somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনের খেরোখাতা

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




টিউশনের টাকা বাঁচিয়ে নিজের জন্য প্যান্ট কিনতে গিয়েছিল ছেলেটি। কিন্তু সে ভুল করে মেয়েদের প্যান্ট কিনে ফেলছে!

জিনিসটা যে মেয়েদের, এইটুকু বুঝার ক্ষমতাও সেই গাধাটার ছিল না!

রাত আটটার দিকে মেসে ফিরতেই ইরাজ তার স্বভাব মতো জামাটা আমার সামনে মেলে ধরে আনন্দিত স্বরে বলল,"এই যে দেখ, প্যান্ট কিনছি! জিনিসটা কেমন হয়েছে, বল তো দেখি?"

আমি খুব আগ্রহ নিয়ে হাত বাড়ালাম, কিন্তু প্যান্টের গড়ন আর বহর দেখে চমকে ফিরে তাকালাম ওর দিকে,"কার জন্যে কিনেছিস এই প্যান্ট?"

"নিজের জন্য।"

"ট্রায়াল দিয়ে দেখছিস, কেমন লাগে?"

"হা। বাসায় ফিরেই ট্রায়াল দিছি। ফিটিং সাইজ।"

"দোকানী কিছু বলে নি?"

ইরাজ বিরক্ত স্বরে বলল,"দোকানী কি বলছে, তা জেনে আমার দরকার কি? তোর কাছে কেমন লাগছে, সেইটা বল!"

"হালা গাধা, এইটা তো মেয়েদের প্যান্ট। তুই এইটা কী কিনছিস?"

ইরাজ প্রথমে আমার কথা বিশ্বাস করতে চাইল না।

কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের মধ্যেই বেচারীর চোখের দ্যুতি ম্লান হয়ে গেল। নিষ্প্রভ গলায় জানতে চাইল,"এখন কি তাইলে করি?"
"চল, পাল্টায়ে নিয়ে আসি।"
"পাল্টায়ে দিবে?"
"দিবে না মানে, ওর বাপ দিবে!"
"প্যান্ট কিন্তু চন্দ্রিমার ওপাশ থেকে কিনেছি। যেতে যেতে নয়টা বেজে যাবে।"
"বাজুক ৷ দোকান খোলা থাকে দশটা অবধি।"
"আচ্ছা, চল-।"

সমস্ত রাস্তায় ইরাজ মন খারাপ করে রইল। যদিও এত লজ্জা পাওয়ার কোন কারণ ওর ছিল না। কেননা, এইসব বিষয় নিয়ে আমি কখনো হাসি ঠাট্টা করি না, করব না।
তাছাড়া ইরাজ খুবই নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। ওর বাবা সামান্য বর্গা চাষী। মা নেই। বাসায় দুইটা ছোট বোন আছে ওরাই ঘরদুয়ার সামলায়। সময় সময় চাষের জমিতে গিয়ে বাবার সাথে ক্ষেতি-কাজ করে।

ইরাজ স্কুলে তো বটেই, মফস্বলের কলেজেও মাঝেমধ্যে লুঙ্গি পরে যেত বলে টিচার-ম্যামদের হেনস্তার শিকার হয়েছে, এই গল্প আমি জানি।

আমি ওর থেকে দুই বছর আগে ঢাকায় এসেছি বিধায়, কিছুটা স্মার্ট! তাছাড়া পকেটে পয়সা-কড়ি বেশি থাকলে ছেলেদের হেডাম আপনা থেকেই একটু গরম থাকে। এইটাও এক ধরণের স্মার্টনেস। সুতরাং নিজেকে আমি তখন স্মার্ট বলেই দাবী করতাম।

অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস পতনের কারণ হয়, সেদিনও আমার তাই হয়েছিল। চন্দ্রিমায় সেই কাপড়ের দোকানে গিয়ে খামাকাই ধাতানি দেওয়া গলায় জানতে চাইলাম,"আপনারা এত ধান্ধাবাজ কেন, হা? মেয়েদের প্যান্ট, ছেলেদের নাম করে এরে গছায়ে দিছেন?"

