somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

নতুন নকিব
আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

কবরে ফুল দেয়া বা পুষ্পস্তবক অর্পন সুন্নত কোনো কাজ নয়ঃ

২৩ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছবিঃ অন্তর্জাল।

কবরে ফুল দেয়া বা পুষ্পস্তবক অর্পন সুন্নত কোনো কাজ নয়ঃ

আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান এমন অনেক কাজ রয়েছে যেগুলো সচরাচর পালন করতে দেখা গেলেও সেগুলো মূলতঃ সুন্নত কাজের অন্তর্ভুক্ত নয়। এমন অনেক কাজের একটি হচ্ছে, কবরে ফুল দেয়া। আরও বিশুদ্ধ বাংলায় 'কবরে পুষ্পস্তবক অর্পন' বলেও প্রকাশ করা যায় বিষয়টিকে। বস্তুতঃ 'কবরে ফুল দেয়া' বা 'পুষ্পস্তবক অর্পন' যদিও অধিক প্রচলিত একটি কাজ তথাপিও এটি সুন্নত বহির্ভূত একটি সামাজিক প্রচলন মাত্র। আমরা অত্র নিবন্ধে 'কবরে ফুল দেয়া' বা 'পুষ্পস্তবক অর্পন' এর শরয়ী ভিত্তি নিয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। এর জন্য প্রথমেই 'সুন্নত কাকে বলে?' বিষয়টি আমাদের জেনে নেয়া প্রয়োজন।

সুন্নত কাকে বলে?

শরীয়তের পরিভাষায় ‘সুন্নত’ হচ্ছে ঐ পথ, যা ইসলাম ধর্মে শুরু থেকে আছে। সুতরাং, যা নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল ছিল তা সুন্নত। তেমনি উলামায়ে মুতাকাদ্দিমীন এবং মুতাআখখিরীনসহ আয়িম্মায়ি মুজতাহিদীন ও সালফে সালেহীন ইসলামী পন্ডিতগণের নিকট সর্বসম্মতভাবে গৃহীত সুন্নতের বিস্তারিত সংজ্ঞার আলোকে বুঝা যায়, খাইরুল কুরূন (নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশাকালীন সময়সহ নিকটবর্তী উত্তম জামানাসমূহ) অর্থাৎ, খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহুম এবং তাদের নৈকট্যপ্রাপ্ত তাবেয়ীন (রিদওয়ানুল্লাহি তাআলা আলাইহিম) যে আমল করেছেন তা-ও সুন্নতের মাঝে শামিল।

কোনো কাজ সুন্নত কি না তা নির্ধারণের উপায়ঃ

কোনো কাজ সুন্নত কি না তা নির্ধারণের উপায় হচ্ছে, এ কাজ খাইরুল কুরূনে (নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশাকালীন সময়সহ নিকটবর্তী উত্তম জামানাসমূহ) প্রচলিত ছিল কি না, তা দেখা। প্রথম যুগে (অর্থাৎ নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবা-তাবেয়ীনের মোবারক যুগে) যা প্রচলিত ছিল তা নিঃসন্দেহে সুন্নত। আর এর অনুসরণকারীরা ‘আহলে সুন্নত’ বা সুন্নী নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত। সত্যিকারার্থে নিজেদের সুন্নী নামে পরিচিত করার অধিকারও এদেরই থাকা বাঞ্ছনীয়।

বিদআত এবং বিদআতীঃ

পক্ষান্তরে যা উপরোক্ত বরকতপূর্ণ খাইরুল কুরূন (নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশাকালীন সময়সহ নিকটবর্তী উত্তম জামানাসমূহ) এর পরে উদ্ভাবিত হয়েছে, যার পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর কোনো দলীল নেই, একে ছওয়াবের কাজ মনে করে পালন করা বিদআত। আর এতে লিপ্ত লোকেরা ‘আহলে বিদআত’ বা ‘বিদআতী’ নামের উপযুক্ত।

কবরে ফুল দেয়া যদি মৃত ব্যক্তির জন্য ছওয়াবের কারণ হয়ে থাকতো, সাহাবাগণ নবীজীর কবরে ফুলের স্তুপ গড়ে তুলতেনঃ

নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের শত শত প্রিয় সাহাবীকে দাফন করেছেন। মা-শাআল্লাহ, মদীনা তাইয়েবায় ফুলেরও অভাব ছিল না। তিনি কি কারো কবরে ফুল দিয়েছেন? তাঁর ওফাতের পর খোলাফায়ে রাশেদীন কি তাঁর পবিত্র কবরে ফুল দিয়েছেন? এরপর অন্য সাহাবীগণ কি দিয়েছেন খোলাফায়ে রাশেদীনের কবরে বা তাবেয়ীগণ কোনো একজন সাহাবীর কবরে? এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে এককথায় ‘না’। আর গোটা হাদীসের কিতাবগুলোতে একটি হাদীসও এই মর্মে পাওয়া যায় না যে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কোনো খলীফায়ে রাশেদ, কোনো সাহাবী বা কোনো তাবেয়ী কারো কবরে ফুল দিয়েছেন। তাহলে যে কাজ নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুরু করে কোনো একজন সাহাবি কিংবা সাধারণ তাবেয়ী থেকেও প্রমাণিত নয় একে সুন্নত কে বলতে পারে? কীভাবে বলতে পারে? তবে হ্যাঁ, কেউ যদি এমন কোনো কাজকেও ‘সুন্নত’ মনে করে, যা নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রীতি ও সাহাবা-তাবেয়ীগণের রীতির পরিপন্থী তাহলে এই অধম স্বীকার করছে যে, সুন্নতের এই নতুন পরিভাষা তার জানা নেই।

কিয়াস ও ইজতিহাদের দ্বারা শরয়ী দলীল দ্বারা উদ্ভাবিত কোনো কিছুকে বড়জোর 'সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত' বলা যেতে পারেঃ

একটি ছুরত এই হতে পারে যে, কোনো একটি বিষয় নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগে ছিল না, পরে এর অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। আর কোনো মুজতাহিদ শরীয়তের কোনো মূলনীতির আলোকে ইজতিহাদ করে একে ‘জায়েয’ বা ‘মুস্তাহসান’ বলেছেন, এমন কিছুকে (সরাসরি) ‘সুন্নাতুন নাবী’ বলা যায় না। আবার খেলাফে শরীয়তও বলা যায় না। কারণ, মুজতাহিদ ইমামগণের কিয়াস ও ইজতিহাদও শরয়ী দলীল; বরং একেও ‘ছাবিত বিস সুন্নাহ’ (সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত) মনে করা হবে।

আলোচ্য কবরে ফুল দেয়ার বিষয়টি সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত কোনো বিষয়ও নয়ঃ

বস্তুতঃ আমাদের আলোচ্য বিষয়টি এ শ্রেণিরও অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ, প্রথমত ফুল ও কবর এমন কিছু নয় যা খাইরুল কুরূনের পরে এসেছে। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে কবরও ছিল, ফুলও ছিল। আর সেই ফুল কবরে দেয়া সম্ভবও ছিল। এ যদি কোনো মুস্তাহসান (পছন্দনীয়) ব্যাপার হত তাহলে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা ও কাজের দ্বারা তা জারি করতে পারতেন।

এ কেমন সুন্নত, যার খোঁজ না খাইরুল কুরূনে পাওয়া যায়, না বিস্তৃত হাদীস-সমগ্রে, না হাজার বছরের ফিকহ রচনাবলীতে!

এরপর ফিকহে হানাফীর সংকলন আমাদের ইমামে আযমের যমানা থেকে শুরু হয়েছে এবং দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত, কোনো রকমের অতিশয়তা ছাড়াই বলা যায়, হাজার হাজার ফিকহ-গ্রন্থ রচিত হয়েছে। আমাদের ফকীহগণ কাফন-দাফন ও কবর সংক্রান্ত ছোট ছোট সুন্নত-মুস্তাহাব ও আদবও বিশদভাবে লিখেছেন। এই প্রায় হাজার বছরের ফিকহ-রচনাবলীতে কোথাও নেই যে, কবরে ফুল দেয়া সুন্নত। এটা যদি সুন্নতই হত, তাহলে হাজার বর্ষব্যাপী হানাফী ইমাম ও ফকীহগণ এ ‘সুন্নত’ থেকে উদাসীন কীভাবে রইলেন? এ কেমন সুন্নত, যার খোঁজ না খাইরুল কুরূনে পাওয়া যায়, না বিস্তৃত হাদীস-সমগ্রে, না হাজার বছরের ফিকহ রচনাবলীতে! না আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর আমল করেছেন, না খোলাফায়ে রাশেদীন, না সাহাবা-তাবেয়ীন, না আইম্মায়ে মুজতাহিদীন আর না হাজার বছরের আলিমগণ!

