ক্লাস সেভেন পড়ুয়া কাজলের আজকাল বেশিরভাগ সময়ই মন খারাপ থাকে। বয়সের যে সময়টা হাসি আনন্দে থাকার কথা, সেই সময়টাতে কাজল থাকে মনমরা।
অবশ্য মনমরা শুধু কাজল নয়, তার মা থেকে শুরু করে বড় দুই বোনের মনেও একফোঁটা শান্তি নেই।
অশান্তির কারণটা তাহলে খোলাসা করেই বলি ৷
কাজলেরা তিন বোন, এক ভাই। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। অন্য দুই বোনকে নিয়ে মায়ের সাথে মিরপুর ১১ তে থাকে কাজল মিয়া।
মাস দুয়েক ধরে, কাজলের ক্লাস নাইন পড়ুয়া বোন, নাইমা, সারাক্ষণই বিছানাতে শুয়ে থাকে। কথাবার্তা একদমই বলে না।
যে মেয়েটা দুই মাস আগেও ছিল উচ্ছ্বল প্রকৃতির, সেই মেয়েই এখন হয়ে গিয়েছে মানসিক সমস্যাতে আক্রান্ত। ঘরের ভিতর কোনরকম আলো ঢুকতে দেয় না। বিছানার চাদরও পরিস্কার করতে দেয় না।
বল প্রয়োগ করতে গেলে, প্রচন্ড চিৎকার চেঁচামেঁচি করে। ইন্টারেস্টিং ব্যপার হলঃ নাইমার মা পর্দা সরিয়ে দিয়ে, আবার কিছুক্ষণ পর রুমে ঢুকলে দেখতে পায় যে, পর্দা একদম আগেরমত টেনে রাখা হয়েছে।
পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, যখন নাইমা একেবারেই খাওয়া দাওয়া করা ছেড়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবে খাওয়াতে না পেরে, নাইমাকে স্যালাইন এবং নাকে টিউব লাগিয়ে খাবার দেওয়া শুরু হয়।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে , ডাক্তাররাও রোগীর সমস্যা ঠিকমত চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছিল।
নাইমের এই অবস্থা যখন চলমান, তখন ছিল ২০১১ সালের মার্চ মাস। সেই সময়টাতে কাজল ওর এক প্রিয় রেডিও শোয়ের মাধ্যমে বেজবাবা সুমনের কথা জানতে পারে। বোনের অবস্থাকে জ্বিনে ধরা টাইপ কোন ঘটনা মনে করে, বেজবাবার শরণাপন্ন হয় ছোট্ট কাজল।
বেজবাবার সাথে দেখা করে, শয্যাশায়ী বোনের কেসটা আমলে নেওয়ার জন্য কাজল খুব করে অনুরোধ করতে থাকে। কাজলকে বেজবাবা অনেকবার বলেঃ "আরে বাবা, আমি কোন হুজুর, কবিরাজ না, তুমি কেন আমার থেকে হেল্প চাইতেছ? "
কাজল নাছোড়বান্দার মত অনুরোধ করতেই লাগল।
পরে, কাজলের নাছোড়বান্দা মনোভাবের কাছে হার মেনে, সুমন ভাই প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশনে যেতে রাজি হয়ে যায়।
দুইদিন পরে, সুমন ভাই ওনার টিম মেম্বার সাকিব এবং জিবরানকে নিয়ে মিরপুর ১১ তে কাজলদের বাসাতে যায়। যাওয়ার পর, পুরো টিমকে দেখে কাজলের মা খুশিতে কেঁদে ফেলেন। মেয়ের পুরো ইতিহাস টিমের কাছে তুলে ধরেন।
সবকিছু শোনার পর, বেজবাবা নাইমার রুমে ঢুকে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর অনুমতি চান।
মায়ের কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে রুমের ভিতরে যান কাজল, কাজলের বোন আর সুমন ভায়ার টিম।
রুমে যাওয়ার পর,নাইমাকে ভাবলেশহীনভাবে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। অপরিচিত তিনজন মানুষ যে রুমে ঢুকেছে, নাইমার সেটাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
তদন্তের শুরুতে সুমন ভায়া নাইমাকে বেশকিছু প্রশ্ন করে।
প্রশ্ন শোনার পরও নাইমার মুখে কোন কথা নেই। এক পলক বেজবাবাদের দেখে, আবারও ছাদের দিকে মনোনিবেশ করল নাইমা ।
প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার কোন সম্ভাবনা না দেখে, সুমন ভাই জিবরানকে ইএমএফ রিডার বের করে নিয়ে আসতে বলেন।
ওই যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষার সময় বেশ ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটল। ইএমএফ রিডারকে নাইমার কাছে যখন আনা হচ্ছিল, তখন যন্ত্রের কাঁটা কোনধরণের মুভ করছিল না। কিন্তু যখন রিডারকে জানালার কাছে বা আলমারির কাছে নেওয়া হচ্ছিল, তখনই যন্ত্রটা শক্তিশালী ম্যাগ্নেটিক ফিল্ড শো করছিল।
এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা যখন চলছিল, সেসময় হঠাৎ করে নাইমা সুমন ভাই আর টিমের উদ্দেশ্যে কয়েকটা কথা বলে।
প্রথমেই নাইমা সুমন ভায়ের এমন কিছু ব্যক্তিগত কথা বলেন, যেটা শুনে বেজবাবা প্রচন্ড অবাক হয়ে যান। এককথায় পুরো থ বনে যান বেজবাবা।
এরপর, নাইমা জিবরান ভায়ের কিশোর বয়সের ব্যান্ড দল নিয়ে এমন কিছু কথা বলেন, যেগুলো জিবরান ভাই ছাড়া আর কারোই জানার কথা না। সুমন ভাই এর মত জিবরানও তাজ্জব বনে যায়।
শেষে, সাকিব ভাইয়ের উদ্দেশ্যে নাইমা বলে উঠেঃ "বালিশ চেঞ্জ করে লাভ নাই"।
বালিশের কথা শুনে, সুমন ভাই সাকিব ভায়াকে বলেনঃ " কিসের বালিশের কথা বলছে, সাকিব? "
সাকিব তখন বলেনঃ "আসলে আমি পরের মাসে বাসা শিফট করব, এ কারণে নতুন বালিশ কেনার চিন্তা করছিলাম"।
সাকিব ভায়ের মুখে এ উত্তর শুনে, সুমন ভাই বলে বসলেনঃ " কি!! এ কথা এই মেয়ে জানলো কিভাবে?"
দুইমাস ধরে বিছানাতে শয্যাশায়ী মেয়ে কিভাবে এই কথাগুলো জানতে পারল, সেটা বেজবাবার মাথাতে কিছুতেই ঢুকছিল না।
শেষে দুই দিনের সময় নিয়ে, বেজবাবার টিম ওই বাসা ত্যাগ করল।
অফিসে এসে সবাই মিলে কেসটা নিয়ে মিটিংয়ে বসল।
প্রায় বেশ কয়েক ঘন্টার আলোচনার পর, সবাই-ই একমত হলঃ নাইমার উপর নিশ্চিতভাবেই জ্বিন ভর করেছে। ওই জ্বিনের সাহায্যেই নাইমা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যপারগুলো বলতে পারছে।
এছাড়াও নাইমার উপর কালোজাদুর প্রভাব রয়েছে। ব্ল্যাক ম্যাজিকের এলিমেন্টসগুলো ওই রুমেই থাকতে পারে, কারণ ইএমএফ রিডার রুমের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় বিপ বিপ করেছিল।
এতসব কিছু মনে হওয়ার পর, বেজবাবা কাজলদের বাসাতে ফোন দেন। কাজলের বড় বোনকে বিস্তারিতভাবে ওনাদের তদন্তের ফলাফল জানান।
সবকিছু শুনে কাজলের বোন টিমের কাছে সমাধান জানতে চায় ৷
সুমন ভাই কাজলের বোনকে জানায়ঃ "আপা, আপনি সবার প্রথমে কালোজাদু কে করেছে সেটা বের করেন। যদি বের করতে পারেন, তাহলে ওই কালোজাদুকরই এই জ্বিন ছাড়াতে পারবে।"
"আপনি নাইমার রুমের বিছানা, বালিশ, আলমারি, জানালার পর্দা এসব তন্ন তন্ন করে দেখেন, আমি নিশ্চিত কালোজাদুতে ব্যবহৃত তাবিজ, চুল, সূতা, কাগজ ইত্যাদি ওখানেই পেয়ে যাবেন"
"ওগুলো পাওয়ার পর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবেন"
সব দিকনির্দেশনা পাওয়ার পর, কাজলরা ওই কালপ্রিটকে খোঁজার কাজ শুরু করে। শুরুতেই সন্দেহ হয়, তাদের এক বুয়ার উপর, যাকে চুরির অপরাধে তিন মাস আগে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছিল। জমিলা বুয়া ওদের বাসায় প্রায় ১৫ বছর ধরে কাজ করেছিল। বাড়ির নাড়িনক্ষত্র ওনার সব জানা।
বুয়াকে ডেকে আনানোর পর কালোজাদুর ব্যপারটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বুয়াকে বিভিন্ন ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয় ৷ এত এত জেরার মুখে পড়ে, বেশ কিছুক্ষণ পর জমিলা বুয়া বান মারার কথা স্বীকার করে। চাকরি থেকে ছাঁটাই করার প্রতিশোধ হিসেবে সে এই কাজ করে বলে জানায়। তাবিজ, মন্ত্র লিখা কাগজ সবকিছুই বের করে দেয় নাইমার রুম থেকে।
এরপর কালোজাদুর সবকিছু ছাদে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়।
ইন্টারেস্টিং ব্যপার হচ্ছেঃ তাবিজ, কাগজ পুড়িয়ে ফেলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই নাইমা কিছুটা স্বাভাবিকভাবে খাওয়া দাওয়া শুরু করে।
অল্প কয়েকদিনের মধ্যে কাজলের পরিবার স্বাভাবিক নাইমাকে ফিরে পেতে শুরু করে। শান্তির সুবাতাস ফিরে আসে কাজলের পরিবারে।
নাইমা ভাল হয়ে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর, কাজল বেজবাবাকে মিরপুর ১১ তে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যায় ৷ মজার ব্যপার হলঃ নাইমা বেজবাবাকে একেবারেই চিনতে পারেনি। জ্বিন ভর করা অবস্থাতে যে কথোপকথন হয়েছিল, তা নাইমার একদমই মনে নেই।
(রেডিও ফুর্তির ভূত এফএম প্রোগ্রামে প্রচারিত একটি গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই লিখা)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০২১ রাত ১২:০০