ِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
السلام عليكم ورحمة الله و بركاته
মুসলিম উম্মাহর বৈশিষ্ট্য
মূল:ড: আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে শান্তি ও কল্যাণ বর্ষিত হোক তাঁর সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ (সা.)- এঁর ওপর ও সেই সকল লোকদের ওপর যারা কিয়ামত পর্যন্ত সত্যের পথ অনুসরণ করে।
এই মুসলিম উম্মাহর অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। এর মধ্যে পবিত্র কুরআনের আলোকে মূলত চারটি বৈশিষ্ট্য আমরা দেখব, যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা উল্লেখ করেছেন এই হিসেবে যে, তা সবসময় এই উম্মাহর থাকা উচিত বা ছিল বা থাকবে। আমরা দেখব এসব বৈশিষ্ট্য এই উম্মাহ কতটুকু ধরে রেখেছে এবং যদি এগুলো না থেকে থাকে তবে কিভাবে সেগুলো পুনরায় অর্জন করা যায়।
প্রথম বৈশিষ্ট্য: মধ্যপন্থা অবলম্বন
“এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষী হতে পার।” (সূরা বাকারা, ২:১৪৩)
এই মধ্যপন্থী বা ন্যায়পরায়ণ জাতির ধারণাটি আমরা কুরআনের সর্বত্র দেখতে পাই: যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদেরকে ন্যায়বিচারের আদেশ দেন; যখন ধর্মের ক্ষেত্রে চরমপন্থা বর্জনের, ব্যয়ের ক্ষেত্রে বাহুল্য বর্জনের কিংবা জীবনের কোন ক্ষেত্রে সীমা লংঘন করা থেকে বিরত থাকার আদেশ দেন। [উদাহরণ : (সূরা বনী ইসরাইল, ১৭:২৯, ১১০); (সূরা ফুরকান, ২৫:৬৭); (সূরা হাদিদ, ৫৭:২৩) - অনুবাদক]।তাই মুসলিম উম্মাহর পথকে অন্যান্যদের থেকে পার্থক্য করা যায়। এই পথ ডানে বা বামে ঝুঁকে পড়েনা, কোন চরম অবস্থানে চলে যায়না।
ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বালুতে একটি সরলরেখা টানলেন এবং এর ডানে ও বামেও রেখা টানলেন। তিনি প্রথম রেখার দিকে নির্দেশ করে বললেন, এটি তাঁর পথ, সরল পথ। ডানের ও বামের পথ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। ডান ও বামের পথের প্রতিটির মাথায় অবস্থিত শয়তান, লোকদের সেসব পথের দিকে ডাকে।
এই যে পথ বেছে নেওয়া হলো যাতে কোন বাড়াবাড়ি নেই, তা এই উম্মাহর জন্য বিশিষ্ট। বিশিষ্ট এই জন্য যে, ইসলামের বাণী সর্ম্পকে যারা জানতে চায়, তাদের জন্য এখনও তা সংরক্ষিত অবস্থায় আছে। এজন্য একে বিশিষ্ট বলা হয়নি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কেবল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই এই পথে চলতে আদশে করেছিলেন, এই পথে মানুষকে ডাকতে বলেছিলেন; প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সকল নবীই এ পথের প্রতি আহবান করেছেন। কিন্তু তাদের (পূর্ববর্তী নবীদের) বাণীর বিকৃতির কারণে, বর্তমানে কেবল চরমপন্থাই অবশিষ্ট রয়েছে যেমন ইহুদী ও খ্রীস্টান ধর্ম।
মূসা ও ঈসা (আ) যে মধ্যপথ শিখিয়ে গেছেন, তা এখন বিলুপ্ত হয়েছে। তাই শুধুমাত্র এই শেষ উম্মতই মধ্যপথ অবলম্বন করে রয়েছে। খ্রীস্টানরা বিশ্বাস করে ঈসা (আ.) ঈশ্বর। তারা ঈসাকে (আ.) স্বর্গীয় মর্যাদায় উন্নীত করেছে, তাঁকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছে। ইহুদীরা তাকে অবৈধ সন্তানের কাতারে নামিয়েছে। এই দুটোই চরম অবস্থান। ইসলামই ঈসার (আ.) প্রকৃত পরিচয় রক্ষা করেছে - তিনি আল্লাহর একজন মহান নবী, কুমারী মাতা থেকে তাঁর জন্ম, তিনি ঈশ্বর নন, তাঁর কোন ধরনের ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিলনা। সন্দেহাতীতভাবে এই শিক্ষাই তিনি দিয়েছিলেন। অন্যরা এর পরিবর্তন করে বিকৃতিতে পৌঁছে গেছে।
