সত্যিকারের হকদারের পরিচয়
কোনো এক এলাকার নামীদামী এবং প্রভাবশালী এক ব্যক্তি মৃত্যুবরন করলেন। জানাযার নামাজ শুরুর আগ মূহুর্তে মৃত ব্যক্তির এক বাল্য বন্ধু এলেন, যিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী। তিনি এসেই ইমাম সাহেবকে বললেন- দয়া করে জানাযা পড়ানোর আগে একটু অপেক্ষা করুন। আমার কিছু কথা আছে। মৃত ব্যক্তি আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। বিভিন্ন সময় আমরা পরস্পরে একে অপরের কাছ থেকে অর্থকড়ি ধার নিতাম। প্রয়োজন পুরণ হয়ে গেলে উক্ত অর্থ আবার একে অপরকে ফিরিয়েও দিতাম। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আমার কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকা ধার নিয়েছিলেন। টাকাটা তিনি আমাকে ফেরত দিয়ে যেতে পারেননি। তিনি নিঃসন্দেহে ভালো লোক ছিলেন। হয়তো সেই সুযোগ তিনি পাননি বলেই টাকাটা পরিশোধ করে যেতে পারেননি। এখন আমি আমার উক্ত ১০ লক্ষ টাকা ফেরত পেতে চাই। আমি মনে করি, টাকাটা আমাকে কে, কখন এবং কিভাবে ফেরত প্রদান করবেন, সেই ফয়সালা হওয়ার পরেই জানাযা পড়ানো উত্তম হবে।
মৃত ব্যক্তির তিন ছেলে এক মেয়ে। ছেলেরা সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেকেই বিত্তশালী। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। মেঝ ছেলে ডাক্তার এবং ছোট ছেলে পিইচডি হোল্ডার। একমাত্র মেয়েকে তিনি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেননি। তবে, মাদ্রাসায় পড়িয়েছিলেন। প্রয়োজনীয় পরিমান জাগতিক এবং ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের সুযোগ প্রদানের পরে তাকে উপযু্ক্ত পাত্রে পাত্রস্থ করেছিলেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় ইমাম সাহেবসহ জানাযায় আগত সকল মুসল্লিগণই কিংকর্তব্যবিমুঢ়! মৃত ব্যক্তির পুত্রগণও জানাযায় উপস্থিত। ইমাম সাহেব এ বিষয়ে তিন পুত্রের কাছে তাদের বক্তব্য এবং করণীয় জানতে চাইলেন। কিন্তু তিন পুত্রের কেউই ঋনের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। তারা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন যে- এরকম ঋণের ব্যাপারে কোনো অসিয়ত তাদের পিতা তাদেরকে করে যাননি। অতএব, তারা এই ঋন পরিশোধ করতে বাধ্য নন। তারা এটা করতে রাজী নন।
অগত্যা ইমাম সাহেব মৃত ব্যক্তির অন্যান্য আত্নীয়-স্বজনদের ডাকলেন এবং এই বিষয়ে কি ফয়সালা হতে পারে, তাদের কাছে তা জানতে চাইলেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কেউই ঋনের দায়িত্ব নিতে রাজী হলেন না এবং এ ব্যাপারে কোনো সমাধানও দিতে পারলেন না।
ইমাম সাহেবও নিরুপায়। হঠাৎ করে ঋণের প্রসঙ্গটি সামনে আসায় তিনি মৃতের জানাযা শুরু করতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে শেষমেষ তিনিও উপস্থিত মুসল্লিদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, ঋনের ফয়সালা হওয়া ব্যতীত, তিনি জানাযা পড়াবেন না।
