somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বাধিকার চেতনার রাজনৈতিক পরিভাষা ‘বিদ্রোহ’

৩০ শে মে, ২০১৪ দুপুর ১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

।। নাসীমুল বারী।।

প্রাণি জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশে। মরুর গাছ গরম সহ্য করতে শিখে। আমাদের দেশের আম গাছ মরুতে বাঁচতে পারে না। শ্বেতভল্লুক উত্তর মেরুর বরফ আস্তরণে অবলীলায় বসবাস করে, কিন্তু আমাদের দেশে কয়েক মিনিটও বেঁচে থাকবে না। আমাদের এখানে বাঁচবে না আরবীয় উট; বাঁচবে ভারতীয় উট। এ সবই পবিবেশের সহনশীলতা। এ সব প্রাণি যখনই বিরূপ পরিবেশে পড়ে— তখনই পরিবেশের কাছে আত্মসমর্পিত হয়ে মৃত্যুকে মেনে নেয়। এখানেই ব্যতিক্রম মানুষের। সৃষ্টির সেরা মানুষ বিরূপ পরিবেশে প্রতিরোধী আর প্রতিবাদী হয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে সদা তৎপর থাকে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে নিজের সত্তাকে বিকশিত করে। এমন যুদ্ধ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ— ইত্যাদির যুথসই শব্দ হল ‘বিদ্রোহ'।

মানুষের পরিবেশ বিরোধিতা দুই ধরনের। একটি প্রকৃতিগত, আরেকটি মনুষ্যসৃষ্ট। মনুষ্যসৃষ্ট পরিবেশের বিরোধিতা তারাই করে; যারা মানুষের একটি শ্রেণি বা গোষ্ঠী দ্বারা নিগৃহীত হয়, বঞ্চনার শিকার হয়। এ প্রতিবাদ তথা বিদ্রোহের ধরন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্য— বিবিধ উপায়ে বিবিধ পথে হয়।

সাহিত্য এমনি প্রতিরোধের একটি মাধ্যম। রাশিয়ার জারদের নির্মম নিষ্ঠুরতা বিরুদ্ধে জনসংগঠনের জন্য লেলিন যে আন্দোলন চালায়— সাহিত্য তার মূল ভূমিকা পালন করে। মাও সেতুং-এর বিপ্লবও সাহিত্যের ভূমিকায় বেড়ে ওঠে। ইসলামের শাশ্বত কল্যাণে ভারতীয় বা আরবীয় মুসলিম জাগরণে যে বিপ্লব গড়ে উঠে যথাক্রমে সাইয়েদ মওদূদী ও হাসানুল বান্নার নেতৃত্বে— তাও সাহিত্যের মাধ্যমেই জনমত সংগঠিত হয়েছে। এমনকি সপ্তম শতকে আবরে মুজাদ্দিদ ইমাম ইবনে তাইমিয়ার নেতৃত্বে ইসলামী সংস্কারের যে জাগরণ শাসকদের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সে আন্দোলন-সংস্কারও গতি পেয়েছিল সাহিত্যের বাতাবরণে। সাহিত্য দেশ-কাল-পাত্রে রাজনীতির বড় হাতিয়ার।

প্রাণি মাত্রই স্বাধিকার চায়। আর প্রকৃতিগতভাবে সবাই স্বাধীন— মানুষও, তবে একটু ভিন্ন ধাঁছে। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ একটা নিয়মের অধীনে তাকে থাকতে হয়। সমাজের এ নিয়মনীতিটা মানুষের মৌলিক চৈতনিক স্বাধীনতায় সুষম ধারায় বজায় থাকলেই স্বাধীন সত্তার সুফল বহন করতে পারে। কোন স্বার্থের কারণে অন্যমানুষ বা মানবগোষ্ঠী যদি চৈতনিক স্বাধীনতায় ব্যাঘাত ঘটায় তখনই মানুষ তার প্রকাশ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এ বঞ্চনা ক্ষুদ্র, মাঝারী, বৃহৎ— সব ধরনেরই হতে পারে। আমলের যোগ্য এমন ক্ষুদ্র বঞ্চনা যে কেউ মেনে নেয়। কিন্তু যে বঞ্চনা সত্যি তাকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে ফিরিয়ে দেয়, তাই স্বাধিকার লঙ্ঘনের রূপ। স্বাধিকার লঙ্ঘনের ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা দেখা দেয়। বঞ্চিত স্বাধিকারী প্রতিপক্ষ দ্বারা শোষিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়। ভুলুণ্ঠিত হয় মানবতা। শাষক শ্রেণিটি আইনের শক্তিতে বৃহত্তর হলেও সংখ্যাধিক্যে নেহায়তই কম। ফলে তারা একটি আইন-ক্ষমতায় এমন শোষণ নিপীড়ন চালায়।

শোষিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মানবতা এসব থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবিধানের চেষ্টা করে। এ সম্মিলিত প্রতিবিধানের রাজনৈতিক পরিভাষা দুটি— শাসকের কাছে ‘বিদ্রোহ' আর শোষিতের কাছে ‘স্বাধিকার আন্দোলন'। আর তাই স্বাধিকার আন্দোলনর প্রকাশ ঘটে ‘বিদ্রোহে'। অর্থাৎ শাষিতের বঞ্চনার বিরুদ্ধে শোষকশ্রেণির প্রতিবাদই ‘বিদ্রোহ।'

বিদ্রোহ যুগে যুগে মানবতাকে স্বাধিকার লাভের প্রেরণা যুগিয়েছে। বিদ্রোহ তাই বঞ্চিত-নিপীড়িত মানবতায় প্রিয় সঙ্গ। প্রেরণার শক্তি। রাজনৈতিক পরিভাষায় ‘বিদ্রোহ' শব্দটি প্রচ- শক্তির আঁধার। অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যে বাংলা নামের ভৌগোলিক এলাকাতে যখন বৃটিশ ঔপনিবেশিকরা আমাদের মনুষ্যত্ব, স্বাধিকার ভুলুণ্ঠিত করে টুটি চেপে ধরে— তখন এদেশে হাসানুল বান্না, লেলিন, স্ট্যালিনের মত শক্তিমান লেখক-রাজনীতিবিদ তত্ত্বজ্ঞানের কোন নেতৃত্ব গড়ে উঠে নি। তবু প্রচলিত রাজনীতিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে নেপথ্যে সাহিত্য নিয়ে যিনি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের তাপ ছড়ান— তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। এক হাতে বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ তূর্য নিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল চূর্ণ করার দুর্নিবার আকাঙ্খায় প্রচ- দ্রোহের অপরিমেয় শক্তিতে বাংলা সাহিত্যে অভ্যুদ্বয় ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের।

কাজী নজরুল ইসলাম এ দেশের বৃটিশ বেনিয়াদের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বঞ্চিত মানবতার পক্ষে বিদ্রোহের ঝড় তুলেছেন সাহিত্যের পংক্তিমালায়। নজরুলের এ বিদ্রোহ একদিকে শিল্প হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে শাষিতের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাই বৃটিশ অপাংতেয় শাসকগোষ্ঠী ভীত হয়ে ক্ষমতার আইনীতে নজরুলকে অনেক ‘জ্বালাতন' করেছে। তারপরও ভারতবর্ষের আপামর জনতার মন থেকে বিদ্রোহের আগুন নেভাতে পারে নি।

রাজনৈতিক ‘বিদ্রোহ'কে সাহিত্যশিল্পের অনুপম সৌন্দর্যে অনুভূতির আবেগে সাজিয়ে অমরত্ব দিয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী নজরুল ইসলাম তাই যথার্থই ‘বিদ্রোহী' সত্তার এক সাহিত্য সৈনিক। তাঁর বিদ্রোহ শুধু ভারতবর্ষের শোষিত জনগণের জন্যেই নয়— মানবতার সকল স্তরের মানুষের শোষণের বিরুদ্ধে। তাঁর বিদ্রোহ শাশ্বত। দেশ-কালের ঊর্ধে অনন্ত পথের দিশারী।

