
অনেকসময় খেয়াল করবেন ভীড়ের মাঝেও কিছু কিছু মানুষ একা থাকেন। নিজের সঙ্গ কে বেছে নেন সময়টুকু কে সবার সাথে উপভোগ করে কাটানোর চেয়ে। তাদের গায়ে সবচেয়ে বেশি ট্যাগ বা তকমা লাগে ‘আত্মকেন্দ্রিক’ হিসেবে। এক ধরণের আলোচনা-সমালোচনা ব্লগে/সোশ্যাল সাইটে চলে; ইন্ট্রোভার্ট/এক্সট্রোভার্ট ব্যাখ্যায় কে কাকে কতটুকু এগিয়ে রাখতে পারা যায় সেসব নিয়ে। শুধু তাই নয়, সমাজ তাকে আলাদা চোখে ভাগ করে বিবেচনায় নেয় বা দেখা শুরু করে। অথচ, এই ইন্ট্রোভার্ট/এক্সট্রোভার্ট ধারণাই ভুয়া ধারণা।
আবার আমরা হয়তো আত্মকেন্দ্রিকতা বুঝি, তার ক্ষতিকর দিক/মন্দ দিক সমূহের তালিকা জানি বা বুঝি। কিন্তু একটা বড় অংশ জুড়ে এসব মানুষের সবাই আত্মকেন্দ্রিক নন। হতে পারে এই সংস্কার, সমাজ, পরিবার এবং প্রতিষ্ঠান সমূহ তাকে ওমন বানিয়েছে। আমরা যেটা বুঝি না বা সহজে ধরতে পারি না সেটা হলো ‘Rise of The Culture of Victimhood’। অথবা ব্যক্তিত্বের নানান রকম ধরণের মধ্যে ‘Tendency for Interpersonal Victimhood’ নিয়ে চিন্তাও করি না।
বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে আত্মকেন্দ্রিক মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ নিয়ে দেশের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘প্রথম আলো’র (বাংলাদেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক পত্রিকা) এক পরিসংখ্যানে সেটি ৭৫% শতাংশেরও বেশি মানুষ এমনটাই বলছেন বলে দেখানো হয়েছে এবং ২০% শতাংশ মানুষ মনে করছেন বা আংশিক স্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভুল তথ্য বেশি দেখবেন, সাজানো-গোছানো কিছু লেখায় যা আমার কাছে বাস্তবতা বিবর্জিত বলে মনে হয়।
এদেশের মানুষ এখনো Good Touch/Bad Touch অথবা শরীরের প্রাইভেট পার্ট নিয়ে কথা বলাটা ট্যাবু মনে করেন। খুব সম্ভবত এ বিষয়ে আপনি পুরোপুরি সহমত না হলেও আংশিক সহমত হলেও হবেন আশা করি। এখানে একজন মেয়ে বা ছেলে ছোট থেকে বড় হওয়ার সময় নানান রকমের ‘Bad Touch’ পেয়ে থাকেন; যা স্বীকার করা বা বলাও এক ধরণের ট্যাবু।
কিন্তু যার সাথে এমন হয় (বিশেষ করে আমি যে দু’চারটে কেস নিয়ে অন্তত আলোচনায় গেছি) তাদের মানসিক অবস্থা অত্যন্ত অগোছালো হয়ে পড়ে এবং ট্রমাটিক এক্সপেরিয়েন্স পর্যন্ত হয়েছে বলে জানি। এই ট্রমার জন্য ভীড় কে সে ভয় পায়, ভীড় কে নিজের শক্রু মনে করে, ভীড় মানেই বাজে লোকে ভরপুর চিন্তায় মগ্ন থাকে। ফলতঃ ঐ অনুষ্ঠান/আয়োজন উপভোগ করা আর তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এ সমাজের আরো একটি কালো অধ্যায় হচ্ছে, ‘Parental Blessing’; যার স্বাভাবিক অর্থ হওয়া উচিত ছিলো, বাবা-মা’র আশীর্বাদ। যে আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে সন্তান ভালো কাজে অংশগ্রহণ করবে, এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য নিজের অবদান রাখবে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিত্রটি উল্টো। বাবা-মায়ের সম্পদ-সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আশীর্বাদ সন্তানকে ভুল পথে ধাবিত করার একটি অন্যতম কারণ। এই সন্তান জানে না তার আশীর্বাদ পুষ্ট হওয়াটা কতটুকু কল্যাণকর। তাই চলার পথে নিচু স্তরের মানুষদের ছোট করেন। বলার সময় ‘Mannerism’ নামকও যে একটি শব্দ আছে তা বেমালুম ভুলে যান।