তাদের অন্যান্য বিশ্বাসের বেলাও এরকম দেখা যায়। ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে খ্রীস্টানরা জিব্রাইলকে (আ.) আল্লাহর অংশীদার বানিয়েছে, তাকে তারা বলে ”পবিত্র আত্মা”। অপরদিকে ইহুদীরা কিছু ফেরেশতাকে শয়তানের পর্যায়ে অবনমিত করেছে। তাদের মতে শয়তানরা অধঃপতিত ফেরেশতা, যারা আল্লাহকে অমান্য করেছিল। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ফেরেশতারা আল্লাহকে অমান্য করেনা, আবার তাদের কোন ধরনের ঐশ্বরিক ক্ষমতাও নেই।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য - সেরা জাতি
কোরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুসলিমদের সর্বোত্তম জাতিরূপে অভিহিত করেছেন, যদি তারা কিছু শর্ত পূরণ করে।
“তোমরাই (এই দুনিয়ায়) সর্বোত্তম জাতি, সমগ্র মানবজাতির (কল্যাণের) জন্যই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।...” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১১০)
আল্লাহ আমাদের সেরা বললেও, এই শ্রেষ্ঠত্বের কিছু শর্ত রয়েছে। তা হল:
“...তোমরা দুনিয়ার মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং নিজেরাও আল্লাহর উপর (পুরোপুরি) ঈমান আনবে।” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১১০)
যদি আমরা এই শর্ত পূরণে ব্যর্থ হই, তবে আমরা সেরা থাকব না। খ্রীস্টান, ইহুদী প্রভৃতি অন্যান্য প্রধান ধর্মীয় জাতিগুলো খারাপ কাজের আদেশ দেয়, ভাল কাজে বাধা দেয়। তারা আল্লাহকে বিশ্বাসের দাবীদার হলেও, প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করেনা। ক্যাথলিক খ্রীস্টানরা পাদ্রীদের বিয়ে করতে বাধা দেয়, এভাবে তারা ভাল কাজকে নিষিদ্ধ করে। অপরপক্ষে আল্লাহ মদ ও শুকরকে হারাম করেছেন, কারণ এগুলো ক্ষতিকর - কিন্তু তারা তা হালাল করে নিয়েছে।
অনুরূপভাবে, ইহুদীরা নিজেদের মধ্যে সুদ নিষিদ্ধ করে কিন্তু অ-ইহুদীদের সাথে সুদভিত্তিক লেনদেনের অনুমতি দেয়। অথচ যা তাদের জন্য খারাপ, তা সমগ্র মানবজাতির জন্য খারাপ। আল্লাহ-নির্ধারিত "খারাপ" কোন আপেক্ষিক ব্যাপার নয়। যখন আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন, তখন তা সমগ্র মানবজাতির জন্যই করেছেন, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু লোকের জন্য করেননি। অপরদিকে ইসলামে সেসব বস্তুকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যেগুলো মৌলিকভাবেই ক্ষতিকর, তেমনি যা কিছুই উপকারী, সেসব কিছুকেই হালাল করা হয়েছে। এজন্য এই উম্মাহ সূচনালগ্ন থেকেই সমস্ত মন্দকে নিষেধ ও উত্তমকে গ্রহণের ব্যাপারে আদেশ করে এসেছে, এটা এতটাই অধিক মাত্রায় যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা অন্যায়/মন্দকে মুনকার অর্থাৎ অজানা ও ন্যায়/কল্যাণকে মা’রুফ অর্থাৎ সুপরিচিত বলে আখ্যায়িত করেছেন, কেননা মা’রুফ কোনগুলো তা মোটামুটিভাবে সর্বজনবিদিত। যদিও আল্লাহ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিছু জিনিস নির্দিষ্ট করে দিতে হয়েছে, তবুও কোনটা ভালো তা সকলেরই জানা। ভালর উপলব্ধি সকলের অন্তরে প্রোথিত করে দেয়া হয়েছে। যেমনটি কুরআনে উল্লেখ আছে:
