ছবি: সংগৃহীত।
শব্দের সহনশীলতা কিংবা অসহনীয়তার মাত্রা
দেশের লোকসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত বাড়ছে বিভিন্ন রকম গাড়ির সংখ্যা। ক্রমবর্ধমান গাড়ির কারণে শহরের রাস্তাঘাটে চলাফেরা যেমন দায় হয়ে পড়েছে, তেমনি শব্দ দূষণে বিপর্যস্ত হচ্ছে বিভাগীয় নাগরিক জীবন। বিদ্যমান শব্দদূষণ শিশুদের স্বাস্থ্য ও মনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এ দূষণে কানে কম শোনা, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, স্থায়ী মাথাব্যথা, ক্ষুধামন্দা, অবসাদগ্রস্ততা, নিদ্রাহীনতাসহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ বাচ্চাদের মেজাজ খিটখিটে করে তোলে, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়, পড়াশোনায় অমনোযোগী করে তোলে, তাদের আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়।
শব্দের সহনশীলতা কিংবা অসহনীয়তার মাত্রা পরিমাপের একক হচ্ছে ডে¯্রেিবল। মানুষের জন্য শব্দের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ৪৫ ডেসিবেল। পারিবারিক বা অফিসের স্বাভাবিক কাজকর্ম ও কথাবার্তা এই সহনীয় মাত্রার মধ্যে থাকে। ৪৫ ডেসিবেলের চেয়ে বেশি মাত্রার শব্দ, শব্দদূষণ হিসেবে বিবেচিত যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর শব্দের মাত্রা ৭০ ডেসিবেল অতিক্রম করলে তা মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
একটি ব্যস্ত সড়কে সাধারণত ৭০ কিংবা ৮০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ তৈরি হয়। তুলনামূলকভাবে একটি ঘাস কাটার যন্ত্র শব্দ তৈরি করে ৯০ কিংবা ১০০ ডেসিবেল। এছাড়া একটি জেট বিমান অবতরণকালে ১২০ ডেসিবেল শব্দ উৎপন্ন হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তিন বছর বা তার কম বয়সী শিশু যদি খুব কাছ থেকে ৩০ মিনিট ধরে ১০০ ডেসিবেল শব্দ শোনে তাহলে সে শিশুটি চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন অনেক স্কুলগামী শিশু শ্রবণশক্তি হারাতে বসেছে। উচ্চ শব্দ শুধু শ্রবণশক্তিই নষ্ট করে না সৃষ্টি করে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা। এমনকি মানসিক বিকাশের জন্যও এটি ক্ষতিকর।
আমাদের দেশে হর্ন না বাজিয়ে গাড়ি চালানোর কথা-চিন্তাই করা যায় না। মাঝে মাঝে কানের কাছে এমন বিকট শব্দে হর্ন বাজানো হয় যে আঁতকে উঠতে হয়। রাস্তাঘাটে যখন-তখন, যত্রতত্র যেভাবে হর্ন বাজানো হয়, তা সভ্যতার প্রতীক হতে পারে না।
ইউরোপিয়ান হার্ট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যানবাহনের শব্দদূষণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে ৬৫ কিংবা এর চেয়ে বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি আরও বেশি। গবেষণায় বলা হয়েছে, ৫০ হাজারেরও বেশি লোকের ওপর এক জরিপ শেষে দেখা গেছে অতিরিক্ত প্রতি ১০ ডেসিবেল শব্দের জন্য স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ১৪ শতাংশ। এ ঝুঁকি গড়ে সব বয়সীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ ডেসিবেল শব্দে স্ট্রোকের ঝুঁকি ২৭ শতাংশ বাড়ে।
ড্যানিস ক্যান্সার সোসাইটির প্রধান গবেষক মোট সোরেনসিনা এক গবেষণা প্রবন্ধে বলেছেন, ‘যানবাহনের শব্দের সঙ্গে উচ্চরক্তচাপ ও হৃদরোগের সম্পর্কের বিষয়টি আগের গবেষণা থেকেই জানা গেছে। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীন শব্দের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়তে পারে।’ গবেষণায় বলা হয়েছে, সব ধরনের স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ৮ শতাংশ এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে ১৯ শতাংশের জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত শব্দ। শব্দের কারণে চাপ তৈরি হয় এবং তা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। এর ফলে রক্তচাপ ও হৃৎকম্পন বেড়ে যায়।
ডব্লিউবিব ট্রাস্টের এক গবেষণা প্রতিবেদনে শব্দদূষণের উৎস হিসেবে গাড়ির হর্ণ, ইটভাঙার মেশিন, জেনারেটর, মাইকিংকে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শব্দ দূষণ হলো মানুষের তৈরি সমস্যা। মানুষের দৈনন্দিন কিছু কার্যকলাপের কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে। শব্দদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ গাড়ির হর্ন, ইটভাঙার মেশিনের শব্দ, নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, কলকারখানার শব্দ, মিউজিক বা মাইকের শব্দ, ট্রেনের হুইসেলের শব্দ, বিমান ওড়ার শব্দ ইত্যাদি।
