নবজাতকের কানে আজান; অন্যরকম ভাবনার একটি বিষয়:
সন্তান ছেলে হোক কিংবা মেয়ে হোক ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম কাজ হলো নবজাতকের ডান কানে আজান এবং বাম কানে ইকামাত দেয়া। হজরত আবু রাফে রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘ফাতিমা রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহার ঘরে হাসান ইবনে আলি রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুমা ভূমিষ্ঠ হলে, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার কানে আজান দিতে দেখেছি।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)
নবজাতকের ডান কানে আজান আর বাম কানে ইকামত দেয়া হয়। পৃথিবীতে প্রচলিত বিধান হচ্ছে, নামাজ আদায়ের জন্য আজান এবং ইকামতের প্রয়োজন হয়। আজান এবং ইকামত দেয়া সম্পন্ন হয়ে গেলে বাকি থেকে যায় শুধু নামাজ। তো প্রশ্ন আসতেই পারে, জন্মের পরপরই নবজাতকের কানে এই যে আজান কিংবা ইকামত দেয়া হল, এই আজান অথবা ইকামতের বিপরীতে কোনো নামাজ কি নেই? আর থেকে থাকলে সে নামাজ কখন আদায় করা হবে? আসলে এই প্রশ্নের উত্তর আমার নিকট মনে হচ্ছে, জন্মের পরপরই নবজাতকের কানে যে আজান কিংবা ইকামত দেয়া হয়ে থাকে, সেটারও নামাজ রয়েছে। নবজাতকের কানে আজান দেয়ার পরে সামান্য সময় অপেক্ষা করতে হয় আমাদের এবং একসময় অভিনব একটি নামাজের দৃশ্য আমরা ঠিকই প্রত্যক্ষ করি, যাকে বলা হয়- 'সলাতুল জানাযাহ' বা 'জানাজার নামাজ'। বেলাশেষে, জীবনাবসানের অব্যবহিত পরে অন্যদের এই 'সলাতুল জানাযাহ' বা 'জানাজার নামাজ' আদায় করার মাধ্যমে মূলত: জন্মের পরপরই কানে কানে শুনিয়ে দেয়া সেই আজান কিংবা ইকামতের জবাবটিই দেয়া হয়ে থাকে। আহ! ভাবনার বিষয়, জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষারও বিষয় বিচিত্র এই নিয়মের মাঝে- জন্মের পরপরই কানে আজানের একত্ববাদের সুমহান বানী শুনিয়ে দেয়া হয়েছিল যার, তার জীবদ্দশায় সে নামাজটি পড়ার সুযোগ তার আর থাকে না। সে নামাজ পড়ে নিতে হয় তাকে ছাড়াই। অন্যদের। কাছের জনদের। তারই জন্য অন্যরা সে নামাজ আদায় করেন। তাকে সামনে রেখেই। মাইয়্যিতের খাটে শুইয়ে রেখে।
আহ! মসজিদের কোনে রক্ষিত খাটিয়ায় শুইয়ে দিয়ে কবরে রেখে আসার পূর্বক্ষনে জীবনাবসানের পরে শেষ পার্থিব নামাজের অপূর্ব দৃশ্য! কি অদ্ভূত ভাবনার বিষয়! কি দারুন চিন্তার বিষয়! কি বুঝা যায় এ থেকে? আমাদের বুঝে নিতে হবে, আজান ইকামত তো হয়ে গেল, এখন বাকি রয়েছে নামাজের জন্য সকলের একত্রিত হওয়া এবং জামাআতের উদ্দেশ্যে দন্ডায়মান হওয়া। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য আজান দেয়া হয়। অাজানের পরে কিছুক্ষন সময় দেয়া হয় মুসল্লীদের একত্রিত হওয়ার জন্য। যা খুবই সামান্য সময়। নবজাতকের বেলায়ও একইরকম মনে হয় বিষয়টি। তার ক্ষেত্রেও সময়ের পরিমান খুবই অল্প। এ সময়ের কোনো টাইম লিমিট নেই। নির্ধারণ করে কিছুই জানিয়ে দেয়া হয় না কাউকে। ৫, ১০ বা ২০, ৩০ কিংবা ৪০, ৫০ অথবা ৮০, ১০০ বছরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু সময়ের সমষ্টি। মাত্র এই সামান্য সময়ের অপেক্ষা। অতি ক্ষুদ্র প্রতীক্ষার সময়ের জীবন। তারপরেই জামাআতে দাঁড়িয়ে যাবেন মুসল্লীগন।
আমার কেন যেন বারবার মনে হয়, নবজাতকের কানে এই যে আজান ইকামত দেয়ার অভিনব সুন্দর পদ্ধতি, এই আজান ইকামতের মাধ্যামে, আজানের শুরুতে এবং শেষে 'আল্লাহু আকবার' তথা 'আল্লাহ মহান' শব্দ এই নতুন অতিথির কানে কানে বলে দিয়ে তাকে যেন স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, 'হে নবাগত! তোমাকে যিনি জীবন দিলেন সেই স্রষ্টাই মহান! তাঁর চেয়ে বড় আর কেউ নেই। পার্থিব জীবনে লোভ লালসায় পড়ে তাকে ভুলে যেয়ো না। তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ো না। আর যে পার্থিব জীবনে প্রবেশ করতে চলেছো তুমি, মনে রেখো, তা বড়ই প্রলুব্ধকর, বড়ই প্রবঞ্চনাকর, বড়ই বিপদসঙ্কুল, সুতরাং ভুলে যেয়ো না তোমার আসল পথ, আসল ঠিকানা, আসল আবাস। লোভের বশিভূত হয়ে বিপথে চলে বিপদে পড়ো না। এই অল্প সময়ে, এই ক্ষুদ্রতম সময়ে প্রস্তুতি নাও দীর্ঘ-দীঘল অচেনা পারকালীন অন্তহীন পথের সফরের।'
আমরা কি পেরেছি, আমাদের জীবনের ক্ষুদ্রতা এবং সংক্ষিপ্ততা অনুমান-অনুধাবন করতে? পেরেছি কি প্রস্তুতি নিতে অন্তহীন পরকালের সফরের যাত্রী হতে?
ছবি: অন্তর্জাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৪৯