তাকবিরে তাশরিক: একত্ববাদের দৃপ্ত উচ্চারণ আল্লাহু আকবার ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে
থেকে থেকে, থেমে থেমে আজ তাকবিরের আওয়াজ উঠছে বিশ্বময়। কি জাপান, কি ইন্দোনেশিয়া, কি মালয়েশিয়া, কি আফ্রিকা, কি আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া আর ইউরোপ - সবখানে চলছে তাকবির ধ্বনি। তাইগ্রিস পাড়ের বাগদাদ, নীল নদের পাড়ের আলেকজান্দ্রিয়া আর কায়রো, হোয়াংহো তীরের বেইজিং, সুমিদা তীরের টোকিও, স্প্রীর স্নিগ্ধ জলের ধারা স্নাত বার্লিন, দানিয়ূব পাড়ের বুদাপেস্ট, লা প্লাটা নদী পাড়ের বুয়েন্স আয়ার্স, চাও ফ্রায়ার নদীর শান্ত জলধির পাশে গড়ে ওঠা শহর ব্যাংকক, টাইবারের স্রোতহীন জলরাশি স্নাত প্রাচীন শহর রোম, ডাংলিং পাড়ের সিডনি, ইয়াং সি কিয়াংয়ের স্বচ্ছ জলধারা বিধৌত হংকং, হুগলী পাড়ের কলকাতা, সিন্ধু অববাহিকার করাচি, যমুনা পাড়ের আগ্রা, সীন নদীর পাড়ের প্যারিস, মস্কোভা নদী তীরের প্রাচীন শহর মস্কো, টেমস এর শান্ত শীতল জলের ছোঁয়ায় সিক্ত লন্ডন আর হাডসন নদীর পলি বিধৌত সৌম্য শহর নিউইয়র্ক - কোথায়, কোন শহরে ধ্বনিত হচ্ছে না আজ তাওহিদের এই বুলন্দ তাকবির? সাদাদের দেশ ইউরোপ আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় তাকবিরের ধ্বনি উঠছে। একই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কালো মানুষের দেশ নাইজেরিয়া কিংবা ইথিওপিয়া- সর্বত্রই। পবিত্র জিলহজ্জ মাস চলছে। এই মাসের ৯-১৩ তারিখ তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা ওয়াজিব। আর এ কারণেই বিশ্বজুড়ে এই কয়েক দিন প্রতি ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পরে পঠিত হতে থাকবে অযুত কন্ঠে তাকবিরে তাশরিকের সুমধুর উচ্চারণ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেন,
وَاذْكُرُوا اللَّهَ فِي أَيَّامٍ مَّعْدُودَاتٍ
‘তোমরা আল্লাহকে স্মরণ করো (আইয়ামে তাশরিকের) নির্দিষ্ট দিনগুলোতে...। ’ -সুরা : বাকারা, আয়াত : ২০৩
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ
'.......এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে।' -সূরা হজ্ব : ২৮
এই আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলো দ্বারা প্রায় সকল ইসলামী স্কলারের মতে আশারায়ে যিলহজ্ব অর্থাৎ, যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের দশ দিন এবং তৎপরবর্তী আইয়ামে তাশরীকের তিনটি দিনসহ মোট এই তেরটি দিনই উদ্দেশ্য। বিশেষ করে এই দিনগুলোতে আল্লাহর যিকিরের প্রতি আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কারণ সম্পর্কে আল্লামা খাত্তাবী রাহ. বলেন, জাহেলী যুগের লোকেরা যুগ যুগ ধরে তাদের কথিত প্রভুদের নামে পশু-প্রাণী উৎসর্গ করত। এর প্রত্যুত্তরে মুমিনদের প্রতি আদেশ করা হয়েছে তারা যেন আল্লাহর যিকির ও তাকবীরের বুলন্দ আওয়াজের মাধ্যমে তাওহীদ তথা আল্লাহ তাআ'লার একত্ববাদ এবং একমাত্র তাঁর আনুগত্যের ঘোষণা দান করে এভাবে যে, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। তিনিই একমাত্র ইলাহ। তাঁর কোনো শরীক নেই। প্রশংসাপ্রাপ্তির একমাত্র অধিকার তাঁরই রয়েছে। সমস্ত প্রশংসা কেবলমাত্র তাঁরই। সুতরাং, তাঁর পবিত্র নাম ব্যতিত আর কারো নামে প্রাণী উৎসর্গ করা যাবে না। কারণ তা সুস্পষ্ট শিরক। -ফাতহুল বারী ২/৫৩৫
সাহাবায়ে কেরাম এই দিনগুলোতে সর্বদা আল্লাহু আকবারের ধ্বনি তুলতেন। হযরত ইবনে উমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু বাজারে গিয়ে তাকবীরের আওয়াজ তুলতেন। শুনে শুনে লোকেরাও তাদের সাথে তাকবীরের সুর তুলতেন। ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু তাআ'লা আনহু পথে-ঘাটে, হাঁটা-বসায়, বাজারে-ঘরে এবং নামাযের পরে শুধুই তাকবীর বলতে থাকতেন। মিনার দিনগুলোয় তার তাকবীরের সাথে সমস্বরে মানুষের তাকবীর ধ্বনি মিনার পুরো অঙ্গন মুখরিত হয়ে উঠতো। মহিলারাও (নিচু স্বরে) তাকবীর বলতে থাকতেন। -বুখারী-ফাতহুল বারী ২/৫৩০-৫৩৬
জিলহজের ফজিলতপূর্ণ প্রথম দশকের অন্যতম একটি আমল হচ্ছে তাকবিরে তাশরিক। তাকবীরে তাশরিক হচ্ছে-
الله أكبر، الله أكبر، لاإله إلا الله، والله أكبر الله أكبر ولله الحمد
উচ্চারণঃ আল্লা-হু আক্বার, আল্লা-হু আক্বার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লা-হু, ওয়াল্লা-হু আকবার আল্লা-হু আক্বার ওয়া লিল্লা-হিল হাম্দ।
অনুবাদ : ‘আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নাই; আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান এবং আল্লাহর জন্যই সকল প্রশংসা।’
তাকবিরে তাশরিক কখন পাঠ করতে হবে?
হজের মাস জিলহজের ৯-১৩ তারিখ পর্যন্ত দিনগুলোতে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করতে হয় বলে এই দিনগুলোকে বলা হয় 'আইয়ামে তাশরিক'। ৯-১৩ তারিখ পর্যন্ত এই ৫ দিন প্রতি ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পরে (মোট ২৩ ওয়াক্ত) তাকবিরে তাশরিক ১ বার পাঠ করা ওয়াজিব বা আবশ্যক আমল।
২০২২ এর তাকবিরে তাশরিক পাঠের সময়কালঃ
এ বছর ২০২২ ইং সাল অর্থাৎ, ১৪৪৩ হিজরির তাকবিরে তাশরিক ০৯/০৭/২০২২ ইং তারিখ রোজ শনিবার ফজরের নামাজের পর থেকে শুরু হয়েছে এবং আগামী বুধবার আসরের নামাজের পরে পাঠ করার পরে ৫ দিন পূর্ণ হবে। জামাআতে নামাজ আদায় করা হোক বা একাকী, পুরুষ বা নারী, মুকিম বা মুসাফির নির্বিশেষে সবার ওপর এই তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা ওয়াজিব। পুরুষগণ শব্দ করে উঁচু আওয়াজে তাকবির পাঠ করবেন। পক্ষান্তরে মহিলাগন নিচু আওয়াজে এটি পাঠ করবেন।
তাকবির ঠিক কোন সময়টিতে এবং কিভাবে পড়া উচিত?