সরকার শব্দ দূষণ রোধে ২০০৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়েছিল, কোন ব্যক্তি শব্দ দূষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে কমপক্ষে এক মাস এবং সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদ- এবং ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ- বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবেন।
হাজার হাজার গাড়ি আসা-যাওয়া করছে রাস্তা জুড়ে। কোনো ড্রাইভার নিয়ম মানে না, গতি মানে না, নির্দিষ্ট ট্রেকে গাড়ি চালায় না। সারাক্ষণ সাইড ট্রেক করে, ভুল পথে ওভারটেক করে। আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত গাড়ির প্রত্যেকটি ড্রাইভার। বাসগুলো সবচেয়ে বেশি নিয়ম ভঙ্গ করে। প্রত্যেক চালকই গাড়ি চালাতে গিয়ে প্রতি মিনিটে মিনিটে নিয়ম ভঙ্গ করলে হর্ন না বাজিয়ে উপায় থাকে না।
হর্ন বাজানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার জন্য জরিমানা ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হলেও বাস্তবে হর্ন বাজানো বন্ধ হয়নি। অনেক রাস্তায় হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও এর বাস্তবায়নে বেশ সময় লাগবে। শাস্তি বা জরিমানা করে বহু বছর ধরে গড়ে ওঠা অভ্যাস হঠাৎ করে বদলানো সহজ হবে না।
রাজধানীকে শব্দ দূষণমুক্ত করার জন্য বেশ কিছু সড়কে অকারণে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ ঢাকা মহানগর পুলিশ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঢাকা মহানগর এলাকার ধর্মীয় উপাসনালয়, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি দফতরের ২০০ গজের মধ্যে সড়কে হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
দেশে রাজনৈতিক সংকট বিরাজ করছে বলে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বর্তমানে সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিল, হরতাল-ধর্মঘট বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ছোট-বড় রাজনৈতিক দল কেউ এখন ঘরে বসে নেই। পাল্লার ওজনের মতো কর্মসূচি আসছে। এখন আবার অরাজনৈতিক সংগঠনের নামে রাজনৈতিক বক্তব্য আসছে কোন কোন মহল থেকে।
এতে দেশের নাগরিক জীবনে অনেকটা অস্বস্তি বিরাজ করছে। পরিবেশ ও শব্দ দূষণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ নাগরিক জীবনে সুখ-শান্তির ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অবদানও কম নয়। গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম ও জীবনধারা ব্যাহত হয়। সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক হল সারারাত নেতানেত্রীদের মাইকে ভাষণ প্রচার। একই ভাষণ যখন শতবার মাইকে বাজানো হয় সারারাত ধরে, তখন আশপাশের বাসিন্দাদের কি অবস্থা হয় একবার ভাবুন।
শহীদ মিনার পবিত্র স্থান। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি দেশের লাখো কোটি মানুষ এখানে ভাষা শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসে। কিন্তু আমরা কি এ পবিত্র স্থানটির পবিত্রতা রক্ষা করতে পারছি? সারাটা বছর ধরে গভীর রাত পর্যন্ত উচ্চ ভলিউমে মাইক বাজিয়ে এই শহীদ মিনার চত্বরে সভা-সমাবেশ, গানবাদ্য, অবস্থান ধর্মঘট ও অনেক অননুমোদিত কর্মকান্ড চলে আসছে। লক্ষ্য করুন, শহীদ মিনারের পেছনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পূর্ব পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স এনেক্স ও মোকাররম ভবনে অনেকগুলো বিভাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, উত্তর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার এবং আবাসিক এলাকা, উত্তর-পশ্চিম কোণে জগন্নাথ হল, পশ্চিমে বুয়েট মসজিদ ও আবাসিক এলাকা অবস্থিত। শহীদ মিনারের চারপাশে বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় উপাসনালয়, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা থাকা সত্ত্বেও গভীর রাত পর্যন্ত মাইক বাজিয়ে মিটিং মিছিল, সভা-সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, গানবাদ্য বাজিয়ে চারদিকে অশান্তি ও শব্দ দূষণ করা কি যৌক্তিক বা আইনসঙ্গত হতে পারে?
