মোবাইল ফোন থেকে বিচ্ছুরিত রেডিয়েশন সম্পর্কে সাম্প্রতিক জরিপ; সতর্কতার প্রয়োজন নিয়ে ভাবনা
মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনের বিষয়টি ইতোপূর্বে যদিও বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে তবু এ থেকে বাঁচার কার্যকর কোনো সমাধান এ পর্যন্ত এসেছে বলে শোনা যায়নি। প্রয়োজনের তাগিদে বরং মোবাইল ফোনের উপর মানুষের নির্ভরতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। যোগাযোগ রক্ষায় সহজলভ্যতা, ব্যবহারের বহুবিধ সুবিধা থাকার ফলে আধুনিক জীবনের অপরিহার্য্য অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। সম্প্রতি ‘দ্য জার্মান ফেডারেল অফিস অব রেডিয়েশন প্রোটেকশন’ নামের একটি সংস্থা মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনের পরিমাণ নিয়ে জরিপ করেছে।
রেডিয়েশন আসলে কি?
বিজ্ঞানীদের মতে, রেডিয়েশন হচ্ছে ‘তেজস্ক্রীয় রশ্মি’ বা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক প্রকার ত্বড়িৎ চুম্বকীয় বিচ্ছুরিত শক্তি বা পাওয়ার। যেন আকাশে চমকানো বিদুৎ। অথবা এক মোবাইল থেকে অন্য মোবাইলে কথাবার্তা একটি শক্তির দ্বারা আসা-যাওয়া করে। ওই শক্তির নামই ‘রেডিয়েশন’।
রেডিয়েশনের কারণে মানব শরিরে ঠিক কি ধরণের সমস্যা হতে পারে?
আন্তর্জাতিক ক্যান্সার রির্সাস সংস্থা তাদের মতামতে জানিয়েছে, অতিমাত্রায় রেডিয়েশনের কারণে ব্রেইন ক্যান্সার হতে পারে। একইরকমভাবে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন অভিমত ব্যক্ত করেছে, অতিমাত্রায় মোবাইল ব্যবহারে শরীরের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘক্ষণ কথা বলার কারণে কানের সমস্যা, কানে ঝিমঝিম করা, কানের ভিতরে ব্যথা, ব্রেইনের নিউরনের ক্ষতি, ব্রেনের কোষ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন থেকে বাঁচতে সতর্কতা অবলম্বন করলেই মিলতে পারে রেহাই।
সাম্প্রতিক গবেষনার ফল
২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে অ্যাপল, ব্ল্যাকবেরি, গুগল, এইটিসি, হুয়াওয়েই, এলজি, মোটোরোলা, ওয়ান প্লাস, স্যামসাং, সনি, শাওমি, জেডটিই- ফোনগুলির মধ্যে সমীক্ষা চালায় সংস্থাটি।
এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা মোবাইলের ক্ষতিকর কিছু দিকের সন্ধান দিয়েছে। তারা জানিয়েছে বাঁচার সহজ কিছু উপায়ও। তাদের পরামর্শ, কানে মোবাইল চেপে কথা বলার অভ্যাস ছাড়তে হবে। প্রয়োজনে হ্যান্ডস ফি গেজেট ব্যবহার করা যেতে পারে। স্পিকার ফোনে কথা বলার অভ্যাস বাড়াতে হবে। বন্ধ ঘরে মোবাইলে দীর্ঘক্ষণ কথা এড়াতে হবে। খুদে বার্তা (ম্যাসেজ) দিয়ে কাজ মিটে গেলে মোবাইলে কথা না বলে খুদে বার্তা পাঠানো যেতে পারে।
সংস্থাটির পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, শাওমির এমআই এ১-এ রেডিয়েশন সবচেয়ে বেশি। এর পরিমাণ ১.৭৫ ওয়াট প্রতি কিলোগ্রাম। অথচ বিশ্ব জুড়ে ফোনের ব্যবহারযোগ্য বা নিরাপদ অ্যাবজর্ভশন রেট ০.৬ ওয়াট প্রতি কিলোগ্রাম।
