somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

নতুন নকিব
আলহামদুলিল্লাহ। যা চাইনি তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন প্রিয়তম রব। যা পাইনি তার জন্য আফসোস নেই। সিজদাবনত শুকরিয়া। প্রত্যাশার একটি ঘর এখনও ফাঁকা কি না জানা নেই, তাঁর কাছে নি:শর্ত ক্ষমা আশা করেছিলাম। তিনি দয়া করে যদি দিতেন, শুন্য সেই ঘরটিও পূর্নতা পেত!

খসে পড়লো আরও একটি নক্ষত্র; 'গেদু' সম্বোধনে ডাকা মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছেন একে একে

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
খসে পড়লো আরও একটি নক্ষত্র; 'গেদু' সম্বোধনে ডাকা মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছেন একে একে

ছবি গুগল থেকে সংগৃহিত।

মাথার উপরে থাকা নক্ষত্রগুলো একে একে খসে পড়ছে। ছায়াদার বৃক্ষগুলো যেন সরে যাচ্ছে একে একে। পরম মমতাময়ী মা চলে গেলেন ১৯৯৫ সালের কোন রৌদ্র করোজ্জ্বল দিনের ভর দুপুরে। অনেকটাই আচমকা, কাউকে কিছু না বলে। আমাদের কাউকে কোন কিছু বুঝে উঠতে না দিয়ে হঠাৎ ঘুর্ণিঝড়ের মতই, আচমকা আসমান ভেঙে পড়ার মতই ছিল মায়ের সেই চলে যাওয়া। আত্মীয়-পরিজন পরিবেষ্টিত আমাদের সাত ভাই-বোনের সদা সরগরম সুবিশাল পরিবারে যেন নেমে এল মৃত্যুর নিরবতা। মহান মালিক রব্বে কারিমের অমোঘ ইশারা বুঝার সাধ্য কারও নেই। তাঁর ডাকে সারা দিয়ে আসা যাওয়ার চিরন্তন নিয়তিকে মেনে মা চলে গেলেন ওপাড়ের সুন্দর ভূবনে। মায়ের আজীবনের অভ্যাস ছিল, দীর্ঘ সময় তিনি নামাজে কাটাতেন। এমনটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না যে, ফজর নামাজ বাদ তিনি তার নির্ধারিত অজিফা পাঠে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেননি।

কুরআন তিলাওয়াত তার প্রিয় আমল। পাশাপাশি তাহাজ্জুদ, আওয়াবীন, ইশরাকসহ অন্যান্য নফল নামাজের এমন নিখাদ পাবন্দি খুব কমই চোখে পড়ে। ইনতিকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত মা ছিলেন আত্মনির্ভরশীল। নিজের কাজ নিজে করেছেন। সাহায্য করেছেন অন্যদেরও। আত্মীয় স্বজন, ছেলে মেয়ে, নাতী নাতনীতে ভরপুর সংসারে থাকার পরেও আমাদের কারও প্রতি নির্ভরতায় তাকে কাটাতে হয়নি একটি দিনও। এমনকি জীবনের শেষ দিনটিতেও তিনি ছিলেন পূর্ণ সক্ষমতায় অটুট। নিয়মিত আমল ও ইবাদাতগুলো পালনে সেদিনও ব্যত্যয় ঘটেনি তার। বরং তিনি সবই করতে সক্ষম হয়েছেন যথারীতি। এই যে আত্মনির্ভরতা, অন্যের উপরে বোঝা হয়ে কারও কষ্টের কারণ না হয়ে জীবনের দিনটির শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাটাতে পারা - এটাকে হয়তো মহান রবের পক্ষ হতে তার প্রতি বিশেষ রহমত এবং একান্ত অনু্গ্রহই বলতে হবে। যে দিনটিতে চলে গেলেন মহান মালিকের ডাকে, সেদিনও তিনি ছিলেন সজীব, প্রাণবন্ত এবং পরিপূর্ণ সুস্থ।

মায়ের শেষ বিদায়ের দিনটিতেও মা আমাদের সকালের নাস্তা নিজ হাতে পরিবেশন করে খাইয়েছেন। খাবার খাওয়ার পরে আমরা যার যার কাজে বাইরে চলে যাই যার ফলে মায়ের অন্তিম মুহূর্তটিতে তার আশেপাশে আমরা ছিলাম না। তবে যারা ছিলেন তাদের কাছে শুনেছি যে, মা দুপুরের খাবার রান্না করতে গিয়েছিলেন। সেই রান্না চলাকালীন সময়েই তার শরীর খারাপ লাগলে তিনি পাশের একজনকে তা জানান এবং খাটে না শুয়ে তার জায়নামাজের পাটি বিছিয়ে সেটিতেই তিনি শুয়ে পড়েন। ধারণা করা অমূলক নয় যে, জায়নামাজের চিরচেনা প্রিয় পাটিতেই হয়তো ছিল তাঁর শেষ নিঃশাস।

পরবর্তীতে নশ্বর এই পৃথিবীর মায়ার সকল বন্ধন ছিন্ন করে চলে যাওয়ার এই ধারাবাহিকতায় যোগ দেন বড় বোন ফাতিমাতুজ্জাহরাও। তিনিও একইরকমভাবে মায়ার সকল বাঁধন ছিন্ন করে পরপারে পাড়ি জমালেন ২০০৭ সালের কোন এক বেদনাবিধুর মেঘাচ্ছন্ন দিনে। বৃহস্পতিবারের সেই দিনটি আজও জ্বলজ্বলে হয়ে আছে স্মৃতির আয়নায়।