অন্যরকম এক পরিস্থিতি। জানাযা সামনে নিয়ে মৃত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে রীতিমত দরকষাকষি। কেউ ঋণের দায় নিতে চান না। জীবনপন সংগ্রাম করে, সারা জীবন শত কষ্ট সয়ে সয়ে যে পুত্রদের তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন, বিত্তবান সেই পুত্রগণ নন। পৃথিবীতে যাদেরকে নিতান্ত আপন ভেবে কাছে টানতেন, আগলে রাখতেন, ভালোবাসা পোষন করতেন- সেই আত্মীয়-স্বজনদেরও কেউ নন।
এমন একটি উদ্বেগাকুল মুহূর্তেই হঠাৎ উপস্থিত হলেন বোরকা পরিহিতা এক মহিলা। হাতে একটি ব্যাগ। কান্নাজড়িত কন্ঠে মহিলা বললেন- ইমাম সাহেব, আমি মৃত ব্যক্তির কন্যা। তিনি আমার বাবা। বাবার ঋণের দায় আমি গ্রহণ করলাম। এই নিন, এই ব্যাগে বেশ কিছু টাকা ও গয়না রয়েছে। দয়া করে পাওনাদারকে বলুন যে, ব্যাগে থাকা টাকা এবং গয়না বিক্রি করা অর্থ থেকে তিনি যেন তার পাওনা টাকাটা নিয়ে নেন। আর হ্যাঁ, এর পরেও যদি ঋন পরিশোধ না হয়, তিনি তার পাওনা সব টাকা বুঝে না পেয়ে থাকেন, তাহলে কথা দিলাম, বাকি ঋনের টাকা পরিশোধের দায়িত্বও আমারই। আমি জিম্মাদার হলাম। সময় মতো বাকি টাকা তাকে পরিশোধ করে দিবো ইনশাআল্লাহ।
জানাযায় উপস্থিত সকল মানুষ অবাক, বিস্মিত এবং ঘটনার আকস্মিকতায় নির্বাক! অনেকের চোখের কোনে আন্দাশ্রুর ফোঁটা। বাবার প্রতি মেয়ের অনিঃশেষ ভালোবাসা, অপরিমেয় দরদ, অসাধারণ দায় এবং দায়িত্ববোধের এমন নিদর্শন কে, কবে কোথায় দেখেছে!
কিন্তু আশ্চর্য্যের এখানেই শেষ নয়। বরং আশ্চর্য্য হবার পালা শুরু সবেমাত্র।
সকলকে হতচকিত করে দিয়ে এবার পাওনাদার বলে উঠলেন, ইমাম সাহেব, মেহেরবানি করে জানাযা শুরু করুন। কিছুটা সময় আপনাদেরকে কষ্টকর অপেক্ষায় রাখার জন্য আমি বিনীতভাবে ক্ষমা চাচ্ছি। জানাযা নামাজ শুরু করতে দেরি করিয়ে দেয়ার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত! সত্যি ঘটনা হচ্ছে, আসলে আমি আমার বন্ধুর কাছে কোনো টাকা পেতাম না বরং তিনিই সম্প্রতি আমাকে ১০ লক্ষ টাকা ধার দিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি তো মারা গেলেন। না ফেরার জগতে চলেন। কিন্তু তার অবর্তমানে সেই টাকাটা কাকে ফেরত দিবো- এরকম কোনো অসিয়ত আমাকে তিনি করে যাননি। তার উক্ত টাকার প্রকৃত হকদার কে হবেন- সেই লোকটিকে চেনার খুবই প্রয়োজন ছিল আমার। আর, সেই প্রয়োজনটি পূরণে এ ছাড়া আমার অন্য কোনো পথও ছিল না।
আলহামদুলিল্লাহ, সেই প্রয়োজন পূরণ হয়েছে। এখন বুঝতে পেরেছি, আমার বন্ধুর কন্যাই হলেন তার আমানতের প্রকৃত হকদার। ইনশাআল্লাহ, সময়মত আমি আমার বন্ধুর কন্যার হাতে তার আমানত যথাযথভাবে বুঝিয়ে দিবো।
নেক সন্তানঃ
সন্তান-সন্ততি আল্লাহ তাআলার এক মহা মূল্যবান নিআমত। এ শুধু পার্থিব অবলম্বনই নয়; আখেরাতের সম্বলও বটে। নিজের দুনিয়া ও আখেরাতকে সুন্দর করার পক্ষে বড় সহায়ক। সততা-যোগ্যতা ও তাকওয়া-তহারাতের উপর তাকে প্রতিষ্ঠিত করলে মা-বাবা দুনিয়া-আখেরাত সবখানে উপকৃত হবেন এবং মৃত্যুর পরও এই বৃক্ষের সুফল ভোগ করতে থাকবেন।
উপরোক্ত তিনটি বিষয় হাদীসে এভাবে ব্যক্ত হয়েছে-
إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ: إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ.
মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন তার তিনটি আমল ছাড়া সমস্ত আমল তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমল তিনটি হচ্ছে- সদকায়ে জারিয়া, এমন ইলম, যা থেকে উপকৃত হওয়া যায় এবং নেক সন্তান, যে তার জন্য দুআ করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৩১০
আরেকটি হাদীসে এসেছে, ‘মানুষ যা কিছু রেখে যায় তার মধ্যে তিনটি জিনিস উত্তম- নেক সন্তান, যে তার জন্য দুআ করে। এমন সদকা যা অব্যাহত থাকে। এর সওয়াব সে লাভ করে। এবং এমন ইলম, যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়।’ -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ২৪৯৫
এ তিনটি কাজ পৃথক পৃথকভাবেও বর্ণিত হয়েছে। উপকারী ইলম সম্পর্কে ‘সুনানে ইবনে মাজাহ’র (২৪০) একটি বর্ণনা এ রকম-
مَنْ عَلَّمَ عِلْمًا فَلَهُ أَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِه، لَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الْعَامِلِ.
যে কাউকে ইলম শিক্ষা দেয়, সে এ অনুযায়ী আমলকারীর অনুরূপ সওয়াব লাভ করবে। আমলকারীর সওয়াব থেকে কমানো হবে না।
অন্য এক হাদীসে এসেছে-
أَفْضَلُ الصَّدَقَةِ أَنْ يَتَعَلَّمَ الْمَرْءُ الْمُسْلِمُ عِلْمًا ثُمَّ يُعَلِّمَهُ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ.
উত্তম সদকা হল নিজে ইলম শিক্ষা করা এবং অপর মুসলিম ভাইকে তা শিক্ষা দেওয়া। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪৩
নেক সন্তান সম্বন্ধে এক হাদীসের ইরশাদ-
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَيَرْفَعُ الدَّرَجَةَ لِلْعَبْدِ الصَّالِحِ فِي الْجَنَّةِ، فَيَقُولُ: يَا رَبِّ، أَنَّى لِي هَذِهِ؟ فَيَقُولُ: بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ.
আল্লাহ তাআলা জান্নাতে নেককারের মর্যাদা উঁচু করলে সে জিজ্ঞেস করবে, হে আমার প্রতিপালক! এটা আমার জন্য কোথা থেকে এল? তিনি বলবেন, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ইস্তিগফারের কারণে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১০৬১০
গল্পটি থেকে গ্রহণীয় শিক্ষা:
গল্পে বর্ণিত ঘটনাটি বাস্তবিকই কোথাও ঘটেছিল কি না জানি না। তবে, দিনরাত পরিশ্রম করে সন্তানদের সুখের জন্য সম্পদ গড়ে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু কখনো চিন্তা করে দেখেছি কি, আমাদের ইহ-পারলৌকিক সুখের জন্যও সন্তানদের গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে কি না? জাগতিক শিক্ষা দীক্ষার পাশাপাশি, ছোটবেলা থেকে সন্তানদেরকে সঠিকভাবে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলেই কেবল এমনটা আশা করা যায়।
সৎ, নেককার এবং উত্তম সন্তান মৃত্যুর পরে আমাদের প্রত্যেকেরই সত্যিকারের সম্পদ। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লা আমাদেরকে সৎপথে চলার তাওফিক দান করুন। সুসন্তানের বাবা মা হিসেবে কবুল করুন।
গল্প সূত্রঃ মূল গল্পটি জনৈক ব্যক্তির ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। এখানে গল্পটি ইষৎ সংশোধিত ও পরিমার্জিত করে প্রকাশ করা হলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ দুপুর ২:৫৩