চীনের ওয়ান প্লাস ৫টি’র রেডিয়েশনের পরিমাণ ১.৬৮ ওয়াট প্রতি কিলোগ্রাম, শাওমি এমআই ম্যাক্স ৩-র ক্ষেত্রে রেডিয়েশনের পরিমাণ ১.৭৫ ওয়াট প্রতি কিলোগ্রাম। শাওমি ও ওয়ান প্লাসের ফোনগুলির রেডিয়েশনের পরিমাণ এই তালিকা অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি।
এরপর রয়েছে ওয়ান প্লাস ৬টি ও এইচটিসি ইউ১২ লাইফ। এই ফোনের ক্ষেত্রে রেডিয়েশনের পরিমাণ ১.৫৫ ও ১.৪৮ ওয়াট প্রতি কিলোগ্রাম।
এরপরই তালিকায় রয়েছে শাওমি এমআই মিক্স৩ ও গুগল পিক্সল ৩-এক্স এল। এই ফোনের ক্ষেত্রে রেডিয়েশনের পরিমাণ ১.৪৫ ও ১.৩৯ ওয়াট প্রতি কিলোগ্রাম।
ওয়ান প্লাস ৫ ও আই ফোন ৭-এর ক্ষেত্রেও রেডিয়েশনের পরিমাণ মারাত্মক। এই ফোনগুলির ক্ষেত্রে রেডিয়েশনের পরিমাণ ১.৩৯ ও ১.৩৮ ওয়াট প্রতি কিলোগ্রাম।
এরপর রয়েছে সনি এক্সপেরিয়া এক্স জেড১ কমপ্যাক্ট ও এইচটিসি ডিসায়ার ১২/১২+ এর ক্ষেত্রে রেডিয়েশনের পরিমাণ ১.৩৬ ও ১.৩৪ ওয়াট প্রতি কিলোগ্রাম।
গুগল পিক্সল ৩ ও ওয়ান প্লাস ৬-এর ক্ষেত্রে রেডিয়েশনের পরিমাণ একই। ১.৩৩ ওয়াট প্রতি কিলোগ্রাম।
আইফোন ৮-এর ক্ষেত্রে রেডিয়েশনের পরিমাণ ১.৩২ ওয়াট প্রতি কিলোগ্রাম।
শাওমি রেডমি নোট ৫-এর ক্ষেত্রে রেডিয়েশনের পরিমাণ ১.২৯ ওয়াট প্রতি কিলোগ্রাম। জেডটিই অ্যাক্সন ৭ মিনির ক্ষেত্রেও রেডিয়েশনের পরিমাণ একই।
তবে স্যামসাং নোট ৮, এ৮ বা স্যামসাংয়ের অন্য স্যামসাং ফোনের ক্ষেত্রে রেডিয়েশন যথাক্রমে ০.১৭, ০.২৪, ০.২৬, ০.২৯, অর্থাৎ যথেষ্ট নিরাপদ বলেই উল্লেখ করেছে এই সংস্থা।
বিষয়টি নিয়ে ভাবনার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
মোবাইল রেডিয়েশন থেকে বাঁচার উপায়
‘‘মোবাইল ফোনের মাইক্রোওয়েব প্রতিদিন মস্তিষ্ক গ্রহণ করলে একটা সময় এসে তা মানুষের জৈবিক ও শারীরিক ক্ষেত্রে কঠিন পরিণতি বয়ে আনতে পারে।’’ অধ্যাপক লেইফ সালফোর্ড, সুইডেনের লান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রধান।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন, মোবাইল ফোনের ব্যবহার বাড়তে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তা বিরাট বিপর্যয় বয়ে আনবে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২০ কোটি ৮০ লাখ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী রয়েছে। সেল ফোন ইন্ডাস্ট্রিজে’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক ড. জর্জ কার্লো বলেন, ২০১০ সালে সেলফোন ব্যবহারের ফলে সারা বিশ্বে ৫ লাখ ব্যবহারকারী মস্তিষ্ক ও কানের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, সেলফোন বিকিরণ স্বাস্থ্যের ওপর বিভিন্ন প্রভাব ফেলে। যেমন: মাথাব্যাথা, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেইন টিউমার, ক্যান্সার, আলজেইমার সহ নানা রোগ ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কতৃক পরিচালিত 'ইন্টারফোন নামে একটি গবেষণায় বলা হয়, যারা দশ বছর ধরে দিনে আধ ঘন্টার বেশি সেলফোন ব্যবহার করেছে, তাদের মারাত্মক মস্তিষ্ক টিউমারের সম্ভাবনা বেড়েছে। এই গবেষণাটির জন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেলফোন ব্যবহার মানবদেহে ক্যান্সারের সম্ভাব্য কারণগুলির একটি।
