
আমি যে মূর্খ তা বুঝবো কি করে? অথবা, আপনি যে শিক্ষিত তা জানবেন কার কাছ থেকে? শিক্ষিত বা মূর্খ হওয়াটা বস্তুত আপেক্ষিক। আমি আপনার থেকে যে দু’লাইন কম জানি সেক্ষেত্রে হতে পারে আমি আপনার চেয়ে কম শিক্ষিত বা মূর্খ। কিন্তু আদতে আমি কতটুকু মূর্খ বা শিক্ষিত তার আদর্শ কোনোপ্রকার মাপকাঠি নাই। বরং একাডেমিক পুস্তকের তথ্য ভর্তি মানুষরা মানে আমরা যে সুচারুভাবে আমাদের মধ্যেই পার্থক্য তৈরি করে থাকি সেটাই হলো চরম মূর্খতা।
আমাদের ধারণা পার্থিব বিষয়ে চলমান ও আদর্শিক কিতাব পঠনে এবং একাধিক সার্টিফিকেট অর্জনের মধ্যে শিক্ষা ও শিক্ষিত হওয়ার বিষয়টি নিহিত; যা ভুল। বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা এবং উক্ত বিষয়ে উঁচু মানের সার্টিফিকেট অর্জন আমাদের উক্ত প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষিত হয়েছেন বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু ঐ শিক্ষা যদি ঐ রাষ্ট্রের প্রায়োগিক কোনো কাজে না আসে তাহলে সেটা একসময় অনর্থক, অথর্ব ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ সার্টিফিকেট ধারী শিক্ষিত মানুষদের কে শুধু ‘Unemployed (বেকার)’ বললে ভুল হবে। আমাদেরকে বলা উচিত ‘Unemployable (নিয়োগ-অযোগ্য)’। আমি শব্দটি আবারো লিখছি, ‘Unemployable (নিয়োগ-অযোগ্য)’। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারে থাকার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলে পড়াশোনারত এক শিক্ষার্থী বিবিসিকে জানান, তাঁর হাতে ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (BCS)’ ছাড়া চাকুরীর আর বিশেষ কোনো উৎস নাই। মানে জীবন ও জীবীকার জন্য তাঁর কাছে ভূগোলে পড়াশোনা করে দেশের সর্বোচ্চ বা প্রধান বিদ্যাপীঠ থেকে বিসিএস ছাড়া আর বিশেষ কোনো রাস্তা তেমনভাবে খোলা নাই। উপস্থাপিকা প্রশ্ন রেখেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বিসিএসের বই নিয়ে এত ভীড় কেন?
বিষয়ভিত্তিক এই পড়াশোনা অনেকের মতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের স্বার্থ কায়েম করে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এনজিও’রা মিলে নির্ধারণ করে আমাদের সিলেবাসে কী কী বিষয় পড়ানো হবে? বা পড়ানো যেতে পারে। কিন্তু কৌতুহল থেকেই যায় যে, আমাদের পূর্নাঙ্গ সিলেবাস কি শুধু এই সমস্ত অনুঘটক ঠিক করেন? আমাদের নিজেদের জন্য কি সামান্যতম স্পেসও থাকে না! নিশ্চয় থাকে কিন্তু সেসব অংশেও ব্যক্তি স্বার্থ সামনে নিয়ে আসা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকার কথা যদি মেনে নিই, তবে, যদি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি হোন একজন স্বৈরাচার তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১,৮০০+ শিক্ষক-শিক্ষিকা হলেন একেকজন দানবাকৃতির স্বৈরাচার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মজার একটি তথ্য হচ্ছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেও আপনি জানবেন না ‘রাজশাহী’ শহরের নাম ‘রাজশাহী’ কে? কখন? কবে রেখেছিলেন বা করেছিলেন? ভর্তির সময়ের ‘Prospectus' ক্লাসের চাপে বই আর নোটের এক কোণায় জায়গা করে নেয় এবং নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য নিজেকে আলাদা করে পড়াশোনা করা জরুরী হয়ে পড়ে। তাই আমি ধরে নিতে পারি, আমাদের বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ঠিক ক্যামন।
