
আলহামদুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহি লা- তারা-হুল উইয়ূ-ন, ওয়ালা- তুখ-লিতুহুজ্জুনূ-ন, ওয়ালা- ওয়াসিফুহুল ওয়াসিফূ-ন। অচ্ছলা-তু অচ্ছালা-মু আলা মাল্লা- নাব্যিা বা'দাহু। মাহে রামাদানের একটি মাস সিয়াম সাধনা করা আল্লাহ পাক প্রদ্ত্ত অন্যতম হুকুম। ইসলামের গুরুত্বপূর্ন ফরজ ইবাদত। অনেকেরই রমাদানের বিবিধ হুকুম আহকামের বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকায় তারা সঠিকভাবে সাওম পালন করতে ব্যর্থ হন এবং যার ফলে তারা উপযুক্ত পারিশ্রমিক তথা, প্রাপ্য যথাযথ সাওয়াব অর্জনে ব্যর্থ হন। মূলত: এই দিকটিকে সামনে রেখেই এখানে আমরা সিয়ামের গুরুত্বপূর্ন কিছু বিধান নিয়ে আলোচনা করব ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহ পাক আমাদের রমাদানুল মুবারাকের পরিপূর্ন বরকত, রহমত, মাগফিরাত এবং সর্বোপরি তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন।
সাহরী খাওয়া সে তো ক্ষুধা নিবারন: এটাও ইবাদাত!
মাখলুকের প্রতি স্রষ্টার কত দয়া! আল্লাহ পাকের কত দয়া আমাদের প্রতি! ইসলামী জীবন জিন্দেগীকে তিনি সহজ করে দিয়েছেন। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে অকল্পনীয় সাওয়াব অর্জনের অজস্র সুযোগ রেখে দিয়ে আমাদের ধন্য করেছেন। এই যেমন পবিত্র মাহে রমদানে আমরা সাহরী খেয়ে সিয়াম পালন করি। সাহরী খাই আমাদের নিজেদের ক্ষুধা মেটানোর প্রয়োজনে, অথচ আল্লাহ পাক এ কাজটিকে বানিয়ে দিয়েছেন ইবাদাত। আহ! কি আশ্চর্য্য, সাহরী খেলে আল্লাহ পাক খুশি হন। শুধু খুশিই হন না, এর বিনিময়ে সাওয়াবও দেন তিনি বান্দাকে। অনেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহরী খেতে নির্দেশ দিয়েছেন। এক হাদীসে তিনি বলেন:
السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلا تَدَعُوهُ وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جُرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ
“সাহরী খাওয়া বরকত; কাজেই তোমরা তা ছাড়বে না; যদি এক ঢোক পানি পান করেও হয় তবুও; কারণ যারা সাহরী খায় তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণ সালাত (রহমত ও দুআ) প্রদান করেন।” আহমদ, আল-মুসনাদ ৩/১২, ৪৪; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৮/২৪৫; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৫৮। হাদীসটি হাসান।
ইফতারিতে সাধারনত: আমরা খেজুর খেয়ে থাকি। সাহরীতেও এটা সম্ভব হলে বরকতান রাখা যেতে পারে। কেননা, কোনো কোনো হাদীসে সাহরীতে খেজুর খেতে উৎসাহিত করা হয়েছে। সাহরী খাওয়ার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বরকতময় অভ্যাস ছিল, তিনি একেবারে শেষ মুহূর্তে সাহরী খেতেন। হযরত যাইদ ইবনু সাবিত রাদিআল্লাহু তাআ'-লা আনহু বলেন:
تَسَحَّرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ثُمَّ قُمْنَا إِلَى الصَّلاةِ قُلْتُ كَمْ كَانَ قَدْرُ مَا بَيْنَهُمَا قَالَ خَمْسِينَ آيَةً
“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সাথে সাহরী খেলাম এরপর ফজরের সালাতে দাঁড়ালাম। যাইদ রাদিআল্লাহু তাআ'-লা আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হলো, মাঝে কতটুকু সময় ছিল? তিনি বলেন ৫০ আয়াত তিলাওয়াতের মত।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৭৮; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৭১।
তাড়াতাড়ি ইফতার: অব্যহত কল্যাণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর বরকতপূর্ন আদত হল, সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা। তিনি এত তাড়াতাড়ি ইফতার করতেন যে, অনেক সময় সাহাবীগণ বলতেন, 'হে আল্লাহর রাসূল, সন্ধ্যা হোক না, এখনো তো দিন শেষ হলো না!'
