ছবি: দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত
গরুর দুধের চেয়ে মূত্রের দাম বেশি কলকাতায়! দৈনিক আনন্দবাজার
বহুদিন আগের কথা, ‘পঞ্চগব্য’ নামে একটি পুজো-উপাচারের নাম শুনেছিলুম। হয়তো অনেকেরই ইহা জানা থাকিবে। মুসলিমরা সবাই না জানিলেও হিন্দুরাতো জানিবেনই। তবে যেসকল হিন্দু ব্যক্তিবর্গ পুজোপার্বণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, তাহাদের জানা নাও থাকিতে পারে। কেননা, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, সকল হিন্দু ব্রাহ্মণ নহেন। আর ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্যদের পুজোপার্বণের অধিকারই যে নেই! তাহা ছাড়া সকল ব্রাহ্মণও তো পুজো করিতে পারেন না। ইহার কারণ হইতেছে, নানা আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করিয়াই পুজোর উপযুক্ত ব্রাহ্মণ হইয়া উঠিতে হয়। ইহা ছাড়া, ব্রাহ্মণের জায়া-কন্যারাও ব্রাহ্মণ্যত্ব লাভ করিতে পারেন না নিয়মের নানারূপ বেড়াজালের কারণে।
আসল কথায় ফিরিয়া আসি, হ্যাঁ, পঞ্চগব্য। পঞ্চগব্য হইতেছে: গোমূত্র, গোময় (গোবর), দুগ্ধ, দই ও ঘৃতের মিশ্রণ। পঞ্চগব্য ব্যতীত কোনও পুজোর অনুষ্ঠান যেমন হয় না; তেমনই পবিত্রতাও সম্পন্ন করা যায় না। তাই পঞ্চগব্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র উপকরণ।
নি:সন্দেহে বলা যাইতে পারে, পঞ্চগব্যের দুধ, দধি ও ঘৃত নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যকর ও উপাদেয় দ্রব্য। এইসবের সমন্বয়ে প্রস্তুত প্রসাদ গ্রহণে কোনও সমস্যা থাকবার কথাও নয় ভক্তদের। কিন্তু প্রসাদে অনিবার্যভাবে গোমূত্র এবং গোময় বা গোবরের যদি সামান্য অংশও দেওয়া হইয়া থাকে তাহলে কোনও রুচিবোধসম্পন্ন মানুষের কাছে কি তা গ্রহণীয় হইতে পারে? তবে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিকট হইতে জানা গিয়াছে, এই মিশ্রণের বিষয়টি বরাবর গোপন করিয়াই রাখা হয়। প্রসাদ প্রস্তুতকারক ব্যতীত ভক্তদের সকলের জানবার তেমন সুযোগই দেওয়া হয় না যে, পরিমানে অতি সামান্য হইলেও ইহাতে গোমূত্র এবং গোময় তথা গোবর মেশানো হইয়াছে। অধিকন্তু ঠাকুরের হাতের পবিত্র(!) প্রসাদ বিনাবাক্যে গ্রহণেরই যেহেতু নিয়ম, তাই ভক্তগন ঠাকুর যা প্রদান করিয়া থাকেন তাহা ভক্তিভরেই গ্রহন করিয়া লন।
সংবাদ আনন্দবাজারের
ভারতের শক্তিমান পত্রিকা দৈনিক আনন্দবাজার সম্প্রতি সংবাদ প্রকাশ করিয়াছে, কলকাতাসহ ভারতে দুধের চাইতে গোমূত্রের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পাইতেছে। গরুর দুধ প্রতি লিটার সর্বোচ্চ ৫০ রুপিতে বিক্রি হইলেও গোমূত্র বিক্রি হইতেছে ১৭৫ রুপি দামে। তাও আবার প্রায়শই ক্রাইসিস দেখা দেয়। তাই এখন আরও বেশি দাম দিয়ে মধ্যপ্রদেশের নাগপুর হইতে গোমূত্র কলকাতায় আমদানি করিতে হইতেছে। ডিস্টিল্ড ও মেডিকেটেড গোমূত্রের দাম প্রতি লিটার ২০০-২৫০ হইতে ৩০০-৩৫০ রুপি পর্যন্ত ওঠানামা করিতেছে। পশ্চিম বঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে অনেক গোখামার গড়িয়া উঠিয়াছে মূলত: গোমূত্রের চাহিদা পূরণ করিবারই উদ্দেশ্যে।
গোমূত্রের দাম হঠাত করিয়া এত বৃদ্ধি পাইল কেন?
