
মানুষকে ওলি-আউলিয়া/ভগবান চিন্তায় নেবেন না। দেশ পরিচালনার জন্য শুধু ডিগ্রী আর বিশাল সিভি-ই যথেষ্ট হয়তো নয়, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা প্রয়োজন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিএনপি বা ইউনূস সরকারের বিরোধীতা করতে কখনোই চাই নাই। তাদের বিরুদ্ধে লিখারও ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু নিজ ভুল স্বীকার না করাটাও এক ধরণের দাম্ভিকতা। আর এই বিষয়টিকে আমার মত অনেক মানুষই ঘৃণা করেন। আশা করি এই গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করার মত সহ্য ক্ষমতা আপনাদের মধ্যে আছে। আর মানুষ পারফেক্ট না, সব সময় তারা ‘Unchecked’ থেকে যেতে পারেন না।
১. তথ্য দেওয়া হচ্ছে হঠাৎ করে ১ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগুনের মত করে ছড়িয়ে পড়া এই তথ্যটি ভূয়া। একটি বড় সংখ্যক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটেছে গত বছরের মে-জুন মাসে। সেসময় ক্ষমতায় ছিলেন অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু শুধুমাত্র গত এপ্রিল মাসের ১ সপ্তাহে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে ১ হাজার ৪৪৮টি পরিবারের।
এ ছাড়া আলাদাভাবে এসেছে আরও ৫ হাজার ৯৩০ জন। এভাবে আজ পর্যন্ত প্রতিদিন ২০-৩০ জন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছেন। নতুন রোহিঙ্গা শরনার্থীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ১৩ লাখ ১৩ হাজারে! অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কূটনৈতিক চ্যানেল অন্তত ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে। এই ধরণের কূটনৈতিক প্রক্রিয়া বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ।
আমার সহজ প্রশ্ন, ১ লাখ ফেরত দিতে গিয়ে আরো ৩ লাখ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে কেন গ্রহণ করবে? আমরা এই ধরণের স্মার্ট ও ঘৃণিত গণহত্যার সহযোগী হতে চাই না। আমরা শান্তি চাই। আর শান্তি যদি রক্ত ছাড়া সম্ভব না হয় তাইলে রক্ত দিতে হবে।
এখানে বৈদেশিক ও দেশীয় সমস্ত চাপ উপেক্ষা করে দেশের কথা সবার আগে ভাবতে হত। গত ৭-৮ মাসে মায়ানমার সরকার হোক বা আরাকান আর্মি হোক এদের সাথে আমাদের নতুন বন্দোবস্ত কি? অথবা, যে সেনাবাহিনী প্রধান ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছেন তিনি রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেন নাই কেন? নাকি তারা নিজ জনগণের উপর গুলি চালাতেই বেশি সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন?
(তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা, সমকাল ও নেত্র নিউজ)
২. মানুষের নূন্যতম লজ্জা ও মানবিক মূল্যবোধ থাকে। একইসাথে যে নির্বাচন কে গণতন্ত্রের হত্যা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে কিন্তু ঐ একই নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে মোট দুইজন মেয়র পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন; হাস্যকর। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়।
আওয়ামীলীগ শাসনামলে এই নির্বাচন কে একটি ভূয়া নির্বাচন হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়ে থাকে। ঐ নির্বাচনে নির্বাচিত হোন ঢাকার উত্তরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম এবং দক্ষিণে ফজলে নূর তাপস। ঐ নির্বাচনের পাঁচ বছরের বেশি সময় পর আদালতের রায় মেনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নতুন মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।
মোটামুটি একইভাবে বিএনপি নেতা ড. শাহাদত হোসেন ৩ নভেম্বর ২০২৪ থেকে চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন, যা আদালতের রায়ের মাধ্যমে ঘোষিত হয়। প্রশ্ন হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিচারব্যবস্থার এত ব্যাপক সংষ্কার সাধন করেছেন যে, আপনি কি এখানে ন্যায়ের ছিটেফোঁটাও কি দেখতে পান? দুই বিএনপি নেতার ক্ষমতার যে দম্ভ সেটা কি এখানে স্পষ্ট নয়?
নতুন বিচারব্যবস্থার যে সংস্কার মানে যেখানে আইন সবার জন্য সমান সেখানে অভিজাতদের প্রতি আইন সমান হতে কেন আজও পারছে না? নাকি এটাই বাংলাদেশের চিরকালীন ভোগান্তির চিরস্থায়ী কারণ হিসেবে থেকে যাবে?