“শপথ মানবপ্রকৃতির এবং সেই সত্তার যিনি তাকে বিন্যাস করেছেন। অতঃপর তাকে তার ভালো ও মন্দ কাজের জ্ঞান দিয়েছেন ।” ( সুরা শামস্, ৯১:৭-৮)
সুতরাং ইসলামী ব্যবস্থা কুর’আনের/অহীর আলো দিয়ে এই সচেতনতাকে পথ দেখায়। এই সচেতনতাকে কাজে লাগানো সম্ভব নয়, যদি না কোন পথনির্দেশক ব্যবস্থা থাকে। ইসলাম এই সচেতনতাকে কাজে লাগিয়ে জীবনে উপকার লাভের জন্য এক পথের সন্ধান দেয়। সূরা আল-ফাতিহায় ইহুদীদের বলা হয়েছে ‘আলমাগদুবি আলাইহিম’, অর্থাৎ ‘যাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ’, কেননা তারা সত্যকে জানার পরও তা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সত্যের প্রতি আহবান করেনি। ইহুদীদের এরকম বলার ব্যাপারে আল্লাহর উদ্দেশ্য কেবল এটা নয় যে, আমরা তাদের সর্ম্পকে খারাপ মানসিকতা গড়ে তুলব, বরং তিনি আমাদের ঐ একই গর্তে পা দেয়ার ব্যাপারে সাবধান করে দিচ্ছেন। আমরা তাদের মত হব না, যারা ভাল কি তা জানার পরও তার দিকে আহবান করে না ও সেটাকে বাস্তবায়িত করেনা।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য- একক জাতি
“তোমাদের এই যে জাতি, এতো একই জাতি। আর আমি তোমাদের প্রতিপালক, তাই আমার উপাসনা কর।” ( সূরা আম্বিয়া, ২১:৯২)
আমরা একটিই জাতি এই অর্থে যে, আমরা জাতীয়তার দিক দিয়ে ভিন্ন হলেও আমাদের রব একজন। আমাদের ঐক্যের কারণ এই যে, আমরা সকলে আল্লাহকে বিশ্বাস করি। আমাদের মধ্যে যত পার্থক্যই থাকুকনা কেন, আমরা এই একটি কারণেই একতাবদ্ধ। কুরআনের আয়াতে মু’মিনদের ভ্রাতৃসম বলা হয়েছে:
“নিশ্চয়ই বিশ্বাসীরা পরস্পর ভাই ভাই...” (সূরা হুজুরাত, ৪৯:১০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, আমরা একটি ইমারতের মত যার এক অংশ অপর অংশকে মজবুত করে তোলে। মুসলিম উম্মাহর একতা সংক্রান্ত এই মৌলিক ধারণাগুলো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন এবং তাঁরাও সেইমত চলেছেন এবং পরবর্তী সকলকে এর মর্মাথ পৌঁছে দিয়েছেন।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য- ধর্ম প্রচার ( দাওয়াত)
“তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা ভালোর দিকে ডাকবে ও সৎ কর্মের নির্দেশ দিবে এবং অসৎকর্মের ব্যাপারেও নিষেধ করবে। আর এসব লোকই হবে সফলকাম।” (সুরা আলে ইমরান ১০৪) [অনুরূপ আয়াত (সূরা আন নাহল, ১৬:১২৫) - অনুবাদক]
ইসলামের বাণী অপরের কাছে পৌঁছে দেওয়া বা দাওয়াত এই উম্মাহর একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, প্রথম থেকেই তাঁর আশেপাশের লোকদের, তাঁর পরিবার ও সমাজের কাছে ধর্ম প্রচার করেছেন এবং এর ফলশ্র“তিতে সেই সমাজ গোটা দুনিয়ায় ইসলামের বাণী প্রচার করেছে।
দাওয়াত হতে পারে মৌখিক আহ্বানের আকারে বা প্রয়োজনে সশস্ত্র যুদ্ধের আকারে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের বাণী অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়া মুসলিমদেরই দায়িত্ব।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ৯:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



