বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাদ্রাসার ক্ষেত্র জুড়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৈষম্য চরমে। আমি ‘মাদ্রাসা’ শব্দটিকে মোটাদাগে তিনভাবে লিখে থাকি, (ক) মাদ্রাসা, (খ) মাদ্রাসা, (গ) মাদরাসা। আমার মতে সঠিক বানান হওয়া উচিত ‘মাদ্রাসা’। কারণ এটি একটি আরবী শব্দ। ঠিক এইরকমভাবে বর্তমান বাংলাদেশে ৬ ধরণের/রকমের মাদ্রাসা আছে,
১. আলিয়া মাদ্রাসা
২. কওমী মাদ্রাসা
৩. নুরানি মক্তব
৪. ফোরকানিয়া মাদ্রাসা
৫. কারিয়ানা মাদ্রাসা
৬. হাফেজি মাদ্রাসা
এর বাইরেও একাধিক মাদ্রাসা বিদ্যমান থাকতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া বাকি সবগুলো স্ট্রিমিং একাধিক ইসলামিক গোষ্ঠী/দল অথবা ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিচালিত হয়ে থাকে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মহানবী (সাঃ) এর সময়ে মক্কার সাফা পাহাড়ের নিচে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। সময়কাল ৬১৪ খ্রিষ্টাব্দ এবং ঐ মাদ্রাসার নাম ছিলো “দারুল আরকাম (বাংলাদেশেও মাদ্রাসার নামের পূর্বে ‘দারুল’ শব্দ ব্যবহার করতে দেখবেন। যার অর্থ হচ্ছে, ‘বাড়ি/আবাস’, আর ‘দারুল উলুম’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘জ্ঞানালয়’)”।
ভারতীয় উপমহাদেশে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতায় ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে। নাম হচ্ছে, ‘কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা’ বা ‘মাদ্রাসা-ই-আলিয়া’, প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি সে-ই সময়কার বাংলার গভর্ণর জেনারেল ছিলেন।
কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অনেক অনেক অর্জন। কিন্তু মাদ্রাসা বলতে আমাদের মধ্যে একধরণের কৃপণতা আছে যে, কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা আদর্শ বা ব্যতিক্রম আর বাকিগুলো যা তা... যাকগে, ভারতীয় উপমহাদেশে মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্রদের খুবই সংক্ষিপ্ত তালিকা,
১. মাওলানা আবুল কালাম আজাদ: তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন।
২. মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর: তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন।
৩. মাওলানা আকরাম খাঁ: তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন।
৪. মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী: তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন।
৬. মাওলানা আতাউর রহমান খান: তিনি কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন।
৭. হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী: তিনি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবন শুরু করেন।
৮. বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম: বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন। তিনি তাঁর শৈশবে গ্রামের মক্তবে (মাদ্রাসা) পড়াশোনা করেন এবং সেখানে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হোন। এছাড়া, তিনি মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজও করতেন, যা তাঁর ধর্মীয় শিক্ষার অংশ ছিলো।
৯. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্: ছোটবেলায় মক্তবে (মাদ্রাসা) পড়াশোনা শুরু করেন, যেখানে তিনি উর্দু, ফারসি ও আরবি ভাষা শিখেছিলেন।
‘মাওলা’ মানে হচ্ছে ‘শিক্ষক/গুরু’ এবং ‘মাওলানা’০ মানে হচ্ছে, যিনি ধর্ম সংক্রান্ত ভালো জ্ঞান রাখেন। এবার আপনি যদি বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে যান অথবা, ভারতের ইতিহাস লিখতে চান মাওলানারা কিন্তু থাকছেই। আমি না চাইলেও থাকছেন, আপনি না চাইলেও থাকবেন।
কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার আদলে/মডেলে বাংলাদেশের কর্ণারে কর্ণারে নির্মিত/প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একাধিক আলিয়া মাদ্রাসা। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়েও অনেক পুরনো মাদ্রাসা এখানে রয়েছে। ১৮৭৩ সালে মহসিন ট্রাস্টের উদ্যোগে মোট ৩টি মাদ্রাসা এই এলাকায় মানে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়,
১. ঢাকা মাদ্রাসা (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা ও ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা)
২. চট্টগ্রাম মাদ্রাসা (বর্তমানে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম)
৩. রাজশাহী মাদ্রাসা (বর্তমানে হাজী মুহম্মদ মুহসীন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, রাজশাহী)
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশে উপস্থিত হবার পূর্বে থেকেই মাদ্রাসার অস্তিত্ব ছিলো। কারণ বাংলাদেশে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো ১ জুলাই ১৯২১ সালে। তাহলে এর আগে অন্তত পূর্ব বাংলায় শিক্ষা ব্যবস্থা কি ছিলো? শিক্ষার জন্য কি প্রতিষ্ঠান ছিলো? প্রধান শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো মক্তব ও মাদ্রাসা (মুসলিম সমাজ) এবং টোল ও পাঠশালা (হিন্দু সমাজ)।
আরো যদি পেছনে যাওয়া যায় তাহলে গুরুগৃহ শিক্ষা পাওয়া যায়। সেই হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব ভারতীয় উপমহাদেশে মাদ্রাসার বয়সের তুলনায় বাচ্চা। পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বয়স হিসেবে মাদ্রাসার সামনে শিশু পর্যায়ে।
কিন্তু এত পুরাতন শিক্ষা-ব্যবস্থার এই নাজেহাল অবস্থা কেন?
১. সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ: কোন পরিবারে দুটো বাচ্চা যদি থাকে তাহলে যে বাচ্চার মেধা তূলনামূলক কম তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করানোর মনোভাব। এখানে মুসিবত হলো, মাদ্রাসার শিক্ষা-ব্যবস্থা বর্তমান গতানুগতিক ধারার শিক্ষা-ব্যবস্থার চেয়ে কয়েকগুণ কঠিন। আরবী ভাষা এবং ব্যকরণ আয়ত্ত্ব করা খুবই কঠিন। আরো সহজ করে বলা যায়, আরবী ভাষা ও ব্যকরণ আয়ত্ত্ব করতে যার জন্য একদিন লাগবে গতানুগতিক ধারার শিক্ষা-ব্যবস্থার ইংরেজি ভাষা ও ব্যকরণ তার জন্য ব্রেকফাস্ট। অন্তত খাতাগুলো যদি ‘জিপিএ ফাইভ’ স্টাইল না হয়ে যায়।
২. রাষ্ট্রীয় নেতিবাচক মূল্যায়ন: সরকার কর্তৃক আলিয়া মাদ্রাসাগুলোর ব্যবস্থাপনা এত বাজে যে, আমি শুরু কই থেকে করবো ঠিক জানিনা! ঘন ঘন সিলেবাসে ব্যাপক পরিবর্তন চলছে। এখন একই সাথে বাংলা, আরবী ও ইংরেজি তিনটে ভাষার দুটো পার্ট সিলেবাসে অন্তর্ভুক্তি আলিয়া মাদ্রাসায়। শিক্ষক সংকট, শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন এখানে চরমে। যে ক’জন শিক্ষকবৃন্দ মাদ্রাসায় আছেন তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন এই বিশাল সিলেবাস কাভার দিতে। ফলে বর্তমান মাদ্রাসা বোর্ড খাতায় নাম্বারিং করছেন অনেক ভিন্নভাবে। মোটামুটি ভালো লিখলেই ‘জিপিএ ফাইভ’।
৩. অভিভাবকহীন মাদ্রাসা: আলিয়া মাদ্রাসা ছাড়া বাংলাদেশে বাকী স্ট্রিমিং এখানে কেউ পর্যবেক্ষণ করেন না। তাদের জন্য কোনরুপ বাজেটও বরাদ্দ থাকে না। এই বাচ্চাগুলো আক্ষরিকভাবে একধরণের ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নেয়। অধিকাংশ এতিম বা খুবই দরিদ্র। এখন এই সংকটে বড় হওয়া একজন ব্যক্তি যখন আলেম হবেন, ইসলামিক বক্তা হবেন তার আত্ম-সম্মান তো আর রাখেন নাই! কি উপহার দেবেন তিনি?
৪. মেধাহীনদের হাতে ঐশী গ্রন্থ: প্রথমেই নিজের মেধাহীন বা একটু প্রতিবন্ধী সন্তানকে মাদ্রাসায় দিচ্ছেন। এর উপর এখন আরবী ভাষার মত জটিল ভাষা ও ব্যকরণ তাকে জোর-জবরদস্তি পড়াচ্ছেন। প্রশ্ন আপনার কাছে, আপনার সন্তান পবিত্র আল-কোরআন কতটুকু সুন্দর ব্যাখ্যা দিতে পারবেন? বা অদৌ কি পারবেন? পারলে কতটুকু পারবেন?
৫. ‘Self' ও ‘Othering’ করে রাখা: মাদ্রাসার শিক্ষক! তিনি কিছুই জানেন না, বুঝেন না। মাদ্রাসার শিক্ষক আবার শিক্ষক নাকি! জেনারেলের মানে ইংরেজির শিক্ষক হলে তাও হত। এই শিক্ষকবৃন্দ ধীরে ধীরে সম্মান তো পাছেন-ই না তার উপর তিনি বা তাঁরা ‘Extremist (উগ্রবাদী/মৌলবাদী)’ ট্যাগিং পাচ্ছেন। আর ছাত্ররা মানে আমরা কোথাও কোন জায়গা খুঁজে পাই না! সবখানে আমাদের ভিন্নচোখে দেখা হয়। একবার যদি কোন নির্দিষ্ট মহল জানতে পারে আপনি মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের তাইলে হতেও পারে আপনি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এবং তালেবান ট্যাগিং পাবেন একদম ফ্রি-তে!
একধরণের ভিক্ষাবৃত্তি করে যাকে ‘ঈমাম (নেতা)’ বানাচ্ছেন তিনি চাইলেও কি নেতৃত্ব দিতে পারবেন? তার আত্ম-সম্মান নিয়ে যে খেলাটা খেলেই যাচ্ছেন সেটা কি যৌক্তিক? কোনোভাবেই কি মানবিক? ঈমাম ও মুয়াজ্জিন হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাত পাতছেন, এমন সমাজ এই বাংলা দেখতে চেয়েছিলো বা চায়? আর মাইনে! সে-তো আরেক সার্কাস।
এখন ভুল মানুষের কাছে চলে গেছে আপনার কিতাব। পবিত্র আল-কোরআন ব্যাখ্যায় ভুল করবে না কেন? তার তো এ বিষয়ে পড়াশোনাই নাই! এখানে মোড়ে মোড়ে ফতোয়া দাঁড়িয়ে আছে। পালন তো কেউ করছেন-ই না, করবেন-ও না, কিন্তু যার-যার তার-তার মত ফতোয়া দেওয়া শুরু কইরেন না; খুবই বিশ্রী লাগে।
একজন দাখিল পাশ ও মাদ্রাসার ছাত্র হিসেবে অনুরোধ করে বলছি, মূর্খদের হাতে যা-ই পড়ুক, হোক সেটা পবিত্র আলো-কোরআন, বাইবেল বা বেদ, ভুল ব্যাখ্যা আসবে ফর শিওর!
ছবি: Bing Enterprise (Copilot Ai)
Also Read It On: বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ২:৫৫