যাপিত জীবনের কড়চা- '... তারা লোক হিসেবে খুবই ভালো!'
'আমার তো ট্যাক্স দিতে হইবো। মোবাইলে মেসেজ পাঠাইছে। আমি তো আর পড়তে পারি না। মাইয়া আমারে পইড়া শুনাইছে। অহন না কি আমার তিনাইডি (টিন আইডি) বানাইতো হইবো। তা, তিনাইডি (টিন আইডি) বানাবার জন্য কত ট্যাকা লাগবো?'
'দিয়েন আপনি যা দেন। বেশি লাগবে না।'
'তারপরও কইয়া দ্যান। কত ট্যাকা দেওন লাগবো আমারে খুইল্যা কন। ট্যাকা তো দিতে হইবো আমারই।'
'আরে ৫০০/১০০০ যা দেন দিয়েন। আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রটত্র এইসব নিয়ে আসেন।'
ডায়ালগটা কম্পিউটার কম্পোজ, ইন্টারনেটের কাজকর্ম ইত্যাদি সার্ভিস প্রোভাইডার কোনো দোকানদার আর কাস্টমারের নয়। গতকাল ট্যাক্স অফিসে গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য রিটার্ন দাখিল করা। আমার কাগজপত্র অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বুঝিয়ে দিয়ে রিসিটটা ফেরত নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ফ্রন্ট অফিসে বসে বসে অপেক্ষা করছিলাম। প্রায় ঘন্টাখানিকের উপরে বসতে হয়। এত সময় নিরবে বসে থাকা কঠিন। তবু মুহূর্তকালের জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে না গিয়ে এই কঠিন কাজটাই করলুম। উদ্দেশ্য, তাদের সেবা পরখ করার সুযোগটা গ্রহণ করা। তো সেখানকার এক কর্মকর্তার সাথে সেবা নিতে আসা জনৈক আগন্তুক ব্যক্তির কথোপকথনই ছিল এটা।
পঞ্চাশোর্ধ এক মহিলা এলেন। তার সমস্যা হচ্ছে, তার ট্যাক্স আইডি যখন খোলা হয়েছে সম্ভবতঃ ভুলক্রমে পার্শ্ববর্তী উপজেলা কোডে গিয়ে পড়েছে। তার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিলেন সেই ভদ্রলোক। বিনিময়ে তার কাগজপত্র পাশ্ববর্তী উপজেলার ট্যাক্স অফিসে দাখিল করার ব্যবস্থা করিয়ে দিবেন। -যাক, এটা কোনোভাবে না হয় মেনে নেয়া যায়। কিছুটা সার্ভিস এখানে অন্ততঃ আছে।
একটু পরে আরেকজন এলেন। তাকে চল্লিশ হাজারে কাজটা হয়ে যাবে বলে জানানো হলে তিনিও দেখলাম বেশ তৃপ্তিবোধ করছেন। ধরে নিলাম, ঘটনা নিশ্চয়ই জটিল কিছু। না হয় চল্লিশ হাজারের প্রশ্ন কেন? তারপরও অফিসার তাকে কাজটির জটিলতা সম্মন্ধে আমার সামনেই হালকা জ্ঞান দিলেন। যা বুঝার তাতেই বুঝে নিলাম।
আমাকে এরা মোটামুটি ভালোভাবে চিনেন। গত বছর আমার কাগজপত্র বানিয়ে দিবে বলে এরা খরচার টাকাপয়সা দাবি করেছিল। কয়েক দিন পরে আমি নিজেই তা বানিয়ে নিয়ে গেলে তারা একটু মনঃক্ষুন্ন হয় বলে মনে হয়েছিল। তারপরেও খরচার টাকাপয়সা কিছু তাদের প্রয়োজন বুঝাতে চাইলে জানতে চেয়েছিলাম কিসের খরচ? উত্তর দিতে গিয়ে প্যাচঘোচে পড়ে গিয়েছিল। একজন তো রেগেই যান। আমাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেই বসেন, 'আপনি অন্য দিন আসেন। আজকে আমরা ব্যস্ত।'
'আচ্ছা, ঠিক আছে, অন্য দিন আসবো অসুবিধা নেই। তবে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের জন্য নয়। অন্য কোনো কারণে আসতে পারি হয়তো। এই কাজটার জন্য আজকেই তো এসেছি। আর আপনারা ব্যস্ত থাকবেন না কোন দিন? এই ব্যস্ততাই তো আপনাদের কাজ।'
পাশের টেবিলের উপরস্থ আরেক অফিসার বললেন, 'দেখেন, কোনোভাবে জমা নিয়ে নেয়া যায় কি না।'
আমি যার সাথে কথা বলছিলাম তিনি বললেন, 'আরে না, ঝামেলা আছে।'