গোমূত্রের দাম হঠাত করিয়া এত বৃদ্ধি পাইল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে যাইয়া দেখা যায়, গোমূত্রের দাম বৃদ্ধির আরেকটা কারণ হইতেছে, গোমূত্র সংগ্রহের কাজটা সহজ নহে। গরুর ত্যাগকৃত মূত্র ধরিয়া রাখিবার জন্য রাত অবধি রাখালকে জাগিয়া থাকিতে হয়। গরু কখন মূত্র ত্যাগ করিবে তাহা বলা যায় না। আর খামারের গাভি দৈনিক ১০ হইতে ২০ লিটার পর্যন্ত দুধ দিলেও মূত্র পাওয়া যায় মাত্র ৫ হইতে ৭ লিটার। এ জন্য গরুর দুধের চাইতে মূত্রের উৎপাদন খরচ বলা চলে অনেকটাই বেশি। তাই মূত্রের মূল্যও অধিক পড়িতেছে। অন্যদিকে ভারতীয়দের মধ্যে গোমূত্র সেবনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এর ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়াছে বলিয়া বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ।
উহার নাম 'গঙ্গাজল'
গোমূত্রের উচ্চ চাহিদা মাথায় রাখিয়া, ভারতে কেউ কেউ এখন গোমূত্রকে প্রধান উপাদান হিসাবে ব্যবহার করিয়া বোতলজাত পানীয় তৈরিতে মনযোগ দিয়াছেন। রামদেব নামের জনৈক ব্যায়ামবিদ একটি সফটড্রিংক বাজারজাত করিতেছেন। উহার নাম 'গঙ্গাজল'। ইহার প্রধান উপাদানও গোমূত্র। পত্রিকায় সংবাদে জানা যাইতেছে যে, এই গঙ্গাজল এখন ভারতের জনপ্রিয় পানীয়। প্রায় সব হোটেল-রেস্টুরেন্টে ইহা পাওয়া যায়। আমরা যেমন পেপসি কোলা, সেভেন আপ, ফান্টা, মিরিন্ডা ইত্যাদি পান করি; ঠিক তেমনই গঙ্গাজল ভারতের সর্বত্রই না কি জনপ্রিয়। আরও আতঙ্কজনক সংবাদ হইলো, ভারত ভ্রমণকারী বাংলাদেশিরাও না কি গঙ্গাজল গিলিতে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন! তবে কোমল পানীয়র নামে উহা যে 'গোমূত্রজাত' তাহা অনেক বাংলাদেশিই জানেন না। তাহারা যে নাপাক অখাদ্য হারাম গোমূত্রই পান করিতেছেন ইহা হয়তো অধিকাংশ পানকারীই জানেন না। জানিলে কি কখনও ইহা পান করিতেন?
গোমূ্ত্র কি আসলেই উপকারী?
গোমূত্রের ব্যবসায়ী ও এর সেবনকারীগন ইহার যত গুণকীর্তনই করুন না কেন, বিজ্ঞানীরা কিন্তু ইহার ঘোরবিরোধী। উল্লেখ্য, একশ্রেণির ভারতীয় বিজ্ঞানী নাকি গোমূত্রের উপকারিতা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করিয়া দিয়াছেন। তবে এখন পর্যন্ত উহারা তাহা প্রমাণ করিতে পারেন নাই। কিন্তু হুজুগপ্রিয় ভারতীয়রা ইহার পূর্বেই গোমূত্র গিলিতে গিলিতে বুঁদ হইয়া পড়িয়াছেন। তাই হু হু করিয়া বাড়িতেছে ভারতব্যাপী গোমূত্রের মূল্য। অনেকে প্রচার করিতেছেন, ইহাতে স্বর্ণ রহিয়াছে। তাই গোমূত্রের রঙ সোনালি। অবশ্য রহস্যচ্ছলে কেউ কেউ এই কথাও বলিয়া থাকেন যে, মানুষের মল এবং মূত্রও তো প্রায়ই স্বর্ণালি। তাই বলিয়া এইগুলোকেও কি আগামিতে কোনও ভারতীয় সাদরে গ্রহণ করিতে শুরু করিবেন?