তিনি বলতেন, 'সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই ইফতার করতে হবে।'
একাধিক হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাহাবীগণ রাদিআল্লাহু তাআ'-লা আনহুম সর্বদা শেষ সময়ে সাহরী খেতেন এবং সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لا يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ
“যতদিন মানুষ সুর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণে থাকবে।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৯২; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৭১।
إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِيَاءِ أُمِرْنَا بِتَعْجِيْلِ فِطْرِنَا وَتَأْخِيْرِ سُحُوْرِنَا
“আমরা নবীগণ আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রথম সময়ে ইফতার করতে ও শেষ সময়ে সাহরী খেতে।” হাইসামী, মাজামউয যাওয়াইদ২/১০৫, ৩/১৫৫। হাদীসটির সনদ সহীহ।
খেজুর: ইফতারির অপরিহার্য্য অনুসঙ্গ
ইফতারির আইটেম হিসেবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর পছন্দ করতেন। এ বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইফতারের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নির্দেশ হলো খেজুর মুখে দিয়ে ইফতার করা। তিনি স্বয়ং সম্ভব হলে গাছ পাকা টাটকা রুতাব খেজুর, না হলে খুরমা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। খেজুর না পেলে তিনি পানি মুখে দিয়ে ইফতার করতেন। তিনি ইফতারিতে তিনটি খেজুর খেতে পছন্দ করতেন। যিয়া মাকদিসী, আল-মুখতারাহ ৫/১৩১-১৩২; হাইসামী, মাজমাউয ৩/১৫৫-১৫৬।
সাহরীতে একে অন্যকে ডেকে তোলা: বরকতময় এক রীতি
এক সময় ঘরে ঘরে গিয়ে রোজাদারদের একজন আরেকজনকে ডেকে উঠাতেন। আলহামদুলিল্লাহ, মাইক আবিষ্কার হওয়ার কারনে পদ্ধতি সহজ হয়েছে। মহল্লায় মহল্লায় প্রত্যেক মসজিদে মাইক রয়েছে। মাইক দিয়ে অনায়াসে মহল্লাবাসীকে সজাগ করার জন্য সাহরীতে ডেকে উঠানো যায়। সাহরীর সময় রোযাদারদের ডাকা মুসলিম উম্মাহর একটি বরকতময় ঐতিহ্যবাহী রীতি। তবে ঐতিহ্যবাহী এই রীতিটির ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হবে, সাওয়াব অর্জনের উদ্দেশ্যে মহল্লাবাসীকে সাহরীতে ডাকতে গিয়ে সেটা যেন কারও কারও কাছে বিরক্তির কারন কিংবা কষ্টের বিষয় হিসেবে আবির্ভূত না হয়। ডাকার উদ্দেশ্য হল, যারা সাহরী খেতে চান তাদের ঘুম ভাঙ্গাতে সাহায্য করা। এরজন্য ফজরের আযানের সর্বোচ্চ ঘন্টাখানেক আগে কিছু সময় ডাকাডাকি করাই যথেষ্ট। কিন্তু দেখা যায়, বর্তমানে অনেক মসজিদে শেষ রাতে এক দেড় ঘন্টা একটানা গজল-কিরাআত পড়া হয় ও লোকদের ডাকাডাকি করা হয়। বিষয়টি খুবই নিন্দনীয় ও আপত্তিকর। অনেকেই সাহরীর এই বরকতময় সময়টিতে খাওয়ার আগে বা পরে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করেন, কেউ বা তিলাওয়াত করেন, কেউ এমন থাকতে পারেন, যিনি সাহরী খেয়ে কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নেন, কারণ সকালে তার কাজ থাকে, এছাড়া অনেক অসুস্থ মানুষ সমাজে বসবাস করে থাকেন। ক্ষেত্র বিশেষে অনেক অমুসলিম ব্যক্তি বর্গ সমাজে থেকে থাকেন, এদের প্রত্যেকেরই এরূপ একটানা আওয়াজে বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। মাখলূকের হক্কের প্রতি, বান্দার অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রাখা আমাদের অবশ্যই একান্ত প্রয়োজন।
