যখন কোন রিপোর্ট তৈরীতে বসি চোখের সামনে ভেসে উঠে সারা দিনের বৈচিত্রে ভরা মানুষের চরিত্র । লেখক হতে পারলে অনেক বড় বড় উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতাম । নিষিদ্ধ পল্লীর মানুষদের নিয়ে তাই একটি ব্যাতিক্রম রির্পোট "অন্ধকারের অজানা কষ্ট "
হোটেল ক, রংপুরের একটি আবাসিক হোটেল । হঠাৎ ঐ আবাসিক হোটেলে আমাদের ও সংঙ্গে থাকা ক্যামেরা ও হ্যান্ডিক্যাম দেখে চমকে উঠে হোটেল ম্যানেজার । হোটেলের নিয়ে রির্পোট লিখবো না বলতেই তিনি সর্ব প্রকার সাহায্যের হাত বাড়ালেন । এসেছি আবাসিক হোটেল গুলোতে যেসব মেয়ে দেহ বিক্রি করে, তাদের উপর একটি বাস্তব সমীক্ষা চালাতে। কাজটি খুব সহজ নয়। কারণ এই কাজগুলো হয় গোপনে । প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার করে না যে হোটেলগুলোতে এইসব কাজ হয় । এর মাঝে ম্যানেজার সাগর ভাই এক বন্ধুর পরিচিত
হওয়াতে এখানে এসেছি । কারণ পরিচিত না হলে হোটেল গুলোর বিজনেস সিক্রেট কেউ প্রকাশ করার কথা নয়। সাগর ভাই ডিগ্রী পাশ করে অনেক ঘোরাঘুরি করে ভাল কোন
চাকুরী না পেয়ে শেষে এই হোটেল ম্যানেজারের চাকুরীটা নেয়। বাস্তব খুবই কঠিন। ছাত্র
জীবনে কতই না স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে সম্মানজনক একটি চাকুরী করে দেশের সেবা করবে । কিন্তু এখন কি করতে হচ্ছে দুঃখ করল আমার কাছে। সাগরের কাছ থেকে প্রাথমিক ধারণা পেয়েই আমি ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠলাম দেশের অবস্থার কথা চিন্তা করে ।প্রতি দিন
গড়ে ২০/২৫টি মেয়ে প্রতিটি হোটেলে আসে। শুধু রংপুর বিভাগেই যদি ৫০ টি হোটেল ধরে হিসাব করা হয় তবে দেখা যাবে প্রতিদিন প্রায় হাজার মেয়ে হোটেলে দেহ বিক্রি করছে। সাগর
জানালো শুধু রংপুর শহরেই নয় সারা বাংলাদেশের আবাসিক হোটেল গুলোতে এখন
এটাই প্রধান বিজনেস। তাছাড়া আবাসিক এলাকায় স্বাভাবিক বসবাসরত মানুষের মত বাড়ী ভাড়া করে এই ব্যবসা করছে প্রায় কয়েক হাজার মানুষ। আর সবচেয়ে আশংকাজনক বিষয়
হচ্ছে ভ্রাম্যমানদের নিয়ে। ওদের বিচরণ সর্বত্র । প্রতিটি জায়গায় ওদের দেখা যায়। সন্ধ্যার পর একটু চেষ্টা করলেই আধো আলো আধো ছায়াযুক্ত জায়গায় ওদের দেখা মিলবে।যেমন শাপলা চত্বর, রেল বস্তি, রংপুর রেলওয়ে ষ্টেশন, মেডিকেল মোড়, নতুন ট্রাক ষ্টান, পায়রা চত্বর, হারাগাছ টেম্পু ষ্টান । তাহলে? আমরা যে সভ্য সমাজের বড়াই করছি। প্রতিদিন মিটিং মিছিল করে সমাজ গড়ার যে ভাষণ দিচ্ছি সেকি এই সমাজ গঠনের জন্য? নিজের অজান্তেই শিউরে উঠি ।
একবার মনে হয় এই বিষয় নিয়ে কাজ না করলেই বোধহয় ভাল হতো । এতোদিন সমাজটাকে, সমাজের মানুষকে যেভাবে চিনতাম সেটাই ভাল ছিল। কেন বাস্তবটা দেখতে গেলাম । কিন্তু তখনও জানতাম না আমার জন্য আরও একটি কঠিন বাস্তব অপক্ষা করছে।
সাধারণতঃ মেয়েরা কারো কাছে মুখ খোলে না। আমি চেষ্টা করবো ব্যবহার আর
মিষ্টি কথা দিয়ে মেয়েটির মনের কথা বের করতে । একটি মেয়ের সাথে এক
রুমে একান্তে বসে আলাপ করবো ভাবতেই আমার মধ্যে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। মেয়েটি ভাববে অন্যান্য লোকের মত আমিও একজন খরিদ্দার। ওকে ভোগ করার জন্য এসেছি।
রুমটি ছোট্ট। একটি খাট, পরিপাটি করে বিছানা পাতা, পাশে একটি টেবিল। টেবিলে একটি পানির বোতল ও গ্লাস রাখা। জানালায় পর্দা আঁটা, ঘরে একটি বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে। ঘরে ঢুকেই দেখতে পেলাম একটি মেয়ে খাটের উপর বসে আছে। সাগর ভাইকে দেখে চোখ তুলে তাকাল। আর তখনই ঘটলো ঘটনাটি । সাগর ভাই অনেকণ কিসব বলে গেল।