শুধুমাত্র প্রত্যেক ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর পরপরই কোনো কথাবার্তা না বলে তাকবিরে তাশরিক পড়তে হবে। সুন্নত, বিতর কিংবা অন্য কোন নামাজ শেষে এই তাকবির পাঠের নিয়ম নেই। বলা বাহুল্য, এই তাকবিরে তাশরিক পুরুষদের জন্য জোরে সশব্দে পাঠ করা ওয়াজিব বা আবশ্যক এবং পুরুষদের জন্য নিম্নস্বরে এটি পাঠ করা সুন্নত পরিপন্থী। যদিও আমাদের অধিকাংশ মসজিদে জামাআতে নামাজ আদায় শেষে এবং অন্যান্য নামাজী ব্যক্তিদের একাকি নামাজের পরে তাকবিরে তাশরিক নিচু আওয়াজেই পাঠ করতে দেখা যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যেন তাকবিরের এই শব্দমালা উচ্চারণ করতে আমরা ব্যাপকাকারে লজ্জা পাই। লজ্জায় আড়ষ্ট কন্ঠে তাকবিরের ধ্বনি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে না আমাদের। হায় হায়! আমাদের কী হলো! যিনি এমন সুন্দর জ্বিহবা, ঠোট এবং মুখ দিলেন, কথা বলার ক্ষমতা দিলেন, সেই মহান আল্লাহ তাআ'লার বড়ত্বের বুলন্দ আওয়াজ তাকবিরে তাশরিককে একটু উঁচু আওয়াজে পাঠ করলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যায়! তাঁর বড়ত্ব ও মহত্বের অমোঘ ঘোষনাকে আকাশে বাতাসে, ইথারে - এককথায় দিক দিগন্তে ছড়িয়ে দিতেও এমন কার্পন্য কেন! হায় হায়! এই মুখ নিয়ে কাল কেয়ামতের কঠিন দিনে কিভাবে দাঁড়াবো মহান মালিকের সামনে!
মাআরিফুল কুরআনের লেখক মুফতি শফি (রহ.) লিখেছেন, তাকবিরে তাশরিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সালাম ফিরানোর পর এমন উচ্চেঃস্বরে পড়বে, যেন ইসলামের মহত্ত্ব প্রকাশ পায়। এই দোয়া নারীদের ওপরও পড়া ওয়াজিব। তাকবিরে তাশরিক নারীদেরও পড়তে হবে—এটাই ইসলামের বিধান। এই ব্যাপারে অনেক উদাসীনতা দেখা যায়। নারীরা নামাজের সালাম ফিরানোর পর এই দোয়া পড়তে ভুলে যায়। পুরুষরা মসজিদে জামাত শেষে সবাই একসঙ্গে পড়ে ফেলে এ কারণে সহজেই স্মরণ হয়ে যায়। নারীরা সাধারণত ঘরে একা একা নামাজ পড়ে। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশির ভাগ সময় তাদের তাকবিরে তাশরিক পড়তে স্মরণ থাকে না, পড়াও হয় না। বিশ্বখ্যাত আলেম মুফতি তাকি উসমানি স্মরণ রাখার সুন্দর একটি পদ্ধতি বলে দিয়েছেন। নারীরা যে স্থানে নামাজ পড়ে, ওখানে একটা কাগজে দোয়াটি লিখে রাখলে নামাজ শেষে স্মরণও থাকবে পড়াও হবে। এই দোয়া আমরা নিজেরাও পড়ব, পরিবারের সবাইকে পড়তে উৎসাহিত করব।
তাকবিরে তাশরিকের সূচনা
হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যখন শিশুপুত্র ইসমাইলকে কুরবানির নির্দেশ পালনে জবেহ করার জন্য মাটিতে শোয়ালেন, তখন আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে জান্নাত থেকে দুম্বা নিয়ে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এর ছুরির নিচে দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।
নির্দেশ মত হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম জান্নাতের সুসজ্জিত একটি দুম্বা নিয়ে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কুরবানিগাহের দিকে আসছিলেন। তিনি দ্রুত আসছিলেন। কত দ্রুত তা ব্যাখ্যাতীত। ফেরেশতাগণ নূরের তৈরি। নূর মানে, আলো। আলোর গতি আমাদের জানা। সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। কিন্তু ফেরেশতাগণ নূর বা আলোর তৈরি বলে তাদের চলার গতিকে আলোর গতির সমান মনে করা মূর্খতা। কারণ, আল্লাহ প্রদত্ত তাদের অপরিমেয় গতি পরিমাপের আসলে কোন সুযোগ আদৌ নেই। কুরআন হাদিসে এই বিষয়ক বিভিন্ন ইঙ্গিত থাকলেও একেবারে সঠিক সংখ্যায় এটি পরিমাপ করা দুরূহ বৈকি। আল্লাহ তাআ'লার বিশেষ সৃষ্টি তারা। তাঁর হুকুমের অধীনে থেকেই তারা সবকিছু করেন। মুহূর্তের জন্য সীমালঙ্ঘন বা অবাধ্যচারণ করেন না।
হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম জান্নাতের দুম্বা নিয়ে যখন ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কুরবানিগাহের দিকে আসছিলেন তখন তার মনে সন্দেহ হচ্ছিল যে, তিনি এসে পৌঁছার পূর্বেই ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছুরি চালিয়ে দেন কি না। তাই তিনি খুব দ্রুত পথ অতিক্রম করছিলেন। একপর্যায়ে হযরত ইসমাইলকে জবাই করার আগে তিনি যাতে দুম্বা নিয়ে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ছুরির নিচে সেটিকে পৌঁছে দিতে পারেন সে জন্য তাকবিরের আওয়াজ দেন। হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের প্রত্যাশা ছিল, এই তাকবির ধ্বনি শ্রবণের কারণে যাতে করে হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম স্বীয় পুত্রকে জবেহ করতে কিছুটা বিলম্ব করেন। এই লক্ষ্যে তিনি আকাশে থাকতেই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে থাকেন- اَللهُ اَكْبَر – اَللهُ اَكْبَر উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, অর্থাৎ, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান।
অতঃপর ঠিকঠিকই হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম উর্ধ্ব গগনব্যাপী ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হওয়া তাকবিরের এই বুলন্দ আওয়াজ শুনে কাপড় দ্বারা আবৃত নিজের চোখ খুলে তাকালেন। তাকবির ধ্বনির উৎস অনুসন্ধান করে দেখলেন যে, হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের কন্ঠেই দেয়া হয়েছে এই তাকবির। চোখ খুলে তিনি এ-ও দেখলেন যে, হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের আনিত জান্নাতের দুম্বা হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের পরিবর্তে ইতোমধ্যেই কুরবানি হয়ে গেছে। হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে নিজের পাশেই উপবিষ্ট পেলেন সশরীরে সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায়। আল্লাহ তাআ'লার বিশেষ অনুগ্রহে জান্নাতের দুম্বা কুরবানি হয়ে গেছে, প্রাণাধিক প্রিয় আপন পুত্রের জীবন রক্ষা পেয়েছে - এর চেয়ে খুশি এবং আনন্দের বিষয় আর কী থাকতে পারে! তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে তিনিও বুলন্দ আওয়াজে হৃদয়ের অনুপম অনুভূতি ও ভালোবাসা নিয়ে তাওহিদের কালিমা ও তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করে বলে উঠলেন- لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ اَللهُ اَكْبَر বাংলা উচ্চারণ: লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, অর্থাৎ, আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; আপনিই শ্রেষ্ঠ।
আপন পিতা হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে তাওহিদের কালিমা ও আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করতে দেখে শিশুপুত্র হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামও আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রশংসা করে বলে ওঠেন- اَللهُ اَكْبَر وَ لِلهِ الْحَمْد উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ, অর্থাৎ, আল্লাহ মহান, সকল প্রশংসা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য।
হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম, হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের তাকবির, তাওহিদের কালিমার প্রশংসা আল্লাহর কাছে এতই পছন্দনীয় হয়ে যায়, একজন সম্মানিত ফেরেশতা, একজন বিশিষ্ট নবী যিনি খলীল উপাধীতে ভূষিত এবং আরেকজন শিশু বয়সের যিনিও সম্মানিত ভাবী নবী, অর্থাৎ বয়োপ্রাপ্ত হয়ে তিনিও নবী হয়েছিলেন - এই তিনজনের মুখ নিঃসৃত অমিয় বাণী মহান রবের কাছে এমনভাবে এবং এতটাই গ্রহণযোগ্য হয়ে যায় যে, তিনি কেয়ামত পর্যন্ত এই শব্দমালাকে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের মুখে মুখে আওড়ে যাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। প্রতি বছর জিলহজ মাসের নির্দিষ্ট দিনগুলোতে এই কালিমাসমূহ পাঠ করাকে তিনি বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। হজ পালনকারী, কুরবানি দাতাসহ মুসলিম উম্মাহর নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য জিলহজ মাসের ৯-১৩ পর্যন্ত এ ৫ দিন তাকবিরে তাশরিক পড়াকে মহান রব্বুল আলামীন আবশ্যক করে দিয়েছেন।
যে মহান শিক্ষা লুকিয়ে রয়েছে তাকবিরে তাশরিকের মাঝেঃ
বলাবাহুল্য, এই তাকবিরে তাশরিকের পেছনে রয়েছে আল্লাহ তাআ'লার মুহাব্বত ও ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার অনন্য সাধারণ ও অচিন্ত্যনীয় এক আলোকিত প্রেক্ষাপট। প্রাণাধিক প্রিয় শিশু সন্তানের প্রতি পিতার অপরিমেয় ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে মহান মালিক রব্বুল আলামীন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআ'লার ভালোবাসা ও মুহাব্বতকে সকল কিছুর উর্ধ্বে তুলে ধরে প্রত্যেক বিষয়ে তাঁর আদেশ, নির্দেশ ও সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত এবং একমাত্র পালনীয় জ্ঞান করার এই শিক্ষাই লুকিয়ে রয়েছে তাকবিরে তাশরিকের পেছনে। কুরবানির আসল শিক্ষাও এটাই। তাকবিরে তাশরিকের ভাব, মর্মার্থ ও শিক্ষা নিজেদের মধ্যে লালন করতে পারলেই কুরবানি তথা আত্মত্যাগ স্বার্থক ও সফল হবে বলে ধরে নেয় যায়।
শেষের প্রার্থনাঃ
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাকবিরে তাশরিকের সঠিক ইতিহাস জেনে নিয়ে উল্লিখিত দিনগুলোতে শুকরিয়া হিসেবে এ ওয়াজিব কাজটি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করার তাওফিক দান করুন। মুসলিম উম্মাহর প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ, মুকিম-মুসাফির, গ্রামবাসী-শহরবাসী এবং জামায়াতে কিংবা একাকি নামাজ আদায়কারী প্রত্যেককেই দান করুন। হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম, হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের তাকবির, তাওহিদের কালিমার প্রশংসা আল্লাহর কাছে যেমনভাবে পছন্দনীয় হয়েছিল আমাদের থেকেও তিনি একইভাবে তা কবুল করে এর মাধ্যমে তাঁর একান্ত নৈকট্য অর্জনের খোশ কিসমত নসিব করুন। তাওহিদ, আল্লাহর বড়ত্ব ও প্রশংসার কথামালার এই বাক্য পাঠে উচ্চকিত করে তোলার তাওফিক দান করুন পৃথিবীর প্রতিটি জনপদ। অনুপম এ জিকির গুঞ্জরিত হোক, প্রতিটি মসজিদে, প্রতিটি মুসলিমের ঘরে; প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মুখে। আমিন।
পোস্টে যুক্ত তাকবিরে তাশরিক বিষয়ক তথ্যসমূহ আরও বিস্তারিত জানার জন্য যেসব সূত্র দেখে নেয়া যেতে পারে: রদ্দুল মুহতার ২/১৭৭-১৮১; ফাতওয়া হিন্দিয়া ১/১৫২; আল বাহরুর রায়েক ২/১৬৪-১৬৫, ইলাউস সুনান ৮/১৪৮-১৬২; বাদায়েউস সানায়ে’ ১/৪৫৮-৪৬৫।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২২ দুপুর ১২:০৭