অথবা, নির্বাচন কমিশন সংষ্কার যদি এটাই হয় তাহলে ভবিষ্যতে ঐ নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছালো? কে কাকে ব্যর্থ করলো সেসব হিসাব দিতে আসবেন না, ওটার জাস্টিফিকেশানের দায়িত্ব নিজের কাছেই রাখুন।
(তথ্যসূত্র: ঐ নির্বাচনকালীন সময় ও বাংলাদেশের সকল সাধারণ মানুষ)
৩. বাংলাদেশের ভূ-খন্ডের মালিক হলো এদেশের সকল সাধারণ থেকে অসাধারণ নাগরিক। বাঙালী থেকে শুরু করে প্রায় সকল উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির। গত সময় অনির্বাচিত আওয়ামীলীগ সরকার অন্তত একটি প্রস্তাব জনগণের সামনে আনেন এবং আরেকটিকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হিসেবে চালিয়ে দেন। ভাঙা ক্যাসেটের মত করে আজও এই দুই বিষয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নাই।
(ক) প্রস্তাব: প্রতিবেশী দেশ ভারতকে স্পেশ্যাল ট্রানজিট সুবিধা প্রদান। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে চুক্তি করায় বাংলাদেশের ভূ-খন্ড ব্যবহারের মাধ্যমে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যে (সেভেন সিস্টার্স) পণ্য ও মালামাল পরিবহন করতে পারবে। এখানে সমস্যা ছিলো, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার নিয়ে। বাংলাদেশের জনগণ সেসময় ছাপ ছাপ জানিয়ে দেন তারা এই চুক্তির পক্ষে নন। এমনকি অভিযোগ আছে, পদ্মা সেতু তৈরি করা হয়েছে নিজ দেশের স্বার্থের চেয়ে প্রতিবেশীর স্বার্থ বিবেচনায়।
(খ) ষড়যন্ত্র তত্ত্ব: ২০২৩ সালে জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, “সেন্ট মার্টিন দ্বীপ লিজ দিলে ক্ষমতায় থাকতে অসুবিধা নেই।” মানে অনির্বাচিত হয়েও তিনি পুনরায় ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। কিন্তু ঐ বক্তব্যে তিনি স্পষ্ট করে বলেন নাই যে, এই ধরণের চুক্তি কে বা কারা করতে চেয়েছিলো! কেন-ই-বা এমন চুক্তি করলে শেখ হাসিনা সরকারকে ক্ষমতা নিয়ে ভাবতে হবে না?
কেউ কেউ ধারণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের কথা, কিন্তু প্রমাণিত হয় নাই।
৮ আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘদিন তারা এসব বিষয়ে নাক গলানো কে বিপজ্জনক মনে করেছেন। অন্তত আমার তাই মনে হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন মিয়ানমারের রাখাইনের রোহিঙ্গাদের জন্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে একটি হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ বা মানবিক করিডর দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়; বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এই তথ্য প্রকাশের পর মানবিক করিডর ইস্যুটি নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক চলছে।
সাম্প্রতিক সময়ে গাজায় জাতিসংঘের মানবিক করিডর দেখছেন? ঠিক ওরকম। একে-তো বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যায় ভুগছে তার উপর এই মানবিক করিডরও জাতিসংঘের অনুরোধে বাংলাদেশকেই দিতে হবে! কিন্তু কেন দিতে হবে? আমরা তো এই মানবিক সংকট তৈরি করি নাই? এতে কি লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বা মায়ানমার ফেরত নিতে প্রস্তুত? উত্তর কারোরই জানা নাই।
প্রশ্ন হলো, জুলাই বিপ্লব যেসব অন্যতম কারণে ঘটেছিলো আবার সেটাই যদি করতে হয় তাহলে জুলাই বিপ্লবে এতগুলো মানুষের প্রাণ দেবার প্রয়োজন ছিলো কি? যে যা চাচ্ছে দিয়ে দেন, ইলিশ দিয়ে শুরু করেছিলেন, এবার নিজ ভূখণ্ড-ও ছেড়ে দেন!