এখানে একথাও আরয করে দেয়া জরুরি যে, পরের যুগের কারো ‘ইস্তিহসান’ (ভালো মনে করার) দ্বারা সুন্নত তো দূরের কথা, (অনেক ক্ষেত্রে) জাওয়ায বা বৈধতাও প্রমাণ হয় না।

ইমাম রাব্বানী মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রাহ. ‘ফাতওয়া গিয়াছিয়্যাহ’ থেকে নকল করেন-

অর্থ: শায়খ ইমাম শহীদ রাহ. বলেছেন, আমরা বলখের মাশায়িখের ‘ইস্তিহসান’কেও কবুল করি না। আমরা শুধু কবুল করি আমাদের মুতাকাদ্দিমীন আসহাব-এর কওল। কারণ, কোনো এলাকায় কোনো বিষয়ের প্রচলন হয়ে যাওয়া তার বৈধতার দলীল নয়। বৈধতার প্রমাণ তো ঐ ‘তাআমুল’ বা 'কর্ম-ধারা', যা প্রথম যুগ থেকে চলে আসছে। যার দ্বারা প্রমাণ হতে পারে যে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে এই ধারার উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাহলে বোঝা যাবে, এ নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ হতে ‘তাশরী’ শরীয়তের ধারা প্রবর্তন। অন্যথায় লোকের সাধারণ কর্ম-ধারা দলীল নয়। তবে হাঁ, সব দেশের সব লোক (উলামা-ফুকাহাগণ একমত হয়ে) যদি তা করে তাহলে সেটা হবে 'ইজমা'। আর 'ইজমা' শরীয়তের দলীল। দেখুন, লোকেরা যদি মাদক-দ্রব্যের বেচাকেনা ও সুদের লেনদেন করতে থাকে তাহলে (তাদের কর্মধারার কারণে) তা হালাল হওয়ার ফতোয়া দেয়া হবে না। (কারণ, তা হারাম ও দ্বীনের আলিমগণ একে হারামই জানেন।) -মাকতুবাতে ইমাম রাব্বানী, দফতরে দুঅম, মাকতূব ৫৪

খেজুর-গাছের শাখা পুঁতে দেয়ার হাদীসঃ

এ প্রসঙ্গে শাহ ছাহেব যে হাদীসটি পেশ করেছেন, অর্থাৎ নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর গাছের একটি ডাল দুই ভাগ করে দুই কবরে পুঁতে দিয়েছিলেন, যে কবর দুটিতে আযাব হচ্ছিল এবং বলেছিলেন, ‘আশা করা যায়, এই শাখা শুকানো পর্যন্ত কবর দু'টির আযাব লঘু হবে’। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।

এক. এ ঘটনা একাধিক সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম নববী রাহ. ও কুরতুবী রাহ.-এর মতে, তা একই ঘটনার বিভিন্ন বর্ণনা। তবে হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ও আল্লামা আইনী রাহ.-এর মতে তা আলাদা তিনটি ঘটনা। এ বিতর্কের অবসান কঠিন হলেও সকল বর্ণনার অভিন্ন বক্তব্য এই যে, কবরে খেজুর গাছের শাখা পোঁতা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ নিয়ম ছিল না। আযাবের শিকার কোনো কোনো কবরে শাখা পোঁতার দুটি একটি ঘটনা অবশ্য ঘটেছে।

দুই. এ নিয়েও কথা আছে যে, এ কবরগুলো কাদের ছিল- কাফিরের না মুসলমানের? আবু মুসা মাদীনী রাহ. বলেন, তা কাফেরদের কবর ছিল। পক্ষান্তরে কেউ কেউ বলেছেন, তা মুসলমানদের কবর ছিল। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, জাবির রা.-এর হাদীসে যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তা মুসলমানদের কবরের ঘটনা। -ফাতহুল বারী খন্ড- ১, পৃষ্ঠা ২৫৬