সিলেবাস দেখে স্বাভাবিকভাবে একজন শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন আসে, আমি এসব তো পড়বো কিন্তু কেন পড়বো? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সব শ্রেনীর পরিবারের ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করেন। বিশাল প্রতিযোগীতায় সাফল্যের পর মিলে যায় একটি সিট। এরপর দুর্দান্ত সিজিপিএ অর্জন পূর্বক যে প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থী কর্মরত হোন তার বেতন কাঠামো তাকে শুধু ভাবায় না, হতাশ করে তোলে। কথায় আছে, দারিদ্রতার সামনে ধর্মের কথা বলা হলো সবচেয়ে বড় অধর্মের কাজ; হোক সেটা মনুষ্য ধর্ম বা ‘মানুষ’ হবার গলাবাজি। উল্লেখ্য, আমার মত ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থীর কথা কিন্তু আমি বলছি না। আমরা এমনিতেও সব পড়ি না। আমি ক্লাসের/ব্যাচের টপারদের কথা বলছি।
ক্লাস টেন টেনেটুনে পাশ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে লেবার-ড্রাইভিং-ইলেক্ট্রিশিয়ান ইত্যাদি পেশায় গড় উপার্জন করেন একজন ব্যক্তি ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। আজকের ঢাকায় একজন রিক্সাওয়ালা মাসে উপার্জন করেন অন্তত ৩০ হাজার টাকা। বগুড়া শহরের মোটামুটি ভালো জায়গায় একজন চা বিক্রেতার দিনে উপার্জন হয় ১০ হাজারেরও বেশি টাকা। অথচ একজন অনার্স-মাস্টার্স সম্পূর্ণ করে জবে ঢুকলে তার প্রাথমিক বেতম কাঠামো ২৫-৩৫ হাজার টাকা সর্বোচ্চ।
তিনি ভেবে পান না, নতুন যে শহরে পা রাখলেন সেখানের বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, ওয়াই-ফাই বিল, খালা বিল, হাত-খরচ ও বাজার শেষে নিজের জন্য একটি শার্ট/জামা কীভাবে ক্রয় করবেন? বন্ধুকে ধার দিয়ে একটু সাহায্য কীভাবে করবেন? গাড়ি-বাড়ি এসব আরেক বিলাসিতার নাম। শুধুমাত্র পদের নাম দিয়ে সবার পেট চলে না, এই পদ-ই যেন তার গলার কাঁটা ও অযোক্তিক।
এরপর আমাদের সাথে পরিচয় ঘটে এক নির্লজ্জ ও নির্লিপ্ত কমিশন ‘বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন (PSC)’ -এর। এই কমিশন সব সরকারের সময়েই কমবেশি প্রশ্নপত্র ফাঁস করেই চলেছে। সর্বশেষ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময় একটি চাঞ্চল্যকর রিপোর্টে আমরা জানতে পারি পিএসসি তার লক্ষ্মণ রেখা পর্যন্ত পার করে দিয়েছে। গত ৪৬তম বিসিএসে শুধুমাত্র এক বিল্ডিংয়ে ১ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগেই প্রশ্নপত্র পেয়ে গেছিলেন। সকল সেট। গল্প এখানেই শেষ নয়, এরপর আমরা দেখতে পাই, উপরমহলের কিছু লর্ডদের সুপারিশে একাধিক ব্যক্তি চাকুরী পেয়েছেন। কেউ কেউ তো মেয়ের যৌতুক হিসেবে দিয়েছেন বিসিএসের প্রশ্নপত্র। পরিস্থিতি দেখে মনে হতে লাগলো, বিসিএস হলো এদের বাপ-দাদার সম্পত্তি। আমরা রোহিঙ্গা।
গত ৩৩তম, ৩৪তম, ৪৬তম বিসিএসের প্রশ্নফাঁস কেলেঙ্কারির কথা সবাই কমবেশি জানেন। এছাড়াও একাধিক চাকুরী পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে সকল ধরণের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একরকম ভীতি ঢুকে গেছে। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জীবন-যৌবন শ্যাষ কইরা মাথায় টাক নিয়া ৩০ বছর বয়স পার করে সমাজের কাছে হয়ে গেছেন অপ্রাসঙ্গিক ও অবান্তর। জানা যায়, বিএনপি সরকারের সময়েও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছিলো। মিলেনি যথাযথ ন্যায়! আজ তারা একেকজন দেশের সচিবালয় পর্যায়ে জমিদারের ভূমিকা পালন করছেন।
পূর্বের ও পরের যতগুলো পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে এবং সে-ই প্রশ্নপত্র দিয়ে যাদের চাকুরী হয়েছে এসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত গঠন করা হলো না কোনোপ্রকার তদন্ত কমিটি। উল্টো, পিএসসি’র আত্মপক্ষ সমর্থন করা দেখে দেশের শিক্ষার্থী তো বটেই, যুবসমাজেরও হাসি পাচ্ছে। আর কতটা লজ্জা দিলে পিএসসি একটি কমিশন হিসেবে লজ্জিত হবেন? আর কতবার বললে সকল প্রকার প্রশ্নফাঁসের বদৌলতে চাকুরী পাওয়া দের চাকুরী থেকে বরখাস্ত করবেন? আর কতবার আন্দোলন করলে সুপারিশে চাকুরী দেওয়া বন্ধ হবে? এতগুলো লাশও কি আপনাদের জন্য যথেষ্ট নহে!