৪. চাইছিলাম ‘পেপ্যাল (PayPal)’, পাইলাম ‘স্টারলিংক (Starlink)’! জুলাই বিপ্লব কে কেন্দ্র করে একটি ডায়ালগ ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের কোণায় কোণায়। কি সেই ডায়ালগ বা অনুরোধ ছিলো! তীব্র গরমে ছাত্র আন্দোলন যখন হাসফাস করছিলো তখন মুগ্ধ নামে একজন ছেলে পানির বোতল বিলি করতে করতে বলেন, “পানি লাগবে, পানি?” ও কে হত্যা করা হয়। আজও যখন জুলাই বিপ্লব নিয়ে কথা বলেন তখন মনের একপাশে মুগ্ধের সেই কথা ভূতের মত করে ঘুরে বেড়াই। আফসোস হয়। একটি উজ্জ্বল ও প্রানবন্ত যুবকের এমন প্রস্থান দেখে।
আপনি কি জানেন তার কর্ম পরিচয় সম্পর্কে? তিনি একজন ফ্রিল্যান্সার ছিলেন। তার হত্যার পর বিষয়টি নিশ্চিত করে দুঃখ পর্যন্ত প্রকাশ করেন ‘Fiverr’ কোম্পানি। এখানে লেনদেন হয় ‘পেপ্যাল (PayPal)’ এর মাধ্যমে। শুধুমাত্র তার জন্যে হলেও এতদিনে পেপ্যাল বাংলাদেশে আসার কথা। যাতে করে অনলাইন জগতে যারা ফ্রিল্যান্সিং করছেন তাদের উপার্জিত টাকা নিজ পকেট পর্যন্ত পৌঁছাতে কোন ঝামেলা পোহাতে না হয়।
আপনি ঐ একই মালিকের স্টারলিংক দেশে আনতে পারেন, কিন্তু পেপ্যাল আনতে পারেন না। ট্রিলিয়ন পরিমাণ টাকা পেপ্যাল ছাড়াই গায়েব হয়েছে। তার ১০% টাকা আপনি ফেরত আনতে পারবেন না। তার উপর আপনার বক্তব্য হলো, “পেপ্যাল (PayPal) আসলে মানি লন্ডারিং বেড়ে যাবে!” মাফ চাই, দোয়াও চাই। আপনাদের কোন জবাব নাই!
আচ্ছা, মুগ্ধের গল্প বাদ দেন। আপনি নিশ্চয় জানেন ২০২৫ সালের বাংলাদেশের আইটি সেক্টর ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বাংলাদেশে আনতে পারে (তথ্যসূত্র: BIDA)। আমাদের রেমিট্যান্স কিন্তু খুব পছন্দের খাবার। কিন্তু ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এমন কি সংষ্কার হলো যা বলার মতো? বিশাল ভ্যাট+ট্যাক্স দিয়ে পকেটে যা আসে তা নিয়ে হতাশা আরো বাড়ছে আমাদের মধ্যে।
শুধু তাই নয়, আজ পর্যন্ত কোন সরকার আমাদের পরিচয় কার্ড প্রদান করেন নাই। দেশের জন্য যারা এতবড় অবদান রাখছেন কিন্তু রাষ্ট্র তাদেরকে চেনেই না বা চিনতে চায়-ই না।
৫. তীব্র বেকার সংকট নিরসনে স্যার আমাদের বারবার ‘Entrepreneurs’ মানে ‘উদ্যোক্তা’ হতে বলেন। কিন্তু কীভাবে আমরা এই উদ্যোক্তা হবো? মানে তাত্ত্বিক আলোচনা থেকে বের হয়ে একটু প্রাকটিকাল কথা বলুন। এটা ইউরোপ বা আমেরিকা না, এটা বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ২০২৩ সালে ২৫ লাখ ৫০ হাজার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে অন্তত ২৭ লাখে পৌঁছেছে (বিবিএস)। ১৫-২০ হাজার মাইনে এমন চাকুরীতেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলমান।
আমার জানা মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই পর্যন্ত সংষ্কার হচ্ছে সরকারি চাকুরীর নিয়োগের আবেদন এখন মাত্র ২০০ টাকা। চাকুরীর বয়সসীমা সর্বোচ্চ ৩২ বছর নায্য বলে মনে হয়। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অন্তত একটি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে পেরেছে? মানে জাপানীজ ভাষা শিখে জাপানে যাওয়ার সর্বশেষ তাত্ত্বিক আলোচনা ছাড়া?
আর যদি যেতেও পারি তবে দেশত্যাগ তো আগেও ভালো অপশন ছিলো! নতুন সংযোজন কি কি করলেন? ভিসা পাওয়া এখন দিল্লী না ঢাকা চলছে!
আচ্ছা, এক কাজ করুন, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে এমন কোন ঋণ দেন যে ঋণ নিয়ে সফল উদ্যোক্তা হয়ে ঋণের টাকা পরিশোধ করবো। তার আগে শর্ত থাকা যাবে না, ঝুঁকি নেবে গ্রামীণ ব্যাংক। ঋণ দেবেন? দিলে কত দেবেন? অল্প-বিস্তর দিলে তো আবার রাস্তার পাশে দাঁড়াতে হবে। তখন আবার বুলডোজার আক্রমণ করবেন।
ঢাকা শহরে রিক্সা-ওয়ালাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। এলিট এরিয়াতে যেতে কি সব লাগিয়ে রেখেছেন। আর নারী সংস্কার কমিশন দিয়ে ক্যাচাল লাগিয়ে রেখেছেন, বিভাজন ঘটাচ্ছেন দেশের মানুষদের মধ্যে।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পথ হারিয়েছে। যেতে হত গুলশান, গেছেন গুলিস্তানে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২৫ রাত ১২:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