মেয়েটির কানে সেসব কথা ঢুকলো না । মেয়েটির ধ্যান ভেঙ্গে গেল । মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়।
'একটু বসুন । যাবেন না ।' আমি কোন রকমে কথা কয়টি বলি। মেয়েটি বিছানায় বসে পড়ে।
'আমাকে দেখে খুব অবাক হয়েছেন? না ? আপনি তো ২১ ফেব্রুয়ারীতে আমার গালে আলপনা করেছিলেন । অবাক হবার কিছু নেই। ভদ্র লোকেরাই আমাদের এ পথ বানিয়ে দিয়েছে । তাই অবাক হবার ভান করবেন না । যে কাজে এসেছেন তাই করুন । আর যদি পছন্দ না হয় আমাকে যেতে দিন ।' ঝাঝালো কন্ঠে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে কথাগুলো । 'আমি, মানে আপনি যা ভাবছেন তা নই।আমি আপনাকে ভোগ করতে আসিনি । আমি এসেছি........
' 'এখানে যারা আসে তাদের একটিই উদ্দেশ্য। নারী দেহ ভোগ করা। আপনি সাধু পুরুষ নাকি?'মেয়েটি এবার বেশ রেগে কথাগুলো বলে। নিজেকে কিছুটা মানিয়ে নিয়ে মেয়েটির কাছে গিয়ে বসি । বুঝিয়ে বলে আমার আসার উদ্দেশ্য। মেয়েটি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে একসময় ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে। দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হই। কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। মেয়েটি অনেকক্ষণ পর
উঠে বাথরুমে গিয়ে মুখে পানি ছিটিয়ে আসে। আমি মেয়েটির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকি। প্রসাধনহীন এই সুন্দর চেহারাটি এতোক্ষণ প্রসাধনের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। মেয়েটি খাটের এক পাশে বসে ঘরের লাইটের দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে বলতে শুরু করে-
'আমার বয়স যখন ১২ বৎসর তখন আমার মা একটি মৃত সন্তান জন্ম দিয়ে মারা যান। বাবা ডিসি অফিসে কেরানীর চাকুরী করতেন। রংপুর জেলা শহরে আমাদের একটি ছোট্ট
বাড়ী আছে কেরাণী পাড়ায় । আমার মা সেই ছোট্ট বাড়ীটা মায়া মমতা আর স্নেহের পরশ দিয়ে ভরে রাখতেন। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমি ছিলাম তাদের চোখের
মনি। আমার চোখের সৌন্দর্যের জন্য আমার নাম রেখেছিলেন সুনয়না। একটি পুত্র সন্তান লাভের জন্য মাকে জীবন দিতে হল।
মা চলে যাবার পর বাবা আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেন নি। কিন্তু আত্মীয় স্বজনের চাপে পড়ে বাবা আবার বিয়ে করেন। সৎমা প্রথম প্রথম বেশ ভালবাসতো আমাকে। বছর না ঘুরতেই
একটি পুত্র সন্তান উপহার দিয়ে আমার উপর চালাতে লাগলেন চাপা অত্যাচার। বুঝলেন না ? সকলের সামনে খুব ভাল কিন্তু অগোচরে অকথ্য নির্যাতন। ছোট বেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ছিল আমার দারুন আগ্রহ, ছাত্রী হিসাবেও বেশ ভাল ছিলাম। রংপুর সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তাম । সবকিছু সহ্য করে এস.এস.সি পরীক্ষা দিলাম। ঠিক তখনই
আমার জীবনে নেমে এলো পরিবর্তন। বাবার একজন সহকর্মী ঢাকা থেকে এসে আমাদের
বাড়ীতে উঠলেন। ২/৩ দিন থাকার সুবাদে আমাদের পরিবারের সাথে তার একটি ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠে। মাকে বশ করে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন তার ছেলের সাথে । হাতছাড়া করার মত বোকামী মা করতে দিলেন না আমার বাবাকে। ঢাকার ঐ লোকটার সাথে আমার
বিয়ে হয়ে গেল। তিনি বিয়ের দিনই আমাকে নিয়ে রাতের কোচে ঢাকায় রওনা দিলেন। ঢাকাআমার কল্পনার শহর। দুচোখ ভরে সকালের ঢাকা দেখলাম। একটি সুন্দর বাড়ীতে আমাকে নিয়ে এলেন আমার স্বামী। বাড়ী দেখে আমার খুব পছন্দ হলো। দুঃখ কষ্ট কিছুটা চলে গেল মন থেকে।
সন্ধ্যার পর আমার স্বামীর ২/৩ জন বন্ধু এলো আমাকে দেখতে। রাতে বাহির থেকে খাবার কিনে আনা হলো। সবাই ধুমধাম করে খাওয়া দাওয়া করে চলে গেল। আমার বাসর রাত। মনের মধ্যে ১৩ বছরের পুঞ্জিভূত আশা-আকাংখা আর ভয় নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম স্বামীর আগমনের জন্য। স্বামী এলো। আমাকে একটি ট্যাবলেট দিয়ে বললো - তোমার শরীরের উপর অনেক ধকল গেছে।
এটা খেয়ে নাও বেশ ভাল লাগবে। আমি সরল বিশ্বাসে স্বামীর দেয়া ট্যাবলেটটি খাই। কিছুক্ষন পর আমার ভীষণ ঘুম পায়। অনেক চেষ্টা করেও আর জেগে থাকতে পারিনি। যখন আমার ঘুম ভাংলো তখন আমার কাছে মনে হলো আমি যেন অনেক ভারী একটি পাথরের নীচে পড়ে আছি। অনেক চেষ্টা করেও নড়া চড়া করতে পারছিলাম না।ধীরে ধীরে অনেক চেষ্টা করে উঠে বসতেই অনুভব করলাম আমার শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ের আলামত। বিছানায় রক্তের দাগ। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম
কি হয়েছে। তখনও আমি সবটুকু বুঝতে পারিনি। স্বামীবর এসে আমাকে অনেক আদর করে গোসল করে ফ্রেস হতে বললেন।
শারীরিকভাবে আমি খুবই অসুস্থতা বোধ করছিলাম। কিন্তু কিছুই বলতে পারছিলাম
না। পর দিনও ঘটলো অনুরূপ ঘটনা। শরীরের ব্যথা কমে যাবে বলে দুটি ট্যাবলেট খাওয়াল। যথারীতি আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপর কি হয়েছিল আমি জানি না। এভাবে ৭দিন চলে যাবার পর আমার শরীর ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আমাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন বয়স্ক মহিলাকে আনা হলো। মহিলাকে জড়িয়ে ধরে যখন খুব কাঁদলাম তখন উনি আমাকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বললেন।
আমার স্বামী নামক ব্যক্তিটির আরও ২টি বউ আছে। তাদেরকে দিয়েও আমার মত একই কাজ করছে। এটাই তার পেশা। কি করবো, কি করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। ডাক্তার ডেকে চিকিৎসা করে আবার আমাকে সুস্থ করে হানিমুন করার জন্য কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া হলো। ওখানেও তার সাথে ছিল কয়েকজন বন্ধু। আগের মতই আমার অজান্তে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ওরা ব্যবহার করতো আমাকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমি কিশোরী থেকে একজন নারীতে পরিনত হলাম। প্রতিবাদ করার মত আমার কোন শক্তি ছিল না। কারণ আমার অজান্তে আমাকে নেশা জাতীয় কিছু খাওয়ানো হতো। রাত হলেই আমি পুরুষ মানুষের সাহচর্য পাওয়ার জন্য উদগ্রিব হয়ে যেতাম। যতক্ষণ আমাকে অত্যাচার করা না হতো ততক্ষণ আমার শরীরের মধ্যে কামড়াতে থাকতো। জীবনের চরম পরিনতিতে এসেও যখন ওদের চক্রান্ত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারছিলাম না তখন ওদের কথামত চলতে রাজি হলাম।
ওরা আমাকে কিছুটা স্বাধীনতা দিল। এখন আমাকে মাঝে মাঝে বাইরে যেতে হয় অন্য মানুষের বৌ সেজে আর হোটেলে আসতে হয় সপ্তাহে ২ দিন। বাকী সময়টা ঐ
বাড়ীতে থাকি। এই হচ্ছে আমার নষ্ট জীবনের কষ্টের ইতিহাস।
আমি জানি আপনি আমাকে ঘৃণা করবেন। তাতে আমার কিছু এসে যাবে না। তবে একটি কথা জেনে যান আমাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এই বাড়া যদি থামাতে না পারেন
তবে হয়তো বা একদিন নিজের আপনজনকে এই কাজে দেখবেন তখন করার কিছুই থাকবে না। '
দরজা খুলে সুনয়না বেরিয়ে গেল।
আমি পাথরের মূর্তির মত বসেই রইলাম।শুধু কানে বাজতে থাকলো সুনয়নার শেষ প্রলাপটি.....