অন্তঃকথা
- রাফিউল ইসলাম
তাঁর ছবিতে বাংলার জল-মাটি ও কাদার গন্ধ; বাংলার ফসলের ঘ্রাণ। বাংলার নদী তার রূপসী-রূপ সম্পূর্ণ মেলে ধরেছে তাঁর ছবিতে ‘সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা-নদী-মেখলা’ বাংলার রূপজ মানুষের জীবন-সংস্কৃতির শিল্পরূপ তাঁর আলোকচিত্র। কর্মমুখর প্রত্যয়ী বাঙালি জীবন-লাবণ্য, এদেশের ‘দীপ্তিমান কৃষিজাত জাতক মানব’ -এর ধ্র“পদ অভিব্যক্তিতে তাঁর আলোকচিত্র স্পন্দমান।
খ. নাইব উদ্দিন আহমেদ (১৯২৫) এ অঞ্চলে শৈল্পিক আলোকচিত্র-চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। এ জনপদের উর্বর মৃত্তিকার গভীরেই তাঁর শিল্প-চৈতন্যের শেকড় প্রোথিত। গ্রাম বাংলার রূপ-রস-গন্ধ-র্স্পশ গায়ে মেখে তাঁর শিল্পীসত্তার পরিপুষ্টি। তাই গ্রামবাংলার প্রকৃতির কোলে মানুষের সরল সংগ্রামী জীবনাচারের প্রতি তাঁর রয়েছে অনিবার্য আকর্ষণ ও ভালবাসা। এ ভালবাসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিল্পী-অন্তর, চৈতন্য-মনন; সৃজিত হয়েছে ‘আমার বাংলা’র আলোকচিত্রগুলো। ’আমার বাংলা’ তাই এ ভূ-খণ্ডে বিরাজিত বাস্তবতার চিত্ররূপ বা প্রামাণ্যকরণ নয়। ‘আমার বাংলা’ শিল্পীর ভাবনার বাংলাদেশ, ‘আমার বাংলা’ শিল্পীর আর্কেডিয়া। এ আর্কেডিয়া ‘আমার বাংলা’র প্রধান পাত্রপাত্রী মনোরম প্রকৃতির কোলে কর্মরত সংগ্রামী মানুষ। যে কৃষক ভূমি কর্ষণ করে, যে মাঝি-জেলে নদীকে জয় করে, যে শ্রমিক চাকাকে সচল রাখে, যে কুমোর পাত্র গড়ে, তাদেরই মহিমান্বিত উপস্থিতি ‘আমার বাংলা’য়। ‘আমার বাংলা’র এ অধিবাসীরা সকলেই কর্ম, মৃত্তিকা, উৎপাদন ও ইতিবাচক জীবনচর্যার সাথে সম্পর্কিত এবং অর্পিত কর্ম সম্পাদন করে তারা তৃপ্ত ও পরিপূর্ণ। এখানে নাইব উদ্দিন আহমেদ-এর ‘আমার বাংলা’য় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সোনার বাংলা’র মাতৃরূপা দানশীল প্রকৃতির ঐশ্বর্য এবং জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’র প্রকৃতির নান্দনিক উপাচারের সাথে অস্তিত্বমান হয়েছে ভূ-সম্পৃক্ত কর্মজীবী। ‘আমার বাংলা’ এ অভিধার মাঝে নিজস্বতার যে ঘোষণা, দ্রষ্টাসুলভ অভিজ্ঞান, এতে অন্তর্ভুক্ত আলোকচিত্রগুলো সে শিল্পমান অর্জন করেছে। এ ছবিগুলো কোন দূরবাসী পর্যটক বা আগন্তুকের ভ্রমণের চোখ দিয়ে ধারণ করা নয়, নিজ মৃত্তিকায় দাঁড়িয়ে আত্মরূপ প্রকাশ।
একটি জনপদের অধিবাসী নৃগোষ্ঠির নিজ ভূমিজ নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে। ‘বাংলা নামের দেশ’-এ মাঠ-ঘাট-বাট, নদী-জলাধারে ছড়িয়ে থাকা জীবনের অভিব্যক্তিগুলো নান্দনিক শিল্পরূপ পেয়েছে নাইব উদ্দিন আহমেদ-এর অজস্র আলোকচিত্রে। ‘আমার বাংলা’ তাই ভূ-সংস্কৃতির রূপ গাথা। আলোকচিত্রে নদী ও নৌকার তথা নদী-সংস্কৃতির ধ্র“পদী রূপকার নাইব উদ্দিন আহমেদ। ‘বাংলার ঘাটে’ স্নানরতা বা স্নানশেষে বাঙালি নারীর শাশ্বত রূপভঙ্গিঁ তাঁর আলোকচিত্রে নান্দনিক বিভা ছড়িয়েছে। রাখালী বাঁশীর সুর ‘আমার বাংলা’য় সম্মোহনী মূর্চ্ছনা ছড়িয়েছে, কলমী-দামে শিশুর প্রাণোচ্ছলতা উচ্ছাস ছড়িয়েছে। আদিবাসী রূপখণ্ডে গারো নৃত্যের ছন্দ বা সাঁওতালদের শিকারের আদিভঙ্গিঁসহ অধিবাসীদের বিচিত্র ধ্র“পদী অভিব্যক্তি নিয়ে ‘আমার বাংলা’ হয়ে উঠেছে ধ্র“ব-বাংলা।