একজন লেখক তার পারিপার্শিক পরিবেশে নিজের মানস গঠন করে। তার মানস প্রকৃতিই তার লেখনীতে বিকাশ লাভ করে। কাজী নজরুল ইসলামের মানস-প্রকৃতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখি তাঁর সংবেদনশীল ও সহজগ্রাহী হৃদয়ের সচেতন এবং প্রচ- বোধশক্তি। অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার সাহায্যে তিনি যুগধর্মকে গ্রহণ করেছেন এবং যথার্থ প্রতিবিম্বিত করেছেন। পাঠক সমাজ উৎকণ্ঠিত হয়েছে, উৎসাহিত হয়েছে, উজ্জীবিত হয়েছে, উদ্বেলিত হয়েছে অধিকার প্রতিষ্ঠার তীব্র আকাক্সক্ষায়।

সমাজ ও স্বদেশের প্রতি লেখকদের একটা দায়বদ্ধতা থাকে। সমাজ-স্বদেশের গতিপথকে একটা বোধ-চেতনায় চালিত করার স্বপ্ন দেখে লেখক তথা কবি-সাহিত্যিকরা। যুগের চরিত্রধর্ম, দর্শন, সমাজের অসংগতির উপলব্ধি, সমাজ শাসনের পরাধীনতার প্রকাশ— এমন অন্তর্দৃষ্টি যে লেখনীতে উঠে আসে এবং মানবতাকে এমন দৃষ্টির নেতিবাচকতা থেকে মুক্তি দিতে চায়; সে লেখকসত্তাই প্রকৃত সমাজ মুক্তির লেখকসত্তা। নজরুলের লেখনীর স্বরূপ বিশ্লেষণে এমন প্রকৃত সত্তার বিকাশটাই ‘বিদ্রোহ' রূপে জ্বলে উঠে তাঁর সাহিত্যের পরতে পরতে। প্রচ- স্বদেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে নির্ভীকভাবে বিদ্রোহ-বিপ্লবকে আহ্বান করেছেন সমাজকে, মানবতাকে মুক্তি দিতে। তাঁর এ ‘সাহিত্য বিদ্রোহ'ই জনতার স্বাধিকার আন্দোলনের রাজনৈতিক পরিভাষা হয়ে ওঠে। আর তাই নজরুলের কবিতা সর্বজনীনতা লাভ করেছিল মুক্তির আনন্দ গ্রহণ করার মানসে। নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা সমসাময়িক সমাজ, দেশ ছড়িয়ে বিশ্বকেও আলোড়িত করেছিল। তত্ত্বজ্ঞানের সাহিত্য নয়— মনের অনুভূতির নৈকট্যে কাব্যকলার অনুপম সুর-ছন্দে এ বিদ্রোহ মানস মনকে অগ্নিদীক্ষায় উদ্দীপিত করেছিল।

ঔপনিবেশিক শাসকদের কূটচাল প্রতিহত করে স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করতে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। ধর্মবিশ্বাস কিছুটা হলেও জাতীয় ঐক্যকে বিভেদে ফেলেছে। ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শক্তি ধর্মবিশ্বাসের ধারাটাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিরোধকে জিইয়ে রেখে কিংবা কখনো উস্কে দিয়ে নিজেদের স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট ছিল। নজরুলের দৃষ্টি এ কূটকৌশল এড়ায় না। তিনি স্পষ্টত দেখেন উপমহাদেশে ধর্মীয় বিভক্তিতে ঔপনিবেশিকদের লাভালাভ। তিনি সাথে সাথে কলম ধরেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আহ্বানে। তিনি মনের কৌণিক অনুভূতিতে উপলব্ধি করেছেন মানবধর্ম ও মানবপ্রেমের ঐক্যই ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধিকারের শক্তিশালী পথ। আর এমন চেতনা থেকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের চেতনা তৈরিও প্রচলিত যুগধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলেই মনে হয়েছে। অথচ এ বিদ্রোহ সমাজ-দেশের স্বার্থে সংগঠিত। এমন বিদ্রোহ শুধু একটি কাল বা ক্ষণের জন্যে নয়; যুগ-কালের ঊর্ধে ভৌগোলিক গণ্ডি বদ্ধতার বাইরে মানবতার ঐক্যের এক জয়গান। দেশবাসীর স্বাধীনতার দাবি জোরালো কণ্ঠে ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববাসীর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হওয়া কিছুমাত্র অস্বাভাবিক বা অপ্রত্যাশিত ছিল না। এখানে এসেই বিদ্রোহ ‘জয়গানে' রূপান্তরিত হয়েছে। একমাত্র নজরুলই সে রূপান্তরের রূপকার। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার ঊর্ধে শক্তিশালী এক মানবতা। এ প্রসঙ্গে নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘নজরুল হিন্দু, মুসলমান উভয় ঐতিহ্য থেকেই কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করেছেন আর সেকারণেই তিনি একমাত্র মুসলমান সাহিত্যিক যার সাহিত্য-কর্ম উভয় সমাজেই আদৃত হয়েছে।'' [নজরুল প্রসঙ্গে; রফিকুল ইসলাম, প্রকাশকাল, আগস্ট-১৯৯৮; নজরুল ইন্সষ্টিটিউট, ঢাকা।]

