
আমি কখনো সামাজিক হতে চাই নাই। ইচ্ছেও হয় নাই। ‘সামাজিক’ হওয়া মানে হলো একটা ‘সমাজ’ -এর সমস্ত শর্ত পূরণ করে থাকতে হবে। এখানে নির্দিষ্ট সমাজের নির্দিষ্ট শর্ত আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। একটা অলিখিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়। বাকি জীবন যে সমাজেই থাকছেন সে সমাজের রীতিনীতি মেনে চলতে হয়। ‘সমাজ’ ও ‘সীমাবদ্ধতা’ শব্দ দুটো খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। একবার যদি আপনি নির্দিষ্ট সমাজের ঐ অলিখিত সাদা কাগজের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তাহলে ব্যক্তিগত ভালোলাগা ও পছন্দের বলি হওয়া সেখান থেকেই শুরু হয়। কখনো কখনো আপনার স্বপ্নেরও…
আমার মতে, সমাজ মানেই তো একটা গ্রুপ। এই গ্রুপ নির্দিষ্ট কিছু মানুষের সমন্বয়ে গঠিত হয়ে থাকে। তফাৎটা শুধু বৈশিষ্ট্যের। কেউ বিপদে পড়লে সমাজ এসে দাঁড়ায়। কেউ সংকটে পড়লে সমাজ ঐ সমস্যার সমাধান করে। কারো সাথে অন্যায় হলে সমাজ এসে তার বিচার করে। একদিক থেকে দেখলে আমিও হয়তো পুরোপুরি অসামাজিক হতে পারি নাই। আমাকে অন্তত চায়ের দোকানে দিনে একবার বসতেই হয়। চুপচাপ থাকি কিন্তু অজানা কারণেই কারো কারো সাথে সংলাপ ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু ‘সমাজ’ শব্দটি অনেক বড়; আমব্রেলা টার্ম। আমি অবশ্য ওদিকে যাচ্ছি না।
প্রশ্ন হলো, বর্তমানের সমাজ কেমন?
এককথায়, “বিভৎস ও অশ্লীল”। যেদিন থেকে আপনি সমাজ কে বেশি গুরুত্ব দিতে থাকবেন সেদিন থেকে সমাজ আপনার ঘাড়ে চড়ে ইচ্ছেমতো তার দাবীদাওয়া চাপাতে শুরু করবে। সমাজ খুঁজে খুঁজে বের করবে আপনার সমস্যাগুলো কি কি? আপনার দূর্বলতাগুলো কি কি? সমস্যা বা দূর্বলতা খুঁজে পেলে ওসব আবার অস্ত্র বানিয়ে আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করবে। মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, আমি বা আপনি কেউ-ই নই। আর সমাজ ওত পেতে থাকে এমন একটা সুযোগের।
বর্তমান সমাজের প্রধান সমস্যা হলো, ‘গীবত করা’। মানে আপনার পিছে পিঠে আপনার সম্পর্কে খারাপ ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে বেড়ানো। হিসেব মতে, আমার বিয়ের আগে আমার তথাকথিত গ্রাম সমাজ আমাকে অন্তত চারবার বিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি নিজে ‘পাত্র’ হয়েও তা জানতাম না। মানে এই সমস্ত তথাকথিত সমাজ ভুল তথ্য ছড়িয়ে থাকে। প্রশ্ন আপনার কাছেও, আপনার সমাজ আপনাকে বিয়ের আগে বা এ পর্যন্ত আপনাকে মোট ক'টা বিয়ে তারা নিজেই দিয়েছে? অন্তত ১টি তো হবেই, তাই না? বা, আপনার চরিত্র নিয়ে কতবার ভুল তথ্য ছড়িয়েছে?
এক দশক আগে এই সমাজ স্বর্গ ছিলো না। মানছি, স্বীকার করছি। তারও এক দশক আগেও এই সমাজ স্বর্গ ছিলো না। কিন্তু এরুপ জঘন্যও ছিলো না। কেন জানিনা এই সমাজের প্রশংসা করতে খুব কষ্ট হয়। নিজ কানে কোনো মানুষের সম্পর্কে সামান্য প্রশংসার বাণী এই সমাজ থেকে সর্বশেষ কবে পেয়েছি তা মনে পড়ছে না। উমুক খারাপ, তমুক খারাপ – এসব শুনতে শুনতে আমি বিরুক্ত। আজকাল যারা এই সার্টিফিকেট দিয়ে বেড়ান আমি তাদেরকে আবার ফিরতি সার্টিফিকেট দিই; ওদেরও এতে টাকা লাগে না আমারও এতে টাকা লাগে না। কিন্তু ওদের একটু হজম করতে মুশকিল হয়। কারণ বয়সে বড় হওয়া মানেই তাকে শ্রদ্ধা করতেই হবে। এখন তিনি যত বড়-ই চিটার, বাটপার বা আমার-আপনার ভাষায় ‘বেজন্মা’ হোক না কেন।
সমাজ তো প্রশংসা করা শেখেনি, ভালো কথা। কিন্তু এই সমাজ ঠিকই অবাস্তব প্রত্যাশা করা শিখেছে। অহেতুক তুলনা করা শিখেছে। গ্রামে সৌভাগ্যক্রমে একজন সরকারী চাকুরী পেয়ে গেলে তো হইছে ই! আপনাকেও এখন একটি সরকারী চাকুরী পেতে হবে। ভাগ্যক্রমে কেউ একজন বিসিএস ক্যাডার হলে আপনাকেও একজন বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। কেউ আর্থিকভাবে সফল হলে আপনাকেও তাই তাই হতে হবে… কিন্তু যারাও বা সফল হলো, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, আপনার সমাজ আপনার জন্য কি করেছে? আপনার সফলতার গল্পের পেছনে আপনার সমাজের অবদান কি? ‘শূন্য’, একটা বড়সড় শূন্য (০)। ক্ষেত্র বিশেষে মাইনাস (-) মার্কও পেতে পারে এই সমাজ।
কিন্তু তবুও আমাদের ‘সামাজিক’ হতে হবে। সবাইকে একসাথে মিলেমিশে থাকতে হবে। একা একা থাকে তো পাগল'রা, তাই না? একটু চুল লম্বা রাখলে, মেয়ে হয়ে পর্দা না করলে, সবার সামনে সিগারেট ধরালে – হঠাৎ করেই এই সমাজ নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। প্রশ্ন হলো, একটি পুরোপুরি ভাঙ্গাচোরা নষ্ট হওয়া সমাজকে নতুন করে কীভাবে পুনরায় নষ্ট করা যায়? একই জিনিস কে বারবার তো নষ্ট করা যায় না। মরা মানুষকে বারবার জীবিত করে ফের মৃত্যু দেওয়া যায় কি?