অডিও ক্যাসেটের দোকানগুলো এক ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি করছে। এসব দোকানে দিনরাত সর্বোচ্চ ভলিউমে গানবাদ্য বাজানো হয় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। এই কানফাটা শব্দে না পারা যায় ঘুমাতে, না পারা যায় পড়াশোনা করতে। পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়। এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও প্রতিকার পাওয়া যায় না।
যদি আমরা আইন মানতাম তাহলে আমাদের মনমানসিকতা সুন্দর হতো এবং জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে আমাদের মানমর্যাদা আরও বহুলাংশে বৃদ্ধি পেত। বাস্তবে কিন্তু তা হচ্ছে না। এ যে কত বড় ব্যর্থতা আর অসম্মানের ব্যাপার তা কি আমরা বুঝি?
আবাসিক এলাকায় উচ্চ স্বরে গান বাজানোর শাস্তি কী?
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর অধীনে ২০০৬ সালে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। এই বিধিমালার ৯ ধারায় উচ্চস্বরে গান বাজানোসহ বিভিন্ন ধরনের শব্দ দূষণের বিষয়ে বলা আছে।
বিধিমালায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পেয়ে আবাসিক এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে আবাসিক এলাকায় দিনের বেলায় ৫৫ ডেসিবেল ও রাতের বেলায় ৪৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দ অতিক্রম করতে পারবে না।
তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে খোলা বা আংশিক খোলা জায়গায় বিয়ে বা অন্য কোনো কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, কনসার্ট, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ধরনের সভা, মেলা, যাত্রাগানের অনুষ্ঠান করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে অনুষ্ঠান আয়োজককারী ব্যক্তিকে পুলিশ কমিশনার বা সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে আবেদন করতে হবে। সে আবেদন মঞ্জুর হলে দৈনিক ৫ ঘণ্টা শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী যন্ত্র বাজানো যাবে এবং রাত ১০টার পরে তা আর বাজানো যাবে না।
এ আইনের ১৮ ধারায় বলা আছে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আবাসিক এলাকায় শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী যন্ত্র বাজালে বা আইন অমান্য করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং এক মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এ ছাড়া পরে একই ধরনের অপরাধ করলে ১০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ৬ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে করনীয়
সরকার শব্দ দুষণ নিয়ন্ত্রণে দেশে শব্দ দুষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ জারি করেছে। এছাড়াও সরকার শব্দ দুষণ নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা ও সমন্বয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও এর সুফল কতটুকু পাওয়া যাচ্ছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
এ লক্ষ্যে প্রয়োজন, শব্দ সচেতনতামূলক ব্যাপক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহন করা।
এছাড়াও শব্দদুষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআরটিএ এবং ট্রাফিক বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগে হাইড্রোলিক হর্ণ ব্যবহারকারী বা শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানগুলো জোরদার করতে হবে।
কৃতজ্ঞতা: dailysangram, http://www.dw.com, http://ourislam24.com এবং অন্যান্য সূত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৮:২৯