'ঝামেলা তো থাকবেই। নিজ দায়িত্বে যারা ট্যাক্স দিতে আসেন তাদেরকে আপনাদের কাছে ঝামেলা মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, আপনারা তো কষ্ট সহ্য করতে অভ্যস্ত। আমাদের দেশের রথি মহারথীদের ট্যাক্স ফাঁকির ঘটনা সুবিদিত। সেগুলো আদায় করতে অনেকের ক্ষেত্রে আপনাদের কত কি করে যেতে হয়। ইয়া আল্লাহ, অনেককে যেমনভাবে তাদের বাড়ি ঘরে গিয়ে, মামলা মোকদ্দমা করে, কোর্ট কাচারি একাকার করে তারপরে ট্যাক্স দিতে বাধ্য করেন। এগুলো দেখলে আপনাদের প্রতি অন্যরকম একটা শ্রদ্ধাবোধ এমনিতেই এসে যায়। আহারে! সত্যিকারের দেশের সেবা তো ইহাই! নিজেকে তখন প্রবোধ দিই যে, দেখো মন, জানপ্রাণ দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে কিভাবে তারা সজীব রাখছে! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই মামলা মোক্দ্দমা আর কোর্ট কাচারি আপনারা সবার ক্ষেত্রেই কামনা করেন কি না কে জানে! হয়তো করেও থাকতে পারেন।' বললাম আমি।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, সাড়ে বারোটা ছাড়িয়ে গেছে। তাই তাদের জবাবের সুযোগ না দিয়ে পাশের টেবিলের সেই উপরস্থ অফিসারকে সাথে সাথেই আবার জিজ্ঞেস করলাম, 'আচ্ছা, আপনারা নামাজ কি অফিসের ভেতরেই পড়েন, না কি বাইরের মসজিদে এটেন্ড করেন? এখানে কাছাকাছি মসজিদ কোন পাশে?'
ভদ্রলোক মনে হল হোচট খেলেন একটু। বললেন, 'আমরা তো.. আমরা... আমরা নামাজ... মাঝেমধ্যে... অফিসে... প...ড়ি'।
সহকর্মীকে বললেন, 'হুজুরের কাগজটা তাড়াতাড়ি রেডি করে দেন। নামাজের আগেই দেন। সে গিয়ে নামাজ ধরবে। নিজেরা তো নামাজ পড়িই না, আবার অন্যকেও যদি পড়তে সুযোগ না দিই!'
ভাবলাম, যাক, আল্লাহর রহমতে এ যাত্রায় সহজ হয়ে গেল। কিন্তু হাজার প্রশ্ন ঠিকই থেকে গেল মনের ভেতরে। আমি না হয় খরচার টাকাপয়সা না দিয়েই আমার কাজটা সারতে পারলাম। বাদবাকি লোকজন? সেই বাদবাকি কিছু লোকের অবস্থা পর্যবেক্ষনেরই সুযোগ হয়েছিল গতকাল। যাপিত জীবনে এইসব খরচার টাকাপয়সা দিতে দিতে আমরা নিঃস্ব হচ্ছি দিনে দিনে। আমাদের ট্যাক্সের টাকায় যাদের বেতন হয়, সেই সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে সেবা নিতে গেলে আমাদেরকে দিতে হয় খরচার টাকাপয়সা! মাস শেষে তাদের অনেকের হয়তো বেতনে হাত দিতে হয় না। সারা মাস ভরে খরচার টাকাপয়সা পকেটে পুড়তে পুড়তে অনায়াসে কেটে যায় অনেকের।
আমরা মা-শাআল্লাহ এখন আর আগের মত নই। আগের মত নেই। আমরা শিক্ষিত হয়েছি। শালীনতাপূর্ণ কথাবার্তা আয়ত্ব করছি দিনকে দিন, ভাষা ব্যবহারে শব্দ প্রয়োগে পরিমিতিবোধ ইত্যাদিতে তার প্রকাশও দেখা যাচ্ছে। এই যেমন, আমরা এখন 'ঘুষ' বলি না। দেশে কেউ বলে না যে, 'আমাকে পাঁচশো টাকা ঘুষ দেন'। আমরা ভদ্র ভাষায় বলি, খরচার টাকাপয়সা। বখশিশ, হাদিয়া বা এ জাতীয় সুন্দর শব্দেরও ব্যবহার দেখা যায় অনেক অনেক ক্ষেত্রে।
যাক, নিতান্ত অপারগ হয়েই তাদেরকে দু'কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলাম সেবার। সেই থেকে তারা মনে রেখেছেন আমাকে! তাই এবার আর খরচার টাকাপয়সা চেয়ে বিপদের ঝুঁকি নেননি! 'ধন্যবাদ' দিয়ে বিদায় নিয়ে যখন অফিস থেকে বেরিয়ে আসি, নিজেকে কৃপন কৃপন মনে হচ্ছিল কেন যেন। সবাই দিচ্ছে, আমি দিচ্ছি না ভেবে একটু কেমন কেমন লাগছিল। দরজা দিয়ে বেরুনোর সময় আবারো মনে হলো, 'তারা অন্ততঃ মনে রেখেছেন আমাকে! তারা লোক হিসেবে খুবই ভালো!'
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০২০ সকাল ৯:০৮