সামান্য পরিমানে গোমূত্র সেবনের পরামর্শ দেওয়া হইয়াছে
সামান্য পরিমানে গোমূত্র সেবনের পরামর্শ দেওয়া হইয়াছে বিশ্ব হিন্দুপরিষদ এবং আরএসএস এর পক্ষ হইতে। এ দুই সংগঠনের নেতাদের মতে, গাভির টাটকা মূত্র সকালে খালি পেটে পান করিলে ক্যানসারসহ দেড় শতাধিক রোগ হইতে মানুষ মুক্ত হইতে পারে। কিন্তু ইহার পক্ষে কোনও বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ আছে বলিয়া তাহাদের কেউ দাবি করিতে পারেন নাই।
গোবর জল উৎকৃষ্ট জীবাণুনাশক
বিশ্ব হিন্দুপরিষদ এবং আরএসএস এর পক্ষ হইতে এই কথাও জানানো হইয়াছে যে, গোবরের সঙ্গে জল মিশাইলে তাহা উৎকৃষ্ট জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করিবে। তাহারা মোজাইকের মেঝে গোবর-জলের মিশ্রণ দিয়া মোছার পরামর্শ দিয়াছেন।
পবিত্রকরণ এবং জীবানু বিনাশ; সবকাজেই গোবর? মাটির মেঝে হইতে মোজাইক করা ফ্লোর
আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দুপরিষদের পরামর্শ দেখিয়া ছোটবেলার অনেক স্মৃতি মনে পড়িয়া গেল। হিন্দু প্রতিবেশিদের মাটির ঘরের মেঝে এবং বারান্দা গোবর-জল-মাটির মিশ্রণ দিয়ে মোছার দৃশ্য স্মরন হইল। শুনিয়াছি, তখন তাহারা ইহা করিতেন তাহাদের ঘরদোর পবিত্র করার জন্য। এখন মোজাইক মোছার দৃশ্য দেখিয়া প্রশ্ন আসিবার পূর্বেই তাহারা বলিয়া দিয়াছেন, ইহা মোজাইকের জীবানু নাশের অন্যতম উপাদান।
আগে মাটির ঘরদোর পবিত্রকরণে ব্যবহার করা হইলেও এখন দেখিতেছি, ভারতের হিন্দু সংগঠনগুলো গোবর-জলের মিশ্রণ দিয়া মোজাইক করা ফ্লোরও মোছার পরামর্শ দিতেছেন।
গোবর এবং গোমূত্র এই দুইটিই মুসলিমদের কাছে অপবিত্র এবং স্পষ্টভাবে হারাম:
যাহাই হউক, গরু ভারতীয় হিন্দুদের কাছে দেবতা। দেবতার মল বা গোবর এবং মূত্রও দেবতুল্য। তাই গোবর ও গোমূত্র ওদের কাছে বর্জ্য বলে গণ্য হইবে কেন? বরং গোবর্জ্য স্বাস্থ্যকর এবং উপাদেয় বস্তু বলিয়া গন্য করেন। তাই তাহারা তা ঔষধি গুণসম্পন্ন মনে করিলেও তাহাতে আপত্তির কিছু নাই। তবে মনে রাখিতে হইবে, গোবর এবং গোমূত্র এই দুইটিই মুসলিমদের কাছে অপবিত্র। শুধু অপবিত্রই নহে, বরং ইহা স্পষ্টভাবে হারাম। কোনো মুসলিম ব্যক্তির পক্ষে গোবর ভক্ষন করা কিংবা গোমূত্র পান করা তো দূরের কথা, এই দুইটি উপাদানের সামান্য অংশ শরীরে অথবা পরিধেয় বস্ত্রাধিতে লাগিয়া থাকিলে সেই অবস্থায় তাহা পরিধান করিয়া সালাত আদায় করা যাইবে না।
গরুর গোশত এবং দুগ্ধ মুসলিমদের জন্য হালাল:
গরুর গোশত ভক্ষন করায় এবং দুগ্ধ পানে মুসলিমদের কোনো বাধা নাই। তাহাদের কাছে দুধ ও বিফ স্বাস্থ্যপ্রদ ও উপাদেয় খাদ্য। অবশ্য শাস্ত্রমতে হিন্দুদেরও গোমাংস ভক্ষণে কোনও বাধা নাই। গরুর গোশত ভক্ষণের অপরাধে ভারতের অনেক মুসলিমকে কট্টরপন্থিরা হত্যা করিলেও গোমাংস কিন্তু অনেক হিন্দু এমনকি ব্রাহ্মণরাও ভক্ষণ করিয়া থাকেন। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করিতে পারি, বছরের পর বছর ধরিয়া চাকুরির সুবাদে ভারতীয় উচ্চ বর্ণের হিন্দুবর্গের সহিত একই সাথে থাকিয়া, তাহাদের আচার অনুষ্ঠান নিকট হইতে দেখার সুযোগ হইয়াছে। আমাদের অনেক অনুষ্ঠানে অনেক ভারতীয় আমাদের সাথে প্রকাশ্যেই গরুর গোশত ভক্ষন করিয়াছেন। শুনিয়াছি, শুধু ভক্ষনই নহে, ব্রাহ্মণদের অনেকে বিফ অর্থাৎ গরুর গোশত বিদেশে রফতানিও করিয়া থাকেন।
গোমূত্রে সব রোগের সমাধান থাকিলে, এত এত হাসপাতাল কেন?