দোকানী প্রথমে আমার কথা বুঝতেই পারে নি। কিংবা ইচ্ছে করেই আমার ঝারিঝুরি উপেক্ষা করে সহজ গলায় জানতে চাইল,"কি হয়েছে?"

"মেয়েদের প্যান্ট ছেলেদের নামে চালিয়ে দিছেন। এই নেন আপনার মাল, টাকা ফেরত দেন!"
"আমার দোকান থেকে নেওয়া?"
"হা।"
"কখন নিছে?"
"এইতো ঘন্টা দুয়েক আগে।"
"কেডায় নিছে?"

আমি ইশারায় ইরাজকে দেখিয়ে দিলাম।
দোকানী ইরাজের দিকে তাকিয়ে কুশ্রী একটা মুখভঙ্গি করে জানতে চাইল,"জিনিস কেনার সময় চোখ দুইটা কি বাসায় রেখে আসছিলেন? এখন আসছেন ফেরত দিতে-।"

ইরাজ মাথা নুইয়ে ফেলল। ওকে গার্ড দেওয়ার জন্য আমি নরম গলায় বললাম,"ভাই ওর অভিজ্ঞতা নাই। ভুলে অন্য জিনিস নিয়ে গেছে। আপনার তো বলা উচিত ছিল এইটা মেয়েদের প্যান্ট!"

"দোকানভরা খদ্দের, আমি একলা মানুষ কতদিকে খেয়াল রাখি?"

"যাহোক, এইবার জিনিসটা ফেরত নিয়ে টাকা দিয়ে দেন।"

"বিক্রির মাল ফেরত হয় না!"

"তাইলে এইটা বদলায়ে একটা ছেলেদের প্যান্ট দিন!"

"ছেলেদের প্যান্ট কি আসমান থেকে দিমু? এইটা হল মেয়েদের জামা-কাপড়ের দোকান-। কপালে চোখ নাই নাকি আপনাদের?"

ঘটনা আসলেই তাই। এতক্ষণ আবেগে কিংবা বিগারের আতিশয্যে খেয়াল করি নি।দোকানের চারপাশে তাকায়ে দেখি, মেয়েদের প্যান্ট, টিশার্ট, বডিস, শেলফের ভেতর রঙচঙা অন্তর্বাস। দোকানের অন্যপাশে দুইজন খদ্দের ঢুকেছে, দুইটাই মেয়ে! চকিতে ওদিকে ফিরে তাকালাম। হ্যা, যা ভাবছিলাম তাই, আশপাশের দোকানীরাও আমাদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। এতক্ষণ খেয়াল করি নাই!

লজ্জায় এবং অপমানে আমার বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে হল। ইরাজের হাত ধরে হ্যাচকা একটা টান দিয়ে বললাম,"চল-।"

ইরাজ কথা বলল না। আমার সঙ্গেই বেড়িয়ে আসার উদ্যোগ করল, কিন্তু তার আগেই সে হাত বাড়িয়ে সেই প্যান্টখানা হাতে তোলে নিল!

ক্ষুব্ধ গলায় বললাম,"রেখে দে। এই জিনিস বাসায় নিয়ে লাভ কি?"

ইরাজ ম্লান গলায় কিছু একটা বলল, বুঝতে পারলাম না। বুঝার ইচ্ছেও ছিল না। হালা বলদের পাল্লায় পড়ে খুব বিশ্রী একটা কান্ড হল৷
আর কোনদিন চন্দ্রিমায় আসা যাবে না, আসলেই এরা আমাকে দেখে আড়াল থেকে হাসবে... ব্লাডি হেল!

রাগ হচ্চিল খুব। কিন্তু বেচারা ইরাজের যন্ত্রণাকাতর পাংশুটে মুখের দিকে তাকিয়ে পুরো বিষয়টাই ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম।
বাসায় ফিরে ফুরফুরে গলায় বললাম,"জিনিসটা সঙ্গে করে নিয়ে এসে ভালোই করেছিস। বাড়িতে পাঠিয়ে দে। হালকা একটু ফিটিং করিয়ে তোর ছোট বোন মায়াকে দিয়ে দিস। সে পরতে পারবে।"

ইরাজ শুকনো গলায় বলল,"মায়াকে এইটা দিয়ে দিলে আমি পরব কি?"

"আল্লাহ মাফ করো, তুই কি এই প্যান্ট পরে কলেজে যাবি?"

"হু। মায়া প্যান্ট পরে না। সালোয়ার-কামিজ পরে।"

ভেবেছিলাম কথাটা সে রাগ করে বলেছে। কিন্তু না। ইরাজ সত্যি সত্যিই পরদিন সকালে সেই প্যান্ট পরে কলেজে গেল। আমি নিজে ওকে একটা প্যান্ট গিফট করব বলে, এইটা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলাম। সে আমার দানের জিনিস পরতে চায় নি।

বাখারির মত চিকনচাকন ইরাজের পরনে মেয়েদের প্যান্টও মানিয়ে যেত। তাছাড়া কোমড়ের দিক থেকে আধ-হাত নিচে অবধি শার্টের ঝুল নেমে থাকায়, কেউ একটা টের পায় নি। অতি বিত্তবান ঘরের মেয়ে প্রিয়াঙ্কা শুধু একদিন আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে নিচু গলায় জানতে চেয়েছিল,"তোমার বন্ধুটা এমন হাদারাম কেন?"
আমি কাতর গলায় মিনতি করে বলেতে যাচ্ছিলাম,"প্লিজ-।"
তার আগেই প্রিয়াঙ্কা বলল,"ওকে নিয়ে কমনরুমের মেয়েরা খুব হাসাহাসি করে, আমার খারাপ লাগে, তাই-।"

এইসব কথা ইরাজের কানে পৌছায় নি। কিংবা কে জানে, সে হয়ত সবই শুনেছে, কখনো গায়ে মাখে নি!

সেইসব আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগের কথা। ইরাজ এখন সদর কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক। ভালো আছে, বেশ ভালো।

যদিও,
এখনও সে আগের মতোই অন্তর্মুখী। হ্যাংলা-পাতলা, চিপচিপে দেহ। একটুও স্মার্ট হতে পারে নি, বরং আগের মতোই মাথা নুইয়ে হাঁটে...

ইরাজের সাথে দেখা হয় না অনেক দিন।

ইরাজের ছোট বোন মায়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। থাকে কুয়েত-মৈত্রী হলে। মায়ার সঙ্গে প্রায়শই দেখা হয়। ইরাজের কথা জানতে চাই।

ইরাজের বিরুদ্ধে মায়ার অগুন্তি অভিযোগ।

"....ভাইয়াটার টাকা পয়সা হচ্ছে, তবু চেহারায় রোশনাই আসছে না কেন বলুন তো?
কেন এখনও ফুটপাতের জামাকাপড় গায়ে দেয়?
অথচ আমার প্রতি খুব দরদ! সব সময় সেজেগুজে থাকতে বলে...
ভালো ভালো জামাকাপড় আর খাদ্য খাবার খেতে বলে...
কেন রে ভাই, আমি কি রাজকন্যা?"

ইরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে করতে অকারণেই মায়ার চোখের কোণ থেকে জলধারা নেমে আসে।

আমি ওর জলভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে ইরাজকে দেখতে পাই... একজন রাজপুত্রকে দেখতে পাই যেন... একজন খুব মায়াময় রাজপুত্রকে দেখতে পাই যেন... খুব বড় সৌভাগ্যের গুণে এককালে আমি ওর পাশে বসার সুযোগ পেয়েছিলাম... এককালে আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম, এই হল আমার মানুষজন্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম প্রাপ্তি...!

সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৫২
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×