আরেক পক্ষ আছেন, যারা চাকুরীর ক্ষেত্রে ‘Gen - Z' দের সেফগার্ড করার কথা ভাবছেন, এবং এতে করে বয়েস বাড়ানো তাদের জন্য হুমকীর হতে পারে। এই চিন্তা মন্দ নয়। কারণ ‘Gen – Z’ -ই এই আন্দোলনের মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এই চিন্তার ধরণ মোটেই যুগোপযোগী নয়। প্রথম কারণ হচ্ছে, ‘Gen – Z’ ও তাঁদের সমর্থক (আমরা) বৈষম্য চান না। আবার বয়সের মানদণ্ড পাকিস্তানের মত করে নিজেদের চাকুরী সেফগার্ড করছেন; পুরো স্ববিরোধী কান্ড-কারখানা। দ্বিতীয় কারণ হলো, যারা যারা বিসিএসে প্রশ্নফাঁসের কারণে সিট দখল করেছেন এদেরকে খেদিয়ে দিতে হবে বিনাশর্তে। তাহলে বয়েস যদি বেশিও করা হয় সেক্ষেত্রে আপনাদের টাক মাথাওয়ালা বড় ভাইয়ের সিট নিয়ে তো সমস্যা হবার কথা নয়! সিট ফাঁকা হবেই, তবে সেটাও হতে হবে নায্যভাবে।
তৃতীয় কারণ হলো, বয়সসীমা শেষ কবে সেটা নিয়ে ব্যাপক দ্বন্দ্ব। ঠিকাছে, এটা না-হয় সেটাই রাখলেন। কিচ্ছু আসে বা যায় না। চতুর্থ কারণ হলো, আন্দোলন ও সরকার পতনের ফলে বেশকিছু সময় কিন্তু আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে এমনিতেও আপনাকে ১-১.৫ বছরের একটি লিভারেজ দিতে হবেই।
আপনাদের প্রাণভরে দোয়া কিন্তু এই বিপ্লবের অংশীদারীত্বের এমন ভাগাভাগি কইরেন না। শুধু নিজেকে নিয়ে আপনাদের ভাবলে চলবে না। এখন আপনাদের দায়িত্ব আরো বেশি এবং আপনাদের ভূমিকা আরো জরুরী। আপনাদের এখন শুধু বয়স নয়, মেধাহীন এই লর্ডদের গদি ছাড়াতে না পারলে বিপ্লব (আমাদের অর্থে) অপূর্ণ থেকে যাবে। একবার একটি সুষ্ঠু তদন্ত কমিটি গঠন করুন, দেখবেন প্রতিটি সেক্টরে অসংখ্য সিট এমনিতেই ফাঁকা পাওয়া যাবে।
আর সিলেবাস বা ছিলেবাঁশের পরিবর্তন না-হয় একটু আস্তেধীরে করলেন! এত এত সংস্কারে সময় লাগবে, বুঝে আসে, কিন্তু ততদিন তো না খেয়ে থাকলে চলবে না!
ছবি: FreePik Ai

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


