাই! এখনকার মিডিয়া ব্যক্তিত্ব যারা আছেন তাদের কথার ওজন নিয়ে আবার ভাববার কি আছে! বাজারী লোক, অতি তুচ্ছ।কেন যে এদের এত টাকা দিয়ে টিভির পর্দায় দেখানো হয়? সেটা আমার মাথায় ঢুকে না”।
বেশ কিছুদিন পর...
রিয়াদঃ হ্যালো ম্যাম! আসবো?
শ্রেয়সী একটু অবাক হয়ে বললোঃ আসুন!
রিয়াদঃ বসতে পারি?
শ্রেয়সীঃ বসেই তো পড়েছেন।কিন্তু আপনি মনে হয় ভুল করে আমার চেম্বারে চলে এসেছেন।আমি পুরুষদের কোনভাবে সাহায্য করতে পারি না।আর আপনাকে দেখে তো কোন শিশুও মনে হচ্ছে না!
রিয়াদ বেশ নম্রভাবে উত্তর দিলোঃ না, আমি ভুল করিনি।আমি এখন যা বলবো চমকে উঠবেন না।অনুগ্রহ করে শান্তভাবে আমার কথাগুলো শুনবেন।
শ্রেয়সীঃ ঠিকাছে, বলুন?
রিয়াদঃ গতকাল রাত্রে আমার একটা লাইভ শো-ছিলো একটা চ্যানেলে।ওহ্ হ্যাঁ, আমি একজন শিল্পী, গান করি।যাইহোক, শো শেষ করি আমরা প্রায় রাত দু’টার দিকে।ফেরার পথে আমার ড্রাইভার সামনের রাস্তায় কি যেন দেখে গাড়িটা থামায়।আর বলে, “আপনি ভীতরেই থাকুন, আমি দেখে আসি”।তারপর আমার ড্রাইভার আমাকেও নামতে বলে গাড়ি থেকে আর ফিসফিস মত করে উচ্চশব্দে বলে উঠে, “সামনের ঐ ক্লিনিকের প্বার্শের ডাস্টবিনে একটা সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু পড়ে আছে, স্যার।এখনো জীবিত আছে”।
শ্রেয়সী এবার বেশ কৌতুহল নিয়েঃ তারপর?
রিয়াদঃ দেখুন, আমি ঐ বাচ্চাটাকে বাঁচাতে চাই।কি ফুটফুটে একটা বাচ্চা! দেখলেই মায়া লাগছে।মানুষ কীভাবে এসব পারে! ভাবতেও লজ্জা লাগে।
শ্রেয়সীঃ তো? আমার কাছে এসেছেন কেন? থানায় যান? ডায়েরী করুন?
রিয়াদ বেশ শান্তভাবে বললঃ ওকে। ক্লিনিকটার নাম কি জানেন? “সূর্যোদয়”।আর ঐ ক্লিনিকের মালিক হলেন আপনি।অন্যদিকে আমি একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হয়ে কীভাবে একজন বাবার পরিচয় ছাড়া এরকম একটা বাচ্চাকে কাছে রাখবো।তাই পুরো ব্যাপারটা ফাঁস হলে আমার রেপুটেশন তো যাবেই সাথে আপনার ক্লিনিকের ঘটবে সূর্যাস্ত।এখন মনে হয় ব্যাপারটা বেশ কনভিন্সিং লাগছে, রাইট?
শ্রেয়সীঃ আপনি আমায় থ্রেট দিচ্ছেন! আর কি প্রুফ আছে যে আমার ক্লিনিকের প্বার্শের ডাস্টবিন থেকেই বাচ্চাটা আপনি কুড়িয়ে পেয়েছেন?
রিয়াদ এবার হাসতে হাসতে বললোঃ এই কার্ডটা দেখুন? আর আপনাদের ডাটাবেজ থেকে যদি এখনো তথ্য মুছে ফেলা না হয় তাহলে সব টের পেয়ে যাবেন আশা করি।আর সবচেয়ে বড় কথা, আমার সময়ের একটা দাম আছে ঠিক যেমনটা আপনার সময়ের।বাচ্চাটার কিছু ঘটলে আমি শিল্পী না কি অভিনেতা ভুলে আপনার দোকান আগে বন্ধ করবো।এবং এটা থ্রেট নয়, সূর্যের মত ধ্রুব হতে যাচ্ছে ব্যাপারটা।লিখে রাখুন... (এটা বলেই রিয়াদ প্রস্থান করতে লাগলো, কিন্তু শ্রেয়সীর বাঁধা পেয়ে আটকে গেলো)
শ্রেয়সী রুমের গেট লাগিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে রিয়াদকে বললোঃ আমার কাছে আপনি কি চান?
রিয়াদ এবার বেশ শান্ত হয়ে বললোঃ শুনেছি আপনি সিঙ্গেল ওমেন।একা থাকেন।তাই এই বাচ্চার দায়িত্ব আপনি নিবেন।প্রয়োজনে যা লাগবে আমি আপনাকে তা দিবো।বাচ্চাটা হাসপাতালের বাইরে আমার ড্রাইভার কারে করে নিয়ে আছে।ওখান থেকে ওকে বাসায় নিয়ে যান, ওকে বাঁচান।আর এই নিন আমার কার্ড।যে কোন প্রয়োজনে একটা ফোনকল, ব্যস! আলাদিনের জ্বীনের মত আমি আপনার কাছে হাজির হয়ে যাবো।
আরো দুই বছর পর...