এই সমাজ ঠিকই অন্যের মেয়ের/ছেলের চরিত্র বিশ্লেষণ করা শিখেছে কিন্তু নিজ বাড়িতে ঘটে চলা পরকীয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চুপ; টু শব্দটাও তখন করে না। পাশের বাড়ির নিন্দা না করলে দিন কাটে না কিন্তু নিজ বাড়ির ব্যর্থতার কথা এই সমাজের মাথায় আসতেই চায় না। সর্বোপরি কৈফিয়ত দাবী করবে, কেন? কখন? কীভাবে? – যেন উত্তর দিতে না পারাটাও আমাদের একরকম ব্যর্থতা।
আমাদের শিক্ষক যিনি ১০ থেকে শুরু করে অন্তত ৪ বছর পড়িয়েছেন, তিনি আমাকে বা আমাদের নিয়ে আজও স্বপ্ন দেখেন। দোআ করেন। একটু দুই লাইন জানাশোনা হয়েছে বলে এখন নিজ চেয়ারে পর্যন্ত বসতে দেন। তিনি গিভ-আপ তো মোটেই করেন নাই। কিন্তু আমাদের সমাজ আমাদেরকে নিয়ে কতবার গিভ-আপ করলো তার হিসাব রাখাটা কঠিন। আমি তো ছোটবেলা থেকে শুনছি, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আজও আমার সমাজ তাই-ই মনে করেন। আপনার সমাজ আপনাকে কীভাবে দেখে? একবারও কি বলে নাই, আপনাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না? বহুবার আমরা শুনেছি। সমাজের দেয়া ব্যর্থতার ট্যাগ বহুবার কাঁধে উঠিয়েছি। সময় সময় আমাদেরই উচিত এমন সমাজ কে গিভ-আপ করা।
আপনি যখন ভীষণ চিন্তিত, চাকুরীর আবেদনের টাকাটাও নাই, কই সমাজ তো এসে বলে না, “এই নাও টাকা, দৌড়াও স্বপ্নের পেছনে।” কিন্তু নিজ টাকায়, নিজ পড়াশোনা ও শ্রমে যখনই একটা চাকুরী পেয়ে গেলেন সমাজ ঠিকই বলে, “কই আমার ভাগের মিষ্টি তো আমার ঘরে এলো না! তবে কি আমি এই সমাজের কেউ নই!” নও তো, তোমরা কেউ নও। না এই সমাজের, না আমার, না আমাদের। কারো নও। ব্যবসা শুরু করলে ১টাকাও পুঁজি এই সমাজ দেয় না, কিন্তু লস করলে আমার-আপনার ব্যর্থতার গল্প সবাইকে বলে বেড়ায়। আপনার অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে তখন হাসাহাসি করে, ঠাট্টা করে।
কারো বিয়ে প্রায় ঠিক হয়ে গেছে, সমাজ এসে তা ভেঙ্গে দেয়। দুইপক্ষের ভেতরে ক্যাচাল লাগায় ‘কাবিন বনাম যৌতুক’। সামান্য দুই ইঞ্চি জায়গা নিয়ে এখানে মানে গ্রাম সমাজে খুন খারাবি পর্যন্ত হয়, কোথাও আবার জল জমাট বাঁধে। কারণ এই সমাজ বিচার চায় না, ন্যায় চায় না, ঝামেলা কিন্তু ঠিকই চায়। আর এতে যদি কারো প্রাণ যায় তাহলে যাবে। কেউ নতুন দোকান দিলে বাকিতে চুবিয়ে এক ধরণের অর্থনৈতিক হত্যা নিয়মিত ঘটে।
এক কাপ চা এই সমাজ আপনাকে অফার করে না। করলেও তার মধ্যে লুকায়িত শর্ত থাকে। হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকলেও একবার এই সমাজ আপনাকে দেখতে যায় না। কারণ টাকা খরচ হবার ভয়। দেখা করা তো দূর, সামান্য খোঁজখবর পর্যন্ত কি এই সমাজ নেয়? খুব সম্ভবত নয়।
তাই আমি ‘অসামাজিক’ হওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি এই সমাজের শর্তে। আমারও অবশ্য একটা সমাজ আছে। তবে নির্বাচিত কিছু মানুষ। ওঁরা আমাকে গালি দিলেও আমি মাথা পেতে নিতে রাজী আছি। আমার এই সমাজ সংক্ষিপ্ত কিন্তু আমার মতে অনেক সুন্দর।
ছবি: VidIQ
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ১১:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


