'মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া' -কথাটি সত্যি সাংঘাতিক!
কঠিন রোগাক্রান্ত কিংবা গুরুতর অসুস্থ কোনও লোকের রোগের কাঠিন্যতা বুঝাতে কেউ কেউ এই শব্দগুলো ব্যবহার করে থাকেন। মারাত্নক কথা এটি। কারন, অসুখ বিসুখ দেয়া কিংবা নেয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ পাকই রেখে থাকেন। সুতরাং অসুখ দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ পাক। আর তা দূর করার ক্ষমতাও একমাত্র তাঁরই রয়েছে। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার অর্থ হলো - মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা। এ ধরনের কথা কি আদৌ কোনও সুস্থ মানুষ বলতে পারে? বলা উচিত? আদৌ উচিত নয়।
অকাল প্রয়াণ কথাটি কেমন? এটি বলা যাবে কি না:
ইদানিংকালে কেউ মারা গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই 'অকাল প্রয়াণ' শব্দটি তার মৃত্যু সংবাদ প্রচারে জুড়ে দিতে দেখি। অকাল প্রয়াণ কথাটি কেমন? এই কথাটি সম্পর্কে ইসলাম কী বলে? এ ধরনের কোনো শব্দ বিশ্বাসী মুসলিমদের ব্যবহার করা উচিত কি না, বিষয়টি জানার জন্যই আলোচনার অবতারনা।
জন্ম যেমন সত্য, মৃত্যু তারচে'ও সত্য। জন্ম মৃত্যু নির্ধারিত। এর সময়ও নির্ধারিত। পার্থিব জীবনে কোন ব্যক্তি কত বছর, কত দিন, কত ঘন্টা, কত মিনিট, কত সেকেন্ড বেঁচে থাকবেন, তাও সুনির্ধারিত। মৃত্যু আসার ব্যাপারে আল্লাহ পাক বলেন,
'আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি, তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় কর। অন্যথায় সে বলবেঃ হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।' সূরাহ আল মুনাফিক্কু-ন, আয়াত-১০
'প্রত্যেক ব্যক্তির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন।' সূরাহ আল মুনাফিক্কু-ন, আয়াত-১১
'আপনি বলুন, আমি আমার নিজের ক্ষতি কিংবা লাভেরও মালিক নই, কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যই একেকটি ওয়াদা রয়েছে, যখন তাদের সে ওয়াদা এসে পৌঁছে যাবে, তখন না একদন্ড পেছনে সরতে পারবে, না সামনে ফসকাতে পারবে।' সূরাহ ইউনূস, আয়াত-৪৯
এ সম্পর্কিত অনেক আয়াত রয়েছে পবিত্র কুরআনে। এ আয়াতগুলো উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই কথাটি পরিষ্কার করা যে, মৃত্যু নির্ধারিত, এবং নির্ধারিত সময়েই তা ঘটে থাকে। প্রত্যেক প্রানীর ক্ষেত্রেই এই সময় অনুসরন করা হয়। কুরআনে বর্নিত এই বিশ্বাস একজন মুসলিম অবশ্যই ধারন করে থাকেন। সুতরাং, কারও মৃত্যুর সময় নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রকারান্তরে আল্লাহ পাকের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার মত ধৃষ্টতার পর্যায়ে পড়ে। কেননা, সকল প্রানীর মৃত্যুর সময়সীমা নির্ধারন করে থাকেন- জীবন ও মৃত্যুর মালিক স্বয়ং মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন। বৃদ্ধ বাবা মায়ের চোখের সামনে থেকে কখনও কখনও এমনও দেখা যায়, একমাত্র ছেলে সন্তানকে মৃত্যুবরণ করতে দেখা যায়। আর এটা দেখে অনেককে বলতে শোনা যায়, আহ, বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে তাদের সামনে দিয়েই চলে গেল! 'বড় অসময়ে' চলে গেল লোকটি! এই শোক কাটিয়ে ওঠার নয়!