কবরগুলো কাফিরদের হোক বা মুসলমানদের, এটুকু তো স্পষ্ট এবং হাদীসেও উল্লেখিত যে, ঐ সব কবরেই শাখা পোঁতা হয়েছিল যেগুলো আযাবের শিকার হওয়া নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অকাট্য ওহী বা সহীহ কাশফের দ্বারা অবগত হয়েছিলেন। সাধারণ মুসলমানের কবরে না নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাখা পুঁতেছেন আর না নবী-যুগে ও সাহাবা-তাবেয়ীনের যামানায় এর সাধারণ প্রচলন ছিল। এ থেকে স্পষ্ট যে, কবরে শাখা পোঁতা নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ সুন্নত বা সুন্নতে মাকসূদাহ ছিল না।

তিন. নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী- ‘আশা করা যায়, এ ডাল শুকানো পর্যন্ত কবরগুলোর আযাব লঘু হবে’। হাদীসের ভাষ্যকারগণ এ কথার মর্ম ও তাৎপর্য নিয়ে লম্বা আলোচনা করেছেন।

হযরত শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী মিশকাতের আরবী শরাহ ‘লামাআতুত তানকীহ’তে মশহুর হানাফী ফকীহ, মুহাদ্দিস ও আরিফ ইমাম ফযলুল্লাহ তূরাপিশতী রাহ. থেকে বর্ণনা করেন: তূরাপিশতী বলেন, এ সময়সীমার কারণ, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই শাখাগুলো সজীব থাকা পর্যন্ত এই কবরগুলোর আযাব-লঘুতার সুপারিশ করেছিলেন।

যারা বলেন, সজীব শাখা সজীব থাকা পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার তাসবীহ করে। আর একারণে তা কবরের আযাব থেকে রক্ষা করে- তাদের একথা সম্পূর্ণ অসার, অর্থহীন। আহলে ইলমের কাছে এর কোনো মূল্য নেই। -লামআত খ. ২ পৃ. ৪৪

চার. তাদের এ ‘ব্যাখ্যা’, যা আহলে ইলমের কাছে অসার ও ভিত্তিহীন যদি যথার্থও ধরে নেওয়া হয় তাহলেও এর দ্বারা কবরে শাখা পোঁতা সুন্নত সাব্যস্ত হয়, ফুল ছড়ানো বা পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ নয়। একারণে আল্লামা আইনী রাহ., যিনি এ ব্যাখ্যা কবুল করেন, তিনিও বলেছেন,

وكذلك ما يفعله أكثر الناس من وضع ما فيه رطوبة من الرياحين والبقول ونحوهما على القبور ليس بشيء، وإنما السنة الغرز

তেমনি আকসার লোক যা করে থাকে অর্থাৎ কবরে ফুল-পাতা দেওয়া, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সুন্নত হচ্ছে শুধু শাখা পোঁতা। -উমদাতুল কারী ৩/১২১

পাঁচ. এ ছাড়া তাদের ঐ কারণ-ব্যাখ্যা যদি মেনেও নেওয়া হয় তাহলেও এর দ্বারা কাফের ও ফাসিকের কবরে শাখা পোঁতার বৈধতা প্রমাণ হয়, আল্লাহর অলীগণের কবরে নয়। ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে যে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আযাবের শিকার এক-দুটি কবর ছাড়া অন্য কোনো কবরে শাখা পোঁতেননি এবং এর নির্দেশনাও দেননি। আর সাহাবা-তাবেয়ীনও এর উপর আমল করেননি। সুতরাং, ঐ ঘটনার অজুহাতে ছালেহীন ও আল্লাহর মকবুল বান্দাদের কবরে ফুল দেওয়ার বৈধতাও প্রমাণ হয় না। সুন্নত-মুস্তাহাবের তো প্রশ্নই আসে না।

কী আশ্চর্যের কথা, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কাফের ও গোনাহগারের কবরে করেছেন তা ওরা বৈধ মনে করছেন আল্লাহর ওলীগণের কবরে!