ফলতঃ সে সমাজের ঐ নিচু স্তরের ছেলে/মেয়েটি নিজের জায়গা/অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে পড়েন। তুলনামূলক ভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে ভয় পান। আয়োজন একটু বড় হলে, তার হৃদয় বলে, “বোধহয়, এই আয়োজন উপভোগ করা আমার সাধ্যে বা সামর্থ্যের নয়।” পুঁজিবাদী সমাজে কিঞ্চিৎ অংশ আশীর্বাদ কে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করলেও বাকিদের জন্য শ্রেণী ভাগ হয়ে ওঠে ক্ষতিকর এবং নিচু বা ছোট স্তরের বলেই তিনি/তারা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে নিজ পরিবার ও সমাজ থেকে অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
নব্বই দশকের পর ঝন্টু সাহেব (বাংলাদেশের এক সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা) সিনেমা পরিচালনায় যেমন ব্যর্থ হোন ঠিক তেমন করে এই প্রজন্ম কে বুঝতেও ব্যর্থ হোন আমাদের তথাকথিত সমাজ। তারা তাদের উত্তরসূরী থেকে পাওয়া কিছু নোংরা সংস্কার যা বাস্তবতা বিবর্জিত সেসব কে দাম অনেকক্ষেত্রে বেশি দিয়ে থাকেন। বাদ পড়ে না তাদের নিজ ছেলে/মেয়ে। একের পর এক তার ব্যর্থতার জন্য তাকে ঢিল ছুঁড়বেই। এজন্য বর্তমানে সামগ্রিক যে আত্মহত্যার চিত্র তার স্পষ্ট প্রমাণ। আর যারা আত্মহত্যা করতে পারেন না, তারা হলেন ঐ তথাকথিত তকমা পাওয়া আত্মকেন্দ্রিক মানুষগুলো।
আসলে একটি সমাজ যখন কেউ ভালো করে তার প্রতি প্রত্যাশার যে চাপ রাখেন তা অনেকক্ষেত্রে মেটানো অসম্ভব এবং অবাস্তব হয়ে পড়ে। এ সমাজের নব্বই দশকের আগের চিন্তাগুলোর সাথে বর্তমান প্রজন্মের যে দা-কুমড়া সম্পর্কের বিষয় সেটা বোধকরি অজানা নয়। সমাজ যখন কাউকে কেন্দ্র করে ক্রমান্বয়ে তাকে ছোট করে, তাকে ঘিরে বাজে কথা বলে, তার আত্মসম্মানে চোট পৌঁছায়, তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টায় মজে ওঠে এবং হঠাৎ তার প্রকৃত চেহারা যখন অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক যা ‘Narcissistic' পর্যায়ে চলে যায় তখন পুনরায় তাদের কপাল ঘর্মাক্ত হয়।
সমাজ তখন এটি বুঝতে পারে না যে, যে আয়নায় সে আজ নিজেকে অমসৃণ ও মলীন দেখছে প্রকৃতপক্ষে সে আয়না টি খোদ নিজেদেরই তৈরি করা। সুতরাং আত্মকেন্দ্রিক হওয়া সবার জন্য অপশন হতে পারে না। কারো কারো জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সকল ডিস্টার্ব নয়েজ থেকে বাঁচতে এ যেন একটি স্বস্তির চয়েস!
ছবি: Wise Seed Health Solutions
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