অথচ এই যে মৃত্যু, এর হুকুমও আল্লাহ তাআ'লারই পক্ষ থেকে। সুতরাং, কোনো ব্যক্তির মৃত্যুকে 'অকাল প্রয়াণ' আখ্যায়িত করা মহান আল্লাহ তাআ'লার কর্তৃত্বের প্রতি প্রশ্ন তোলার নামান্তর। কারণ, একথার অর্থ দাঁড়ায়, আল্লাহ তাআ'লা তাকে এই মুহূর্তে মৃত্যুদান করে তার প্রতি সুবিচার করেননি। নাউজুবিল্লাহ।
‘বিদেহী আত্মা’র মাগফিরাত কামনাও আরেকটি ভুল কথা
এছাড়া ‘রূহ’ বা ‘বিদেহী আত্মা’র মাগফিরাত কামনার মত একটি অর্থহীন কথার প্রয়োগও অহরহ লক্ষ্য করা যায় আমাদের সমাজে। মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দুআর ক্ষেত্রে ‘মরহুমের রূহ কিংবা বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা’ জাতীয় শব্দ কিংবা বাক্যের ব্যবহারও যথেষ্ট পরিমাণে প্রচলিত।
মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দুআ করা অবশ্যই একটি উত্তম আমল। হাদীস শরীফে এ আমলটি করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে অনেক মাসনূন দুআও সহিহ হাদীসে বর্ণিত রয়েছে। সুতরাং মৃতের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা উচিত। কিন্তু বিষয়টিকে মরহুমের রূহ বা ‘বিদেহী আত্মা’র সাথে যুক্ত করার কী অর্থ থাকতে পারে বোধগম্য নয়।
কোনও ব্যক্তির জন্য মাগফিরাত কামনার অর্থ হল, আল্লাহ পাক যেন তার ‘গুনাহখাতা’ মাফ করে দেন- সেজন্য দুআ করা। গুনাহ যেমন মানুষের অভ্যন্তরে থাকা অদৃশ্য ‘নফস’ দ্বারা হয়ে থাকে, তেমনি বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাও সংঘটিত হয়ে থাকে। তদ্রূপ আল্লাহ তাআলা না করুন-দুনিয়ার এইসব গুনাহখাতার জন্য যদি আখিরাতের আযাব ভোগ করতে হয় তাহলে রূহ যেমন তা ভোগ করবে তেমনি দেহও যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, তা ভোগ করবে। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকীদা এটাই। একইভাবে নেয়ামত, সুখ-শান্তিও দেহ এবং আত্মা উভয়ই ভোগ করবে। তাই দেহকে বাদ দিয়ে শুধু রূহের জন্য মাগফিরাত প্রার্থনার কোনো অর্থ হতে পারে না।
অতএব এই ধরনের কথাবার্তা বলা থেকে সর্বাবস্থায় সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হবে। আল্লাহ পাক আমাদের তাওফিক দিন।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে ক্বিরাত উচ্চস্বরে ও চুপেচুপে পড়ার দলিল-প্রমাণ
যোহরের নামায ও আসরের নামাযে ক্বিরাত চুপে চুপে পড়া, আর ফজর, মাগরিব ও এশার নামাযে উচ্চস্বরে পড়ার সপক্ষে কুরআন-সুন্নাহর কী দলিল রয়েছে?
আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুকরণ ও অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন: "তোমাদের জন্য তথা যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহ্কে বেশি বেশি স্মরণ করে তার জন্য রাসূলের মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ।[সূরা আহযাব, আয়াত: ২১]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: "তোমরা আমাকে যেভাবে নামায পড়তে দেখ সেভাবে নামায পড়"।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজর, মাগরিব ও ইশার নামাযের প্রথম দুই রাকাতে শব্দ করে তিলাওয়াত করতেন। আর বাকী নামাযে চুপে চুপে তিলাওয়াত করতেন।
ফজর, মাগরিব ও ইশার নামাজে উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করার দলিল:
আল-বারা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: ''আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইশার নামাযে "ওয়াত ত্বীন ওয়ায যাইতূন" পড়তে শুনেছি। আমি তাঁর চেয়ে সুন্দর কণ্ঠের তিলাওয়াত শুনিনি।'' [সহিহ বুখারী (৭৩৩) ও সহিহ মুসলিম (৪৬৪)]
জুবাইর বিন মুতয়িম রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: ''আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিলাওয়াত করতে শুনেছি, তিনি মাগরিবের নামাযে "তূর" তিলাওয়াত করেছেন।" [সহিহ বুখারী (৭৩৫) ও সহিহ মুসলিম (৪৬৩)]
জ্বিনদের উপস্থিত হওয়া ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কুরআন শুনা প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু কর্তৃক বর্ণিত হাদিস। সে হাদিসে রয়েছে: "তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে ফজরের নামায আদায় করছিলেন। যখন তাদের কানে কুরআন পৌঁছল তখন তারা মনোযোগ দিয়ে কুরআন শুনল।" [সহিহ বুখারী (৭৩৯) ও সহিহ মুসলিম (৪৪৯)]
এ হাদিসগুলো প্রমাণ করে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করতেন যাতে করে উপস্থিত লোকেরা শুনতে পায়।
যুহর ও আসরের নামাযে চুপে চুপে তিলাওয়াত করার দলিল:
খাব্বাব রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত। এক লোক তাকে জিজ্ঞেস করল: ''রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি যুহর ও আসরের নামাযে ক্বিরাত পড়তেন? তিনি বলেন: হ্যাঁ। আমরা বললাম: আপনারা সেটা কিভাবে জানতেন? তিনি বললেন: তাঁর দাঁড়ির নড়াচড়া দেখে।" [সহিহ বুখারী (৭১৩)]
সুতরাং এর মাধ্যমে পরিস্কার হয়ে গেল যে, উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করার নামাযগুলোতে উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করা এবং চুপেচুপে তিলাওয়াত করার নামাযগুলোতে চুপেচুপে তিলাওয়াত করা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ্ এবং গোটা মুসলিম উম্মাহ্ এ ব্যাপারে একমত।
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: "তিনি প্রত্যেক নামাযে তিলাওয়াত করতেন। তিনি যে নামাযগুলোতে আমাদেরকে শুনিয়ে তিলাওয়াত করতেন সেসব নামাযে আমরাও তোমাদেরকে শুনিয়ে তিলাওয়াত করি। আর তিনি যে সব নামাযে আমাদেরকে না শুনিয়ে তিলাওয়াত করতেন সে সব নামাযে আমরাও তোমাদেরকে না শুনিয়ে তিলাওয়াত করি।" [সহিহ বুখারী (৭৩৮) ও সহিহ মুসলিম (৩৯৬)]
ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: ''সুন্নাহ্ হচ্ছে—ফজর, মাগরিব ও ইশার দুই রাকাআতে এবং জুমার নামাযে উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করা। আর যুহর ও আসরের নামাযে এবং মাগরিবের তৃতীয় রাকাতে এবং ইশার তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাআতে চুপেচুপে তিলাওয়াত করা। সুস্পষ্ট সহিহ হাদিসের সাথে মুসলিম উম্মাহর ইজমার ভিত্তিতে এসব বিধান সাব্যস্ত।'' [আল-মাজমু (৩/৩৮৯) থেকে সমাপ্ত]
ইবনে কুদামা রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন:
''যুহর ও আসরের নামাযে চুপেচুপে তিলাওয়াত করবে। মাগরিব ও ইশার নামাযের প্রথম দুই রাকাআতে এবং ফজরের নামাযের সব রাকাআতে উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করবে। এর দলিল হচ্ছে—নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমল। এটি পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে পরবর্তীদের সম্প্রচারের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে। অতএব, কেউ যদি চুপেচুপে পড়ার নামাযে উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করে কিংবা উচ্চস্বরে তিলাওয়াত করার নামাযে চুপেচুপে পড়ে তাহলে সে সুন্নাহ্র খিলাফ করল। কিন্তু তার নামায শুদ্ধ হবে।'' [আল-মুগনি (২/২৭০) থেকে সমাপ্ত]
তাওফিকদাতা কেবলমাত্র আল্লাহ পাক। তাঁরই নিকট সুপথপ্রাপ্তির দরখাস্ত।
ছবি: গুগল।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৮:২৭