শরীয়ত এমন কোনো কিছু পছন্দ করে না, যা কোনো মুসলমান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দান করেঃ

নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সাধারণ মুসলমানের কবরে শাখা পোঁতার সুন্নত জারী করেননি, সম্ভবত এতে এ হিকমতও নিহিত আছে যে, শাখা পোঁতা ঐ কবরটির আযাবগ্রস্ততার লক্ষণ বহন করে। অথচ শরীয়ত এমন কোনো কিছু পছন্দ করে না, যা কোনো মুসলমান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দান করে বা যাতে কুলক্ষণ থাকে। একারণে এই হাদীসের ভিত্তিতে অলী-আল্লাহর কবরে ফুল দেয়া নিতান্তই বে-আদবী।

এটি অন্য ধর্ম ও রীতি হতে অনুপ্রবেশকারী একটি বিদআতে সাইয়িআহ তথা নিকৃষ্ট বিদআতঃ

বস্তুত আজ মাযারগুলোতে যে ফুলের চাদর বিছানো হয় তা এ হাদীসের বিধান তামিলের জন্য নয়; বরং কবরের তাজিম ও কবরবাসীর নৈকট্য অর্জনের জন্য। অথচ রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবরের তাজিম ও কবরবাসীর নৈকট্য-অন্বেষণার্থে ফুল দেওয়ার মোটেও ইজাযত দেননি। এ হাদীসেও এ ইজাযতের কোনো সূত্র পাওয়া যায় না। বস্তুত পুষ্প-অর্পণের যে রীতি আমাদের এ যমানায় চালু হয়েছে আগের পরের কেউ এর বৈধতার ফতোয়া দেননি। এ কারণে তা বিদআতে সাইয়িআহ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এটা অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের রসম রেওয়াজ মাত্র, যা মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে। আর অন্য ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, কৃষ্টি কালচার ইত্যাদি অনুসরণ এবং অনুকরণ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ প্রদানের পাশাপাশি নিজেদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলার ক্ষেত্রে হাদিসে বরাবর উৎসাহিত করা হয়েছে।

এক হাদিসে এসেছে, 'মান তাশাব্বাহা বিকওমিন ফাহুআ মিনহুম', অর্থাৎ, 'যে ব্যক্তি যেই সম্প্রদায়কে মুহব্বত করবে, হাশরের মাঠে তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবেন।' এই মুহাব্বতের অর্থ আলোচনা সাপেক্ষ। কোনো সম্প্রদায়কে মুহাব্বত করার অর্থ এখানে কোনো সম্প্রদায়ের অনুসরণ ও অনুকরণ করা, তাদেরকে ফলো করা।

বিদআতের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্যও এতে বিদ্যমানঃ

বিদআতের বৈশিষ্ট্যই এই যে, যখন এর বিস্তার ঘটে তখন ধীরে ধীরে (তাকওয়া এবং ইলমের পরিপক্কতা থেকে বঞ্চিত) আলিমদের মন-মস্তিষ্কও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে এবং বিদআতের মন্দত্ব ও ভয়াবহতা তাদের চিন্তা থেকে অন্তর্হিত হয়ে যায়। এ কারণে কোনো কোনো আলিম কোনো না কোনোভাবে এর বৈধতা ও ইস্তিহসানের কোনো না কোনো উপায় বের করার চেষ্টা করেন। এভাবে তারা সুন্নত যিন্দা করার পরিবর্তে বিদআতের বিস্তারে সহযোগী হয়ে যান।

যাদের জন্য এই লেখাঃ

এই লেখা শুধু তাদের জন্য যারা ইসলাম ধর্মের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা এবং বিশ্বাস রেখে কুরআন সুন্নাহ নির্দেশিত শরিয়ত অনুযায়ী জীবনের ছোট বড় সকল কাজ করতে আগ্রহী এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। শত বাধা বিপত্তি, প্রলোভন, ভয়-ভীতি কিংবা ধিক্কার ও কটাক্ষ যাদের সুন্নতের জীবনকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে না, তাদের জন্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এসকল বিপদ থেকে উম্মতকে হেফাযত করুন। সুন্নতের নামে জাল বিস্তার করা বিদআত ও কুসংস্কারের থাবা থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।

তথ্য ও লেখার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন: মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ লুধিয়ানবী রাহ. প্রণিত ‘ইখতিলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুস্তাকীম’ থেকে সংক্ষেপিত, সংযোজিত এবং সম্পাদিত, অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আবু মুহাম্মাদ, মাসিক আল কাওসার এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১২:৫৮
২২টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×