(কোন এক সন্ধ্যায় ব্যস্ত শহরের বিলাসবহুল কফিশপে, কফি হাতে বসে আছে রিয়াদ এবং শ্রেয়সী)
রিয়াদ প্রথমে কথাবলা আরম্ভ করলোঃ কেমন আছো বলো? আজকাল দুজনে মিলে কাজে এত ব্যস্ত যে দেখা করার সময় মিলাতে পারছিনা।
শ্রেয়সীঃ ওহে প্রেমিক আমার, তাহলে ঐ গানটার দুই লাইন গাও,
“ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর, তাই বলে ভেবো না আমায় স্বার্থপর...”
রিয়াদঃ না গো, বিয়েটা এবার করতে হবে।বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো! আর তুমি আজ সাবিত কে সাথে করে নিয়ে আসোনি?
শ্রেয়সীঃ সাবিত এখন ঘুমাচ্ছে, একজন নার্স কে দায়িত্ব দিয়ে এসেছি।চিন্তা করো না।
রিয়াদঃ ওকে, তারপর...
শ্রেয়সীঃ তারপর, সাবিতের মায়ের নাম কি জানো? আনিকা তাসলিম! আপনার প্রাক্তন হবে মনে হয়।
রিয়াদ এবার একটু বিষম খেয়েঃ ধূর! দুই বছর পরে তুমি সেই ক্যাটালগ ঘেঁটে উদ্ধার করলে? আর সেটা বিশ্বাসযোগ্য!
শ্রেয়সীঃ না, আমি সেদিনই সেটা আবিষ্কার করেছিলাম।
রিয়াদ এবার আচমকা একটা ধাক্কা খেয়ে বললোঃ হোয়াট? আমাদের মধ্যে শুধু একবার সেটা হয়েছিলো।তারপর... ছি! আমি এত জঘন্য হলাম কি করে! আর তুমি-ই বা এতদিন সেটা আমাকে জানাওনি কেন?
শ্রেয়সীঃ শান্ত হও, তুমি জঘন্য নও।জঘন্য তো সে যে তোমার ভালোবাসার উপহার গ্রহণ করতে পারেনি।এভাবে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে চলে গেছিলো।আর আমি তোমাকে কি জানাবো?
রিয়াদ অস্থির হয়েঃ এই যে এবোর্শনের ঘটনাটি জানার অধিকার কি আমি রাখি না? শিট্!
শ্রেয়সীঃ তুমি কি জানো আমার ঐ ছোট্ট ক্লিনিকে প্রতিদিন কতটা এবোর্শন হয়? গড়ে প্রতিদিন পাঁচ থেকে দশটা।আমার সাথের সহকারী ডাক্তার এবং নার্সেরা সেসব দেখে ঘেন্ন্যায় মরে যায় অবস্থা, তবুও কত ব্যস্ত থাকতে হয় এইসব জঘন্য কাজ নিয়ে।কারণ দিনশেষে সমাজের এসব আবর্জনা সাফ করে তাদেরও পেট চলে।আর যদি আমি সেদিনই জানাতাম, তাহলে পকেটে করে আমায় বিয়ে করার জন্য তুমি শত ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও রিং নিয়ে আসতে না, আসতে? আর একটা কথা ভালো করে মনে রাখো, আমিও বাচ্চাটাকে উধাও করে দিতে পারতাম।ভুলে যেও না আমি একজন সরকারী কর্মকর্তা শুধু নই, একজন ডাক্তারও।
রিয়াদঃ তাহলে এই গল্পে আমি কে? নায়ক হলাম? না কি ভিলেন?
শ্রেয়সীঃ সব গল্পে নায়ক এবং ভিলেন থাকে না রিয়াদ! সিনেমা থেকে বের হও।এখন প্রোটাগোনিস্ট আর এন্টাগোনিস্ট এর যুগ চলছে।তুমি এখন বরং একটা সিগারেট ধরাও আর শান্ত হও।এই নাও তোমার সিগারেট আর এই প্যাকেটে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ লেখাটা আমি মুছে দিয়েছি।
রিয়াদঃ তুমি কি করে জানলে আমি সিগারেট খাই?
শ্রেয়সীঃ ভালোবাসার মানুষ সম্পর্কে যতদূর সম্ভব ধারণা রাখতে হয়।বড়জোর কি আর হবে! আমার সামনে আমার আগেই আমাকে রেখে একদিন এর জন্যে হয়তো চলে যাবে।কিন্তু শুধুমাত্র এটার জন্য পুরো মানুষটাকে আমি হাতছাড়া করতে পারি না।আর সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ একটা সিগারেটের প্যাকেটে না লিখে ঐ সব জঘন্যতম এবং নোংরা মানসিকতার ব্যক্তিদের গায়ের উপর লিখা উচিত।
রিয়াদ এবার শ্রেয়সীর সামনে হাঁটুগেড়ে বসে বললোঃ রিংটা কি তুমি এতকিছু জানার পরেও গ্রহণ করবে?
শ্রেয়সীঃ ধূর বাল! অনেকখন থেকে হাতটা সামনে এগিয়ে দিয়ে রেখেছি।ক্লান্ত হয়ে গেলাম।চোখে কি কম দেখো?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ৮:৫৬