রামাদান: সাওয়াব অর্জনেরই মাস
সাহরী এবং ইফতার গ্রহনের অর্থ এই নয় যে, সারাদিন যেহেতু খেতে পারব না, সেহেতু এ দু'সময়ে কয়েকগুণ বেশি পরিমানে খেয়ে নিব আর সারাদিন জাবর কাটতে থাকব! এরূপ খেলে তো সিয়ামের মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হলো। সাহরী ও ইফতার খাওয়ার জন্য আলাদা বিশেষ কোনো খাবারের প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিকভাবে বছরের অন্যান্য সময়ে, অন্যান্য দিনগুলোতে যেসব খাবার আমরা গ্রহন করি, রমাদানেও তাই খাওয়া উচিত। আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে, সাহরী ও ইফতারীতে বা রামাদানে যা খাওয়া হবে তার হিসাব হবে না। এজন্য আমরা রামাদান মাসকে খাওয়ার মাস বানিয়ে ফেলেছি। বস্তুত, হিসাব হবে কি না তা চিন্তা না করে, সাওয়াব কিসে বেশি হবে তা চিন্তা করা দরকার।
খাওয়ার নয়; রামাদান মাস মূলত খাওয়ানোর মাস ছিল। রোজাদার এবং অভাবী লোকদের খাওয়ানোর নির্দেশ রয়েছে হাদীসে। প্রথমত দরিদ্রদেরকে খাওয়ানো এবং দ্বিতীয়ত রোযাদারকে ইফতার খাওয়ানো। ইফতার করানোর বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ غَيْرَ أَنَّهُ لا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا
“যদি কেউ কোনো রোযাদারকে ইফতার করায়, তাহলে সে উক্ত রোযাদারের সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তবে এতে উক্ত রোযাদারের সাওয়াব একটুও কমবে না।” তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৭১। তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।
ইফতার পার্টির নামে অপচয় অপব্যয় কাম্য নয়
ইফতার করানো এখন আনুষ্ঠানিকতা নির্ভর হয়ে উঠেছে। অথচ ইফতার ছিল সাওয়াব অর্জনের জন্য; আনুষ্ঠানিকতার জন্য নিশ্চয়ই নয়। দরিদ্র সাহাবী-তাবিয়ীগণ নিজের ইফতার প্রতিবেশীকে দিতেন এবং প্রতিবেশীর ইফতার নিজে নিতেন। এরকমটা হলে এতে প্রত্যেকেই ইফতার করানোর সাওয়াব পেতে পারেন। অনেকে নিজের সামান্য ইফতারে একজন মেহমান নিয়ে বসতেন। আমাদের সকলেরই চেষ্টা করা দরকার, নিয়মিত নিজেদের খাদ্য-খাবার থেকে সামান্য বাঁচিয়ে যাতে অন্যদের ইফতার করাতে পারি। বিশেষ করে দরিদ্র, কর্মজীবি, রিকশাওয়ালা, কুলি, মুটে, মজুরদের অনেকেই কষ্ট করে রোযা রাখেন এবং ইফতার করতেও তাদের কষ্ট হয়। সাধ্যমত নিজেদের খাওয়া দাওয়ার পরিমান কিছুটা কমিয়ে এদেরকে খাওয়ানো দরকার। আল্লাহ পাক আমাদের তাওফিক দিন।
হাদীস অধ্যয়নে আমরা জানতে পারি যে, রামাদান মাসে যারা সিয়াম পালন করেন, অর্থাত, রোজাদারগন দু'টি শ্রেণীতে বিভক্ত। এক শ্রেণীর মানুষদের পূর্ববর্তী সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হয়। অন্য শ্রেণী ক্ষুধা-পিপাসায় কষ্ট করা ছাড়া কিছুই লাভ হবে না। প্রথম শ্রেণীর রোযাদারদের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং আল্লাহর নিকট সাওয়াব অর্জনের খাঁটি নিয়্যাতে রামাদানের সিয়াম পালন করবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।” বুখারী, আস-সহীহ ১/২২, ২/৬৭২, ৭০৯; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫২৩।
দ্বিতীয় শ্রেণীর রোযাদারদের বিষয়ে তিনি বলেন:
رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلاَّ الْجُوعُ وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلاَّ السَّهَرُ
“অনেক সিয়াম পালনকারী আছে যার সিয়াম থেকে শুধু ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া আর কোন লাভ হয় না। এবং অনেক কিয়ামকারী বা তারাবীহ-তাহাজ্জুদ পালনকারী আছে যাদের কিয়াম-তারাবীহ থেকে শুধু রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কোনোই লাভ হয় না।” ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৫৩৯; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৬২। হাদীসটি সহীহ।
এরূপ রোযাদারদের প্রতি বদদোয়া করে তাদের দুর্ভাগ্যের কথা জানিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
بَعُدَ مَنْ أَدْرَكَ رَمَضَانَ فَلَمْ يُغْفَرْ لَهُ
“যে ব্যক্তি রামাদান মাস পেল, কিন্তু এই মাসে তাকে ক্ষমা করা হলো না সেই ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে চির-বঞ্চিত বিতাড়িত।” হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/১৭০; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ২/১৪০-১৪১; আলবানী সহীহুত তারগীব ১/২৬২। হাদীসটি সহীহ।
আমাদের ভাবতে হবে: আমরা কোন দলে যেতে চাই?
আলহামদুলিল্লাহ। আমরা যারা রামাদানের সিয়াম পালন করতে যাচ্ছি আমাদের একটু ভাবতে হবে, আমরা কোন্ দলে পড়ব। আর তা জানতে হলে রোযা বা সিয়ামের অর্থ বুঝতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
لَيْسَ الصِّيَامُ مِنَ الأَكْلِ وَالشُّرْبِ إِنَّمَا الصِّيَامُ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ
“পানাহার বর্জনের নাম সিয়াম নয়। সিয়াম হলো অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ বর্জন করা।” ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৮/২৫৫; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৫৯৫; আলবানী, সহীহহুত তারগীব ১/২৬১। হাদীসটি সহীহ।
তাহলে বুঝুন এবং ভাবুন। ভেবে দেখুন- চিন্তাহীন, অনুধাবনহীন, সৎকর্মহীন পানাহার বর্জনকে “উপবাস” বলে গণ্য করা যেতে পারে, তবে ইসলামী বিধান “সিয়াম” বলা যাবে না। জেনে রাখা প্রয়োজন, হারাম বা মাকরূহ কাজ কর্মে রত থেকে, সারা দিন কানে এয়ারফোন লাগিয়ে ফিল্মের গান শুনে, হালাল খাদ্য ও পানীয় থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখার নাম সিয়াম কখনও নয়। সিয়াম অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সকল হারাম, মাকরূহ ও পাপ বর্জন করার সাথে সাথে হালাল খাদ্য, পানীয় ও সম্ভোগ থেকেও নিজেকে বিরত রাখা। এভাবে হৃদয়ে সার্বক্ষণিক আল্লাহ সচেতনতা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির দিকে লক্ষ্য রেখে শত প্রলোভন ও আবেগ দমন করে সততা ও নিষ্ঠার পথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য সিয়াম। যদি আপনি কঠিন ক্ষুধা বা পিপাসায় কাতর হয়েও আল্লাহর ভয়ে ও তাঁর সন্তুষ্টির আশায় নিজেকে খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত রাখেন, অথচ সামান্য রাগের জন্য গালি, ঝগড়া ইত্যাদি হারাম কাজে লিপ্ত হন, মিথ্যা অহংবোধকে সমুন্নত করতে পরনিন্দা, গীবত, চোগলখুরী ইত্যাদি ভয়ঙ্কর হারামে লিপ্ত হন, সামান্য লোভের জন্য মিথ্যা, ফাঁকি, সুদ, ঘুষ ও অন্যান্য যাবতীয় হারাম নির্বিচারে ভক্ষণ করেন, তাহলে আপনি নিশ্চিত জানুন যে, আপনি সিয়ামের নামে আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে লিপ্ত আছেন। ধার্মিকতা ও ধর্ম পালনের মিথ্যা অনুভতি ছাড়া আপনার কিছুই লাভ হচ্ছে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ وَالْجَهْلَ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ
“যে ব্যক্তি পাপ, মিথ্যা বা অন্যায় কথা, অন্যায় কর্ম, ক্রোধ, মূর্খতাসুলভ ও অজ্ঞতামুলক কর্ম ত্যাগ করতে না পারবে, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” বুখারী, আস-সহীহ ২/৬৭৩, ৫/২২৫১।
আল্লাহ ছুবহানাহু ওয়াতাআ'লা- কুরআনে বলেছেন, 'তোমরা রোযার সময় দিবসে পানাহার করো না।' এর পরের আয়াতেই আল্লাহ বললেন, 'তোমরা অপরের সম্পদ অবৈধভাবে “আহার” করো না।' এখন আপনি প্রথম আয়াতটি মেনে দিবসে আপনার ঘরের খাবার আহার করলেন না, কিন্তু পরের আয়াতটি মানলেন না, সুদ, ঘুষ, জুলুম, চাঁদাবাজি, যৌতুক, মিথ্যা মামলা, যবর দখল, সরকারি সম্পত্তি অবৈধ দখল ইত্যাদি নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে অন্যের সম্পদ “আহার” করলেন, তাহলে আপনি কেমন রোযাদার?
গীবত: কবিরা গোনাহ অর্জনের এক মহাব্যধি
একটি বিশেষ “আহার” হলো “গীবত”। “গীবত” শতভাগ সত্য কথা। যেমন লোকটি বদরাগী, লোভী, ঘুমকাতুরে, ঠিকমত জামাতে নামায পড়ে না, অমুক দোষ করে, কথার মধ্যে অমুক মুদ্রা দোষ আছে ইত্যাদি। এরূপ দোষগুলি যদি সত্যই তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবে তার অনুপস্থিতিতে তা অন্য কাউকে বলা বা আলোচনা করা “গীবত”। আল্লাহ বলেছেন, গীবত করা হলো মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া। মৃতভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করার মতই “গীবত” করা সর্ববস্থায় হারাম। উপরন্তু সিয়ামরত অবস্থায় গীবত করলে “মাংস খাওয়ার” কারণে সিয়াম নষ্ট হবে বা সিয়ামের সাওয়াব সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে।
রমজানে একটি ফরজ সত্তুরটি ফরজের সমান: একটি নফল একটি ফরজের সমান
সিয়াম শুধু বর্জনের নাম নয়। সকল হারাম ও মাকরূহ বর্জনের সাথে সাথে সকল ফরয-ওয়াজিব ও যথাসম্ভব বেশি নফল মুস্তাহাব কর্ম করাই সিয়াম। বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে, রামাদান মাসে নফল-ফরয সকল ইবাদতের সাওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এজন্য সকল প্রকার ইবাদতই বেশি বেশি আদায় করা দরকার। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রামাদান মাসে উমরা আদায় করা রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে হজ্জ করার সমতুল্য। যদি কেউ রোযা অবস্থায় দরিদ্রকে খাবার দেয়, অসুস্থ মানুষকে দেখতে যায় এবং জানাযায় শরীক হয় তবে সে ব্যক্তিকে আল্লাহ জান্নাত দান করবেন। এ ছাড়া হাদীসে রামাদানে বেশি বেশি তাসবীহ, তাহলীল, দুআ ও ইসতিগফারের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, রোযা অবস্থার দুআ ও ইফতারের সময়ের দুআ আল্লাহ কবুল করেন।
দু'টি ইবাদাত রমাদানে বেশি করে করতে বলা হয়েছে হাদিসে