এরপরে মাথার উপরে ছায়া হয়ে ছিলেন মমতার আধার, ভরসা এবং নির্ভরতার স্থল প্রিয়তম আব্বা। নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে আমাদের যিনি আগলে রাখতেন, যার স্নেহের আতিশয্যে মায়ের অভাব বুঝতে পারতাম না, প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে পাগলপারা হয়েও যিনি ভেঙে পড়েননি মুহূর্তকালের জন্য, অশীতিপর বৃদ্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, আশির কোটা পেরিয়েও যিনি ছিলেন সতেজ সবল এবং হৃদয়ের বলে বলিয়ান। মায়ের অনাবিল আদরের বিশাল শুন্যতাকে তিনি আমাদের বুঝতে দেননি, অনুভব করতে দেননি। মা আমাদের জন্য যেভাবে সুস্বাদু নানাবিধ খাবার অতি যত্নের সাথে রান্না করতেন আব্বা সেই কাজটিও করতে চাইতেন অতি সন্তর্পণে, নিষেধ করার পরেও তিনি নিজে রান্না করতে যেতেন, এবং আমাদের বারণ কিংবা নিষেধ উপেক্ষা করেই তা করে যেতেন।

স্বজন প্রিয়জনেরা আব্বার দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়ে আলোচনা তুললে বিনয়ের সাথে তাকে তা প্রত্যাখ্যান করতে দেখেছি বরাবরই। এবং মায়ের বিয়োগজনিত গভীর শুন্যতায় এইভাবে একাকিত্বের জীবন তিনি কাটিয়েছেন দীর্ঘ প্রায় ২০ টি বছর। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসা, তাঁর প্রিয়তম হাবিব হুজুরে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি নিঃশর্ত প্রেম ও হৃদয় নিংড়ানো আবেগ ছিল তাঁর নিত্যদিনের চলার পথের পাথেয়। তিনিও মহান মালিকের ডাকে সারা দিয়ে জান্নাতের বাসিন্দা হলেন ২০১৫ সালের কোন এক স্নিগ্ধ প্রহরে।

রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রিয় প্রসঙ্গ আতর-সুগন্ধির প্রতি ছিল আব্বার অন্যরকম হৃদ্যতা। তিনি ভালোবাসতেন আল্লাহওয়ালা এবং আলেম উলামাদের। ভালোবাসা রাখতেন দক্ষিনবঙ্গের আধ্যাত্মিক সাধকদের পদচারণায় মুখর পাঙ্গাশিয়া এবং ছারছিনা দরবারের সাথে। মোকামিয়া, ভয়াং, ফুরফুরাসহ হকপন্থী সকল দরবারের সাথে তার ছিল আত্মার বন্ধন। আল্লাহ তাআলা তাঁর কবরকে জান্নাতের সুঘ্রাণ দিয়ে বিমোহিত করে দিন। আল্লাহ তাআলা তার কবরকে জান্নাতের স্নিগ্ধ আলোকাভায় আলোকিত করুন।

দিন যায় মাস যায় বছর পেরিয়ে আগমন ঘটে নতুন বছরের। সময়ের পরিক্রমায় আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি জীবনের নানান আয়োজনে প্রয়োজনে। আবার হঠাৎ করে মালিকের ডাক এলো ২০২২ সালের সমাপ্তি লগ্নে। ২২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ০৭:০০ টায় মেঝ বোন জাহানারাও চলে গেলেন, না ফেরার দেশে। মেঝ বোনকে আমরা 'বুঝি' বলে ডাকতাম। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় কথা বলতে পারতেন না 'বুঝি'। ছিল না তাঁর চেতনাও। কিন্তু মাথার পাশে দাঁড়িয়ে 'বুঝি' বলে ডাক দিতেই ডান হাতটা নাড়াচাড়া করলেন। চোখের অশ্রু বাঁধ মানছিল না সেই সময়টিতে। মনে হচ্ছিল তিনি যেন বলতে চাচ্ছেন কত জনমের না বলা কত কথা। ব্রেইন স্ট্রোক করে চেতনা হারিয়ে হাসপাতালের বেডে নিথর দেহে পড়েছিলেন জীবনের শেষ ছয় ছয়টি দিন। অচেতন অবস্থায় থাকার পরেও যেন তিনি ছিলেন সজাগ, সজীব এবং অনুভব অনুভূতিতে প্রাণবন্ত।

শেষ দিনগুলোতে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বুঝির কাছে আমাদের থাকার সুযোগ কমই হয়েছিল। থেকেছি অনেকটাই দূরে, চোখের আড়ালে; কিন্তু মনের আড়াল হতে দিতেন না কখনোই। সর্বদাই যেন আগলে রাখতেন পরম মমতায়। ফোনে কথা হলে প্রায়ই তার কন্ঠে ফুটে উঠতো উদ্বেগ, উৎকন্ঠা আর আকুলতা, 'তোর গলা এমন শোনা যায় কেন?' শরীর খারাপ কি না- জানতে চাইতেন বারংবার। 'গেদু' সম্বোধনে ডাকতেন তিনি কখনো কখনো। 'গেদু' সম্বোধনটা শুনলেই মনটা মোচর দিয়ে উঠতো। 'গেদু' সম্বোধনে এমন নিঃসীম আদরে ডাকার মানুষগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন ক্রমশঃ। হয়তো একসময় আর কেউই থাকবেন না। হয়তো একসময় মাথার ওপরে ছায়া হয়ে থাকা সকলেই চলে যাবেন একে একে আসল গন্তব্যপানে।

ওপাড়ের অচেনা রঙিন জগতে ভালো থাকুন প্রিয়তম মা, প্রিয়তম আব্বা, প্রিয় বোন ফাতিমাতুজ্জাহরা বুয়া, প্রিয় জাহানারা বুঝি। সকলকেই জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে ভূষিত করুন মহান প্রতিপালক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:৪৩
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×