শরীরের জন্য ক্ষতিকর সেলফোন রেডিয়েশন থেকে মুক্তির কিছু উপায়:
১. যথাসম্ভব যে কোন কলকে সীমিত রাখার চেষ্টা করুন এবং প্রতিটি কল সংক্ষিপ্ত করুন। কেননা দুই মিনিট মোবাইলে কথা বললে তা আপনার মস্তিষ্কের প্রাকৃতিক ইলেকট্রিক্যাল কার্যক্রমকে এক ঘন্টা পর্যন্ত স্তমিত করে দিতে পারে।
২. কেবল জরুরী প্রয়োজনে শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেয়া উচিত। কেননা শিশুদের বাড়ন্ত বয়সে মোবাইল ব্যবহার করলে মোবাইলের রেডিয়েশন তার মস্তিকের স্কাল গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
৩. কথা বলার সময় বায়ু নল হেডসেট ব্যবহার করুন। তবে এতে নিয়মিত তারযুক্ত হেডসেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। কেননা তারযুক্ত হেডসেট কানের ক্যানেলে তীব্র বিকিরণ সৃষ্টি করে।
৪. ব্যবহারের সময় কিংবা মোবাইল চালু থাকা অবস্থায় পকেটে বা বেল্টের সঙ্গে সেলফোন রাখবেন না। কেননা শরীরের চামড়ার নিচে অবস্থিত নরম টিস্যু দ্রুত মোবাইলের বিকিরণ শুষে নিতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পুরুষেরা প্যান্টের পকেটে মোবাইল রাখে তাদের বীর্য ৩০ ভাগ পর্যন্ত কমে যায়।
৫. যদি হেডসেট ছাড়া ফোন ব্যবহার করেন তখন মোবাইল যতক্ষণ পর্যন্ত কানেক্ট না দেখায় ততক্ষণ পর্যন্ত ফোন কানের কাছে ধরে রাখা থেকে বিরত থাকুন।
৬. মোবাইল কোন বদ্ধ ধাতব জায়গায় ব্যবহার করবেন না। যেমন: যানবাহন কিংবা লিফটের মধ্যে। কারণ, ধাতু ঘেরা এলাকায় মোবাইল ‘ফ্যারাডে কেজ’ হিসেবে কাজ করে। এই কেজ বিকিরণকে ধরে রাখে। ফলে মোবাইল ব্যবহারকারীর শরীরে বিকিরণ প্রতিফলিত হয়।
৭. নেটওয়ার্ক কম থাকাকালীন সময়ে কারো মোবাইলে কল দেয়া থেকে বিরত থাকুন।
৮. কম স্পেসিফিক অ্যাবজরপশন রেটের মোবাইল বা কম বিকিরণ সমৃদ্ধ মোবাইল কিনুন। কারণ এতে রেডিও ফিক্রোয়েন্সি কম থাকে।
৯. যখন কোথাও দীর্ঘ সময় বিশ্রাম নেয়ার প্রয়োজন মনে করবেন, সেসময় মোবইল ফোন শরীর থেকে দুরে রাখুন।
১০. বেশি বেশি পুষ্টগুণসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। বিশেষ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন খাবার গ্রহণ করুণ। কেননা মাইক্রোওয়েব রেডিয়েশন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়।
আসুন, মোবাইল ফোনের ব্যবহার সম্মন্ধে সচেতন হই। নিজে বাঁচি এবং অন্যকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করি ক্ষতিকর রেডিয়েশন থেকে।
ভালো থাকুন সকলে। সকলের সুস্বাস্থ কামনায়।
ছবি: গুগল।
সূত্র: ১. একটি সচেতনতা মুলক পোষ্ট:মোবাইলের ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে বাচার ১০ উপায় !!
২. সবচেয়ে মারাত্মক রেডিয়েশন শাওমির ফোনে
৩. মোবাইলের রেডিয়েশন কি কি ভাবে ক্ষতি করে? এ থেকে বাঁচার উপায় কি? সরকারের কি করণীয় অাছে?
৪. মোবাইল রেডিয়েশন থেকে বাঁচার ৫ সহজ উপায়
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৮:২৯