বিশেষভাবে দু প্রকারের ইবাদত রামাদানে বেশি করে পালন করতে হাদীসে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, দান। “সাদকা” বা দান আল্লাহ তাআলার প্রিয়তম ইবাদত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, সাদকার কারণে মুমিন অগণিত সাওয়াব লাভ ছাড়াও অতিরিক্ত দুটি পুরস্কার লাভ করেন: প্রথমত দানের কারণে গোনাহ ক্ষমা করা হয় এবং দ্বিতীয়ত দানের কারণে আল্লাহর বালা-মুসিবত দূর হয়। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে, দুজন মানুষের মধ্যে বিবাদ মিটিয়ে দেওয়া, ন্যায় কর্মে নির্দেশ দেওয়া, অন্যায় থেকে নিষেধ করা, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক দ্রব্য বা বস্তু সরিয়ে দেওয়া, বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করা বা যে কোনোভাবে মানুষের উপকার করাই আল্লহর নিকট সাদকা হিসাবে গণ্য। রাসূলুল্লাহ সা. সর্বদা বেশি বেশি দান করতে ভালবাসতেন। আর রামাদান মাসে তাঁর দান হতো সীমাহীন। কোনো যাচ্ঞাকারীকে বা প্রার্থীকে তিনি বিমুখ করতেন না।
আমাদের অল্পে তুষ্টির গুন অর্জন করতে হবে
রামাদান এলেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ ৯০% মুসলমানদের দেশ। এদেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী মুসলিম। অধিকাংশ ব্যবসায়ী রোযা রাখেন এবং দান করেন। কিন্তু আমাদের দান হালাল উপার্জন থেকে হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। গুদামজাত করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা বা স্বাভাবিকের বাইরে অতিরিক্ত দাম গ্রহণের মাধ্যমে ক্রেতাদের জুলুম করা নিষিদ্ধ। হারাম বা নিষিদ্ধভাবে লক্ষ টাকা আয় করে তার থেকে হাজার টাকা ব্যয় করার চেয়ে হালাল পদ্ধতিতে হাজার টাকা আয় করে তা থেকে দু-এক টাকা ব্যয় করা অনেক বেশি সাওয়াব ও বরকতের কাজ। এ ছাড়া অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে। আমরা জানি, মানুষের কল্যাণে ও সহমর্মিতায় যা কিছু করা হয়, সবই দান। যদি কোনো সৎ ব্যবসায়ী যদি রামাদানে ক্রেতা সাধারণের সুবিধার্থে তার প্রতিটি পন্যে এক টাকা কম রাখেন বা নায্যমূল্যে তা বিক্রয় করেন তাও আল্লাহর নিকট অত্যন্ত বড় সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।
রমাদান কুরআন নাযিলের মাস: কুরআনের সুমধুর তিলাওয়াতে মাতিয়ে রাখুন মন
রামাদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো কুরআন তিলওয়াত। বিগত খুতবায় আমরা এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছি। রামাদানে দু ভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে: প্রথমত কুরআন কারীম দেখে দেখে দিবসে ও রাতে তিলাওয়াত করতে হবে। সাহাবী-তাবিয়ীগণ রামাদানে এভাবে তিলাওয়াত করে কেউ তিন দিনে, কেউ ৭ দিনে বা কেউ ১০ দিনে কুরআন খতম করতেন। আমাদের সকলকেই চেষ্টা করতে হবে রামাদানে কয়েক খতম কুরআন তিলাওয়াতেরর। তিলাওয়াতের সাথে তা বুঝার জন্য অর্থ পাঠ করতে হবে। কুরআনের অর্থ বুঝা, চিন্তা করা ও আলোচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যার জন্য অতিরিক্ত সাওয়াব, বরকত ও ঈমান বৃদ্ধির কথা কুরআন ও হাদীসে বলা হয়েছে। সম্ভব হলে অর্থসহ অন্তত একখতম কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। যারা তিলাওয়াত করতে পারেন না তারা আল্লাহর ওয়াস্তে রামাদানে তিলাওয়াত শিখতে শুরু করুন। অবসর সময়ে তিলাওয়াতের বা অর্থসহ তিলাওয়াতের ক্যাসেটে শুনুন। কুরআন তিলাওয়াতে যেমন সাওয়াব, তা শ্রবণেও তেমনি সাওয়াব। আল্লাহ পাক পবিত্র রমাদানের পরিপূর্ন হক্ক আদায় করে সিয়াম সাধনায় লিপ্ত হয়ে আমাদের আত্মাকে পবিত্র করার তাওফিক দান করুন।

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৮ বিকাল ৫:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