ভারতীয়দের একটি বিরাট অংশ যদি গোমূত্র পানে পরিতৃপ্ত হইয়া থাকেন এবং সর্বরোগ হইতে মুক্তি লাভ করেন, তাহা হইলে এতো বড় বড় এবং ব্যয়বহুল হাসপাতালের প্রয়োজন কি? এতো মেডিকেল কলেজ ও ভার্সিটিরইবা কি দরকার? গোবর ও গোমূত্রবিশারদ আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দুপরিষদ নেতারা থাকতে এতো আয়োজনের আসলেই কি কোনো দরকার আছে?
দুধ, দধি, ঘি সারপ্লাস হলে আমাদের নিকট রপ্তানি করিতে পারেন:
যাহা হউক, ভারতীয় গোমূত্রের টান পড়িলে আরএসএস ও বিশ্ব হিন্দুপরিষদ নেতৃবৃন্দ আমাদের দেশ হইতে তাহা আমদানি করিতে পারেন। এতে কিছুটা হইলেও তাহাদের চাহিদা পূরণ হইতে পারে। আর ওদের দুধ, দধি, ঘি যদি উহাদের নিকট মাত্রাতিরিক্ত অনুমিত হয়, তাহা হইলে আমাদের নিকট তাহা রপ্তানি করিয়া দিতে পারেন। তবে অবশ্যই তাহা দূষণমুক্ত এবং পবিত্রতার সঙ্গে প্রসেসকৃত হইতে হইবে। অবশ্য দুধ এমনই তরল বস্তু যে তাহাতে বিন্দুমাত্র গোবর বা গোমূত্রের ছিটা পড়িলেও তাহা ফাটিয়া যায় বা বিনষ্ট হইয়া যাইতে পারে। তাই আমরা দুধ অথবা দুগ্ধজাত দ্রব্য আমদানি করিলে দূষণমুক্তকরণসহ যাবতীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়াই নেবো। কারণ, মুসলিমরা শতভাগ হালাল ও পাকপবিত্র ছাড়া কোনও বস্তু গ্রহণ করিতে পারেন না। বিশেষত: খাদ্যবস্তুর ব্যাপারে অতি সতর্কতা অবলম্বন সর্বাবস্থায় খুবই জরুরি। হারাম ভক্ষনের কারণে মুসলিম ব্যক্তির ইবাদত পর্যন্ত কবুল হয় না বলিয়া হাদিস শরিফে বলা হইয়াছে। তাহা লেবাসে-পোশাকে সে যতই কেতাদুরস্ত হউক না কেন।
আল্লাহ পাক আমাদের সতর্কতার সহিত জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন। হালাল হারাম যাচাই বাছাই করিয়া পানাহারের কিসমত নসিব করুন।
তথ্যসূত্র:
১. গরুর দুধের চেয়ে মূত্রের দাম বেশি কলকাতায়, anandabazar.com
২. ভারতের রাজস্থানে গরুর দুধের চেয়েও গোমূত্র বেশি লাভজনক, বিবিসি.কম
৩.ভারতে দুধের চেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে মূত্র, sharebusiness24.com
৪. প্রতিদিন টাটকা গোমূত্র পানের পরামর্শ হিন্দু পরিষদের!, jugantor.com
৫. গরুর দুধের চেয়ে মূত্রের দাম বেশি কলকাতায়, ittefaq.com.bd
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৮:২২