গ. নাইব উদ্দিন আহমেদের শিল্প ও জীবনভাবনার মৌলসত্য দেশ-মাটি ও মানুষের প্রতি ভালবাসা। ‘জীবনের জন্য শিল্প’ এ প্রত্যয়কে অঙ্গীকৃত করেছেন তিনি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। ১৯৪৩-এ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন-এর সাথে কলকাতার অলি-গলি রাজপথ ঘুরে মন্বন্তরের ছবি তুলেছেন তিনি। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের ছবি তুলেছেন গভীর দেশাত্মবোধ থেকে। ১৯৭১-এ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন-গণহত্যা এবং পাশাপাশি এদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথার ছবি তোলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাও করেন বিভিন্নভাবে। স্বাধীন দেশের স্বপ্ন তিনি লালন করতেন তরুণ বয়স থেকেই। ১৯৫১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় ফুল ভাবনায় শাপলা ফুল দিয়ে তিনি পত্রিকার প্রচ্ছদ করেন। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান দিবসে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ র্শীষক ক্রোড়পত্র প্রণয়ন করেন। এজন্য তাঁকে পুলিশ থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ১৯৫৫ সালে কলম্বোতে সরকারের অনুরোধ উপেক্ষা করে ‘জঁৎধষ ষরভব ড়ভ চধশরংঃধহ’-এর স্থলে ‘জঁৎধষ ষরভব ড়ভ ঊধংঃ চধশরংঃধহ’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রর্দশনী করেন।
ঘ. নাইব উদ্দিন আহমেদ -এর আলোকচিত্রগুলো মূলত বাস্তববাদী ধারার। কিন্তু মন-মনন ও সৃষ্টিশীলতা দিয়ে তিনি আলোকচিত্রে মেলে ধরেছেন বাস্তবের শিল্পময়তা। নিজস্ব শিল্পমিতিতে বাস্তবের যে হিরন্ময় ক্ষণগুলো তিনি আলোকচিত্রে ধরে রেখেছেন, তা প্রগাঢ় শিল্পস্বাদ তৈরী করেছে। পূর্বেই আলোচিত হয়েছে নাইব উদ্দিন আহমেদ তাঁর মানসভূমি ‘আমার বাংলা’র বাসিন্দাদের কর্মমন্ত্রে উজ্জীবিত দেখেছেন। তাদের কর্মসাধনার শক্তি ও সম্ভাবনার উৎস হিসেবে চাকা, কাস্তে, লাঙ্গল, নৌকার পাল প্রভৃতিকে মোটিফ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রেরণা ও সহায়তাকারী শক্তিরূপে তাঁর আলোকচিত্রে মেঘের সতত উপস্থিতি। তাঁর বেশিরভাগ আলোকচিত্রে পশ্চাদ্-দৃশ্যপটে আকাশের আনুপাতিক অংশ বেশী; কোন কোন চিত্রে ‘ব্যাক-গ্রাউন্ড’ জুড়ে শুধু আকাশ, যা তাঁর সৃষ্ট শিল্পের কুশীলব বিষয়-কর্ম বা কোন ভঙ্গিকে দেশ-কালের পরিধির বাইরে মহাকালীন দ্যোতনা দিয়েছে। মানুষকে, কর্মকে, বিষয়বস্তুকে মহীয়ান করতে তিনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘লো অ্যাঙ্গেল’ ব্যবহার করেন। চিত্র-ধারণে মধ্য আকাশের সূর্যের দীপ্র আলো তাঁর প্রিয়। ছবির ‘কম্পোজিশন’-এর ক্ষেত্রে নাইব উদ্দিন আহমেদ অত্যন্ত সর্তক ও পরিমিত। প্রথমেই তাঁর উদ্দিষ্ট বিষয়ের কাক্সিক্ষত সু-উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। দৃশ্য থেকে বিষয়বস্তুর বাইরের সমস্ত বাহুল্য বিয়োজন করেন। দৃশ্যভুক্ত বিষয়সমূহের বিশ্লিষ্টতা নয় অখন্ড জৈব-সমগ্রতা তাঁর অনিবার্য শিল্পমিতি। তাঁর যে বিখ্যাত ছবি, রাখাল বাঁশী বাজাচ্ছে, নৌকা চলছে : এ ছবিতে এ দুয়ের যে পারস্পরিক সর্ম্পক, বাঁশীর সুর সঞ্চারিত হয়েছে সমস্ত প্রকৃতিতে, নদীতে...মেঘে...নৌকার পালে...নৌকা চলেছে। যে জীবনস্রোত, নদীস্রোতের প্রতিকূলে বৃদ্ধ গুন টানছে, সে স্রোতোরেখা তার পিঠে দৃশ্যমান। দু-পাশে পাটক্ষেতের ঠিক মাঝখানে পাটবন্ধু কৃষক যেন পাট হয়েই দাঁড়িয়ে আছে, দুপাশের ঈষৎ আনত পাটসারি, পরস্পরের পরিপূরক সত্তাকেই প্রতিপন্ন করেছে। মেঘের বিপরীতে ‘সিলুয়েটে’ উদ্যোগী কৃষকের চলার ভঙ্গিঁ যেন জীবনের সমস্ত উষরতা কর্ষণের ইঙ্গিঁতবহ। নদীতে স্নানশেষে বাঙালি নারীর চুল ঝাড়ার ধ্র“পদ ভঙ্গি গাছের আনত শাখা যেন তাকে আগলে রেখেছে এবং সবমিলিয়ে একটা সমতান সৃষ্টি করেছে। জানালার ধারে যে মেয়ে বসে আছে এবং বৃষ্টিভেজা জানালা, বাইরে প্রকৃতি-পানে তার দৃষ্টি রোমান্টিক বিষণœতার শিল্পস্বাদ দেয়। সমস্ত বিঘœ ব›ধুর পথ পেরিয়ে কাদামাখা চাকার যে জীবন জয়ী রূপ, সমস্ত প্রতিকূলতা অচলতা, অসারতা, জড়তা জয়ের উৎসাহ দেয়। ছায়া ও কায়া মিলিয়ে বৃত্তাকারে যুথবদ্ধ গারো-নৃত্যের সংহত প্রকাশ হিরন্ময়। মুক্তিযুদ্ধের অনেক ছবিতেই নাইব উদ্দিন আহমেদ রূপক ও প্রতীকী মাত্রা যুক্ত করেছেন। তাঁর তোলা মুক্তিযুদ্ধের লাঞ্ছিত তরুণী, এলোমেলো চুল ও মুষ্টিবদ্ধ হাতে অবমাননা-লাঞ্ছনার বিপরীতে প্রতীকী প্রতিবাদ জানিয়েছে। ব্রক্ষপুত্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে তিন মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্যপম যুদ্ধভঙ্গির ছবি, বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের আইকনিক ছবিতে রূপ নিয়েছে। আর মাথার খুলির ভেতর দিয়ে গজানো জীবনগন্ধী ফুল,আত্মত্যাগী নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের রূপান্তরিত সত্তা, বাংলাদেশ।
ঙ. স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে শৈল্পিক আলোকচিত্র চর্চার প্রায় অকর্ষিত এ অঞ্চলে শিল্প-সাধনার ক্ষেত্রে নাইব উদ্দিন আহমেদ একজন অগ্রপথিক। বাংলাদেশে আলোকচিত্রের বিকাশে তাঁর বিভিন্নমুখী অবদান রয়েছে। সেই সাদা-কালো ছবির যুগে ১৯৫১ সালে এদেশের ইতিহাসে প্রথম রঙিন ছবি তোলেন তিনি। সেগুলো ছাপাও হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। এদেশের আলোকচিত্রীদের মধ্যে তিনিই প্রথম ১৯৫৩ সালে পার্বত্য-চট্রগ্রামে আদিবাসী মুরং, চাকমা, মারমাদের ছবি এবং ১৯৫৮ ও ১৯৬১ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপে গবেষণাধর্মী ছবি তোলেন। সে সময়ে তাঁর তোলা দ্বীপটির প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি, প্রবাল-পাথর ও জনজীবনের দৃশ্য আজ লুপ্ত।
একজন শিল্পীর অনিবার্যভাবেই দেশ-মাটি-মানুষ তথা শিল্পের প্রতি একটা দায় বা কমিটমেন্ট থাকে, মন ও মননজাত নিজস্ব অভিপ্রায়ও থাকে। শিল্পের দায় ও অভিপ্রায় সমন্বয়ে আলোকচিত্র শিল্পী নাইব উদ্দিন আহমেদ একজন মহৎ শিল্পীর মতোই উর্ত্তীণ হয়েছেন। নাইব উদ্দিন আহমেদের শিল্পীসত্তার সবচেয়ে মহত্তম দিক হলো, তাঁর সৃষ্ট শিল্পকর্ম এবং নিজ জীবন-বোধ তথা জীবন-যাপনের সমরূপতা। তাই ‘আমার বাংলা’-র রূপকার এ শিল্পী ব্রক্ষ্রপুত্র নদের পাড়ে ‘বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’-এ কর্মজীবন শেষে বর্তমানেও বসবাস করছেন তাঁর প্রিয় গ্রামবাংলার নিভৃত পল্লী পারিল-এ।
বিঃদ্রঃ এ শিল্পীর আলোকচিত্র প্রদর্শনী শুরু হতে যাচ্ছে আগামী ৭ নভেম্বর শনিবার বিকাল ৬ টায় জাতীয় যাদুঘর মিলনায়তনে। আপনারা সবান্ধবে আমন্ত্রিত।