‘বিদ্রোহী' কবিতাটি প্রকাশের মাধ্যমেই কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী কবি' অবিধায় আপামর মানুষের মধ্যে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯২২ সালে বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথমে ‘মোসলেম ভারতে' ছাপা হয়ে সে সময়ে শুধু সাহিত্যমোদীই নয়— আপামর জনসাধারণের মাঝে এক নব চেতনার উন্মেষ ঘটায়। সে থেকেই কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি রূপে আখ্যাত। বিদ্রোহী কবি তিনি অবশ্যই, তবে একই সঙ্গে তিনি প্রেমিক কবিও। মানবপ্রেমিক। নজরুলের বিদ্রোহ আর মানবপ্রেম অভিন্ন। একই উৎস থেকে এই দুই সত্তার উদ্ভব। মনের মানস সত্তা মানবপ্রেমী না হলে বিদ্রোহী হতে পারে না। মানবপ্রেমই বিদ্রোহের সঞ্চালিকা শক্তি। মানব প্রেমের তীব্র অনুভূতিটা অন্যায় অবিচারে বিপর্যস্ত হবার পর্যায়ে এলেই মনের ভিতর জেগে ওঠে সেই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বাসনা। আর সেই প্রতিবাদের আবেগই মানুষকে বিদ্রোহের পথে ঠেলে দেয়। বিদ্রোহ হয়ে উঠে রাজনৈতিক পরিভাষা। বিদ্রোহ প্রতিকারের সন্ধান করে, প্রতিবিধানের রাস্তা খোঁজে। স্বাধিকারের প্রেরণা দেয়। এমন বিদ্রোহ চেতনা মানব প্রেমে জাগ্রত হয়ে সাহিত্যের পথে বিকশিত হয়। সাহিত্য তখন হয়ে ওঠে শিল্প আর বিদ্রোহের সম্মিলনে এক অনুপম সৃষ্টিধারা।

নজরুল তাঁর কাব্যে তৎকালীন বাঙালি সমাজের উচ্চবিত্তের কৌলিণ্যের অহংকারেও আঘাত হেনেছিলেন। বিদ্রোহী কবিতায় ‘আমি' কথাটি তার গর্বোদ্দত ‘আমি' নয়। এ ‘আমি' স্বাধিকারের প্রশ্নে উৎপীড়িত, লাঞ্ছিত গণমানুষের প্রতীক। এমন সব মানুষের মুক্তি আর মানস স্বকীয়তার প্রত্যয় জাগ্রত করাই ‘বিদ্রোহ'— যা ‘আমি' রূপকে প্রতিভাত হয়েছে। তাই শুধু ‘বিদ্রোহী' কবিতা লিখেই তিনি ‘বিদ্রোহী' খ্যাতি পেয়েছেন, এমনটি নয়। মানুষের মানস স্বকীয়তার স্বাধিকার অর্জনের কাব্যকলাই তাঁকে অধিকতর ‘বিদ্রোহী' খ্যাতি দিয়েছে। তাঁর এ বিদ্রোহ ‘আমি'র প্রচণ্ড গতি পেয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের পরতে পরতে ঢুকে পড়েছে। গণমানুষের স্বাধিকারের ভাষা খুঁজে পেয়েছে। কেঁপে উঠেছে শোষিতের ভীত। সাম্রাজ্যবাদী শোষকশ্রেণির চেতনায় আঘাত হানে টর্ণেডো গতিতে। নজরুলের এ বিদ্রোহত্ব শুধু কাব্যভাষার সুর-ছন্দেই নয়; গণমানুষের রাজনৈতিক প্রত্যয়েও সমুজ্জ্বল। মানুষের প্রতি ভালবাসা মনুষ্যত্বের স্বাধিকারকে জাগ্রত করে বিদ্রোহের স্বরূপে প্রকাশ পায়। পৃথিবীর সকল বিদ্রোহী বিপ্লবীরাই মানবপ্রেমিক। আর শাষিত শক্তি রাষ্ট্র-আইনের শক্তিতে হয়ে উঠে স্বার্থপ্রেমিক। নিজের স্বার্থের কাছে মানবতা তুচ্ছ। এজন্যে বিদ্রোহের ভিন্ন রূপটাই মানবতার স্বাধিকারের সংগ্রাম। নজরুল সে সংগ্রামের একজন শিল্প নির্দেশক। শিল্প কুশলী। তাঁর এ শিল্প ভাবনা, শিল্প সৃষ্টি সময়-কালকে উৎরিয়ে আজ বহু ঊর্ধে অবস্থান করছে সর্বজনীনতা নিয়ে। মানবতার স্বাধিকারের বিপরীত রূপ ‘বিদ্রোহ' রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে অপরাধ। ভয়ঙ্কর। শাস্তিযোগ্য কর্তযজ্ঞ। সেই নেতিবাচক সত্তাকে ইতিবাচক রূপে মানবতার কল্যাণে পরিবর্তন করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। সাহিত্যে তাই এক নবধারায় নিজেকে তুলে এনেছেন শোষিত, নির্যাতিত মানবতার আশার আলো হয়ে। স্বাধিকার চেতনার রাজনৈতিক পরিভাষা এই ‘বিদ্রোহ' কাজী নজরুল ইসলামকে সময়ের ঊর্ধ্বেও অমর করেছে।

আজ এদেশে ‘বৃটিশ ঔপনিবেশিকরা আমাদের মনুষ্যত্ব, স্বাধিকার ভুলুণ্ঠিত করে টুটি চেপে ধরে’ নি সত্য তাদের প্রেতাত্মারা আছে। এসব প্রেতাত্মা আজ বৃটিশদের চেয়েও বেশি শক্তিশালী শোষক— তাই ৪-৫ বছরেই শোষিত সম্পদ তিন-চারশ গুণ বেড়ে ওঠে। অদ্ভুত এ শোষণ। স্বজাতির নেকাবপরা এরা ভৌগোলিক স্বাধীনতায় আগ্রাসন চালায় না। আগ্রাসন চালায় আইন ও বিধির কুটকৌশলে। আজকের স্বাধিকার চেতনার রাজনৈতিক পরিভাষা কি ‘বিদ্রোহ'? কার সাথে বিদ্রোহ? আজকের শোষকদের দেখতে, এদের কথা শুনতে স্বজাতির মতই নির্মল ভালোমানুষী মনে হয়। শুভাকাঙ্খি মনে হয়। তাহলে বিদ্রোহটা হবে কার সাথে। জানি না আজ নজরুল থাকলে এদের কী বিশেষণে চিত্রিত করতেন!!

এমনসব ঔপনিবেশিকীয় চেতনার জন্য আজ বড় প্রয়োজন একজন কাজী নজরুল ইসলামের।

(জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা)
#

অন্যান্য প্রবন্ধগুলো পড়তে টোকা দিন :
লেখকের স্বাধীনতা
‘লিঙ্গ’-এর বৈয়াকরণিক পরিবর্তন : একটি প্রস্তাবনা
অনুভবের অনুরণনে আমার প্রিয় স্কুল
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×