২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান বা আত্মগোপনে চলে যান। তাদের দাবি, তারা কোনো অপরাধে জড়িত নন। পলাতক হাসিনার মুখেও এই কথা শোনা গেছে যে, আমার দোষটা কোথায়? প্রশ্ন হচ্ছে, তারা যদি দোষীই না হয়ে থাকেন, তাহলে কেন তারা জনগণের মুখোমুখি হওয়ার সাহস না দেখিয়ে পালিয়ে গেলেন? এই প্রশ্ন বাংলাদেশের জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের দুঃশাসনের কারণে সৃষ্ট জনরোষের তীব্রতা আর দেশবাসীর অপরিমেয় ক্ষোভই তাদের পলায়নের পেছনে প্রধান কারণ। এর সাথে আরও কিছু কারণ রয়েছে যা নিচে বিশ্লেষণ করা হলো:
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া গণ-অভ্যুত্থান শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণে রূপ নেয়। এই আন্দোলনে শত শত মানুষ নিহত হন, যার জন্য জনগণ আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছে। শেখ হাসিনার বাসভবন (গণভবন), আওয়ামী লীগের কার্যালয় এবং নেতাদের বাড়িঘরে জনতার হামলা ও লুটপাটের ঘটনা স্পষ্ট করে দেয় যে আওয়ামী লীগের নেতারা জনগণের কাছে কতটা অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন। এই ভয়াবহ জনরোষের মুখে তারা পালিয়ে যাওয়াকেই নিরাপদ মনে করেছেন। তাদের এই পলায়ন জনগণের কাছে তাদের দুর্বলতা এবং অপরাধবোধের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এবং আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সরকারি সম্পদ লুটপাটের অভিযোগে মামলা দায়ের করতে শুরু করেন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়। আওয়ামী লীগের নেতারা জানতেন যে তাদের শাসনামলে জনগণের উপর চালানো বহুমাত্রিক ও পৈশাচিক নির্যাতন এবং অর্থনৈতিক শোষণের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর বিচারের কারণ হতে পারে। এমনকি যারা সরাসরি দোষী নন, তারাও ভয় পেয়েছিলেন যে তারা ন্যায়বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হবেন। ফলে, তারা ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা অন্যান্য দেশে পালিয়ে যান।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী, ব্যাপক দমন-পীড়নের শিকার হয়। হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং মামলার মুখোমুখি করা হয়। বিরোধী মতের শত শত লোককে গুম করা হয়। আয়নাঘর নামে বিরোধীদের দমনে বিশেষ নির্যাতনের পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়। ২০২৪ সালে হাসিনার পতনের পর বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া মুক্তি পান এবং জামায়াতে ইসলামীর উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের নেতারা আশঙ্কা করেছিলেন যে তাদের দীর্ঘদিনের শত্রুরা এখন ক্ষমতায় এসে প্রতিশোধ নেবে। এই ভয় তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। জনগণের কাছে তাদের এই পলায়ন প্রমাণ করে যে তারা তাদের অতীত কর্মের ফল ভোগ করতে ভয় পাচ্ছিলেন।
গণ-আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ে এবং দলটি জনগণের সমর্থন হারায়। দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জনগণের উপর নির্যাতনের কারণে আওয়ামী লীগ নেতারা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক নেতার বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এই পরিস্থিতিতে তারা বুঝতে পারেন যে বাংলