somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মি. বিকেল
আমি মেহেদি হাসান, মি. বিকেল নামে পরিচিত। আমি একজন লেখক, অভিনেতা, সমাজকর্মী, রেডিও জকি, ওয়েব ও অ্যাপ ডেভেলপার, সম্পাদক, উপস্থাপক, রক্তদাতা, এবং নাট্য পরিচালক। মাইক্রোসফটে ডেভেলপার হিসেবে কর্মরত এবং গল্প বলা আমার প্রধান পরিচয়।

ছায়া রাষ্ট্র থেকে গভীর রাষ্ট্র: ক্ষমতার অদৃশ্য জালের রাজনীতি

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ২:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বিশ্ব রাজনীতির গুঞ্জন-গহ্বরে আজ সবচেয়ে আলোচিত শব্দগুলোর মধ্যে একটি হলো ‘ডিপ স্টেট’ বা ‘গভীর রাষ্ট্র’। এটি শুধু একটি তত্ত্ব নয়, বরং একটি জটিল বাস্তবতা যা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মেরুদণ্ডে লুকিয়ে থাকা ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে উন্মোচিত করে। চলুন এই ধারণার উৎস, বিবর্তন ও বৈশ্বিক প্রভাবকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করা যাক।

‘ডিপ স্টেট’ শব্দের জন্ম তুরস্কের রাজনৈতিক পরিভাষা ‘ডেরিন ডেভলেট’ (Derin Devlet) থেকে, যার আক্ষরিক অর্থ ‘গভীর রাষ্ট্র’। ১৯২৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক গঠনের সময়ই এর বীজ রোপিত হয়। সেক্যুলার রাষ্ট্র কাঠামো রক্ষার নামে সামরিক-গোয়েন্দা জোট, আমলাতন্ত্র ও বিচারব্যবস্থার মধ্যে একটি সমান্তরাল ক্ষমতা কাঠামো গড়ে ওঠে, যা নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতো।

১৯৭০-এ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ট এচেভিত প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে এর অস্তিত্ব স্বীকার করেন। ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একে ‘রাষ্ট্রের ক্যান্সার’ আখ্যা দিয়ে গোপন নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু এই ধারণা ইতিমধ্যে বৈশ্বিক রাজনীতির শব্দভাণ্ডারে জায়গা করে নিয়েছে।

তরুণ তুর্কীদের ভূমিকা (১৯০৮): সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদকে ক্ষমতাচ্যুত করে তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের ভিতরে একটি অদৃশ্য শক্তিকাঠামো তৈরি করে, যা পরবর্তীতে গভীর রাষ্ট্রের প্রোটোটাইপ হিসেবে কাজ করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সংকট: অটোমান পরাজয়ের পর ব্রিটিশ-ফরাসি দখলদারিত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ মোকাবিলায় গোপন সামরিক জোট গঠিত হয়, যা ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার নামে বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনে সক্রিয় হয়।

ডিপ স্টেটের বৈশিষ্ট্য: কীভাবে কাজ করে এই অদৃশ্য শক্তি?

১. সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা: নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাইরে সামরিক গোয়েন্দা, উচ্চপদস্থ আমলা ও কর্পোরেট লবির সমন্বয়ে গঠিত নেটওয়ার্ক।
২. গোপন অপারেশন: সাইবার যুদ্ধ, মিডিয়া ম্যানিপুলেশন, অর্থনৈতিক চাপ এমনকি সাংবিধানিক সংকট তৈরি করে জনমতকে প্রভাবিত করা।
৩. জাতীয় নিরাপত্তার ফাঁদ: দেশরক্ষার অজুহাতে গণনিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস।
৪. আন্তর্জাতিক সংযোগ: বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে সার্বভৌম নীতিতে হস্তক্ষেপ।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: ডিপ স্টেটের বহুরূপী চরিত্র

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র: সিআইএ, এফবিআই, পেন্টাগন ও ওয়াল স্ট্রিটের জটিল জোটকে ট্রাম্প ‘ডিপ স্টেট’ আখ্যা দেন। এখানে শিল্প-সামরিক কমপ্লেক্স (Military-Industrial Complex) সরাসরি পররাষ্ট্রনীতি প্রভাবিত করে।
পাকিস্তান: ‘Establishment’ নামে পরিচিত সামরিক-গোয়েন্দা জোটের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত।
রাশিয়া: সিলোভিকি (শাসক অভিজাত গোষ্ঠী) এবং এফএসবি'র প্রভাব ক্রেমলিনের সিদ্ধান্তে মুখ্য।
লাতিন আমেরিকা: ২০শ শতাব্দীতে অপারেশন কন্ডরের মাধ্যমে সিআইএ-সমর্থিত ডিক্টেটরশিপ স্থাপন।

বিতর্ক ও সমালোচনা: কল্পনা বনাম বাস্তবতা

ডিপ স্টেট ধারণা প্রায়ই ‘কনস্পিরেসি থিওরি’ হিসেবে সমালোচিত হয়। তবে এর সমর্থকরা যুক্তি দেখান:

১. ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ার হ্যাকিং কেলেঙ্কারি ও ট্রাম্প-রাশিয়া কোল্যুশন তদন্তে এফবিআই’র ভূমিকা।
২. বাংলাদেশে ২০০৬-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংকটে গোপন সামরিক-নাগরিক জোট ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’র অভিযোগ।
৩. ভারতের ‘ডিপ স্টেট’ নিয়ে বিতর্কে সংযুক্ত হয় রবি রিকশে কেলেঙ্কারি, পেগাসাস স্পাইওয়্যার কেলেঙ্কারি।

বাংলাদেশ প্রসঙ্গ: অভিযোগ ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

১. ২০২৩ সালের মার্কিন নিষেধাজ্ঞা: শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ইউএসএআইডির মাধ্যমে ‘গণতন্ত্রবিরোধী’ কার্যক্রমের অভিযোগ। ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ট্রান্সজেন্ডার অধিকার সংগঠনগুলোর তহবিল বন্ধের সিদ্ধান্ত আলোচনায় আসে।
২. ভারত-মার্কিন চুক্তির প্রভাব: মোদী-ট্রাম্প বৈঠকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচনা, যা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি দ্বারা নিশ্চিত হয়েছে।
৩. গণমাধ্যমের ভূমিকা: কিছু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীর মতে, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া কখনো কখনো ‘ন্যারেটিভ ওয়ার’ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে প্রভাবিত করে।

ডিজিটাল যুগের ডিপ স্টেট: AI, সোশ্যাল মিডিয়া ও ডেটা হেজিমনি

ফেসবুক-টুইটার অ্যালগরিদম: রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক কন্টেন্ট প্রচারে ভূমিকা (২০২০ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন)।
চীনের সামাজিক ক্রেডিট সিস্টেম: নাগরিকদের রেটিংয়ের মাধ্যমে সমাজে নিয়ন্ত্রণ।
পেগাসাস স্পাইওয়্যার: ভারত-মেক্সিকোসহ ৫০টি দেশে সাংবাদিক-আন্দোলনকারীদের টার্গেট করা।

নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ: ডিপ স্টেটের নতুন হাতিয়ার

ইলেকটোরাল কলেজ প্রভাব: যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ নির্বাচনে জয়-পরাজয় নিয়ে ট্রাম্পপন্থীদের বিতর্ক।
ইভিএম হ্যাকিং উদ্বেগ: বাংলাদেশ ও ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং যন্ত্রের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন।

ডিপ স্টেট গণতন্ত্রের জন্য হুমকি নাকি রক্ষাকবচ?

ডিপ স্টেট ধারণার দ্বৈততা অস্বীকার করা যায় না। একদিকে এটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে পারে, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা নষ্ট করে। বর্তমানে ডিজিটাল নজরদারি ও তথ্যযুদ্ধের যুগে এর প্রভাব আরো সূক্ষ্ম ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এই অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে সচেতন নাগরিকত্ব, স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া গণতন্ত্র টিকবে না।

পরিশেষে, ডিপ স্টেট কেবল একটি ‘তত্ত্ব’ নয়—এটি ক্ষমতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে থাকা একটি ব্যবস্থা, যা বুঝতে হলে ইতিহাসের গভীরে ডুব দিতে হবে এবং বর্তমানের ডেটা-প্রযুক্তির জটিল জালকে বিশ্লেষণ করতে হবে।

Also Read It On: ডিপ স্টেট: আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অদৃশ্য শক্তি
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ২:১০
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মানুষের টাকা দিয়ে ইসলামি ব্যাংকগুলো কি জুয়া খেলে?

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:০৫



ইসলামি শরিয়া ভিত্তিক দেশের পাঁচ পাঁচটি ইসলামি ব্যাংকের আজ বেহাল দশা, তারা গ্রাহকের টাকা ফেরৎ দিতে পারছে না। সবগুলো ব্যাংকই এখন দেউলিয়ার পথে, বাধ্য হয়ে সরকার এই পাঁচ... ...বাকিটুকু পড়ুন

বি ডি আর বিদ্রোহ ও পিলখান হত্যাকান্ডের কিছু অপ্রাকাশিত সত্যঃ (পর্ব ০২)

লিখেছেন মেহেদী আনোয়ার, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৪৭

বিডিআর এর ডিজি নিহত হয় সকাল সাড়ে দশটায়। ভারতীয় টিভি চ্যানেল 'চব্বিশ ঘন্টা' বিস্ময়করভাবে অতি অল্পসময়ের মধ্যে বিডিআর ডিজি ও তার স্ত্রী নিহত হবার সংবাদপ্রচার করে সকাল এগারটায়। ভারতের আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মানুষ মানুষকে কীভাবে এত অপদস্ত করে এই ব্লগে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৪

আমি তো কারও সাতেও নাই পাঁচেও নাই। এত সময়ও নাই মানুষকে ঘাঁটার। ব্লগের ব্লগারদের সম্পর্কেও তেমন কিছু জানি না। তবে পোস্ট পড়ে কিছুটা আন্দাজ করা যায় -কে কী রকম। আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগ কি শিখিয়েছে?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:০৬






অপমান, অপদস্থ থেকে বাঁচার উপায় শিখাইনি? ওস্তাদ মগা শ্যামী পাহাড়ে বসেও এসবের সমাধান করতে পারে, আপনি সামান্য অসুস্থতার জন্যও ব্লগে মিলাদ দেননি, দোয়া করেছেন কার জন্য? খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৮

ওরা দেশের শত্রু; শত্রু দেশের মানুষেরও...

অন্তর্জাল থেকে নেওয়া সূর্যোদয়ের ছবিটি এআই দ্বারা উন্নত করা হয়েছে।

ইসলামের পবিত্র আলো ওদের চোখে যেন চিরন্তন গাত্রদাহের কারণ। এই মাটি আর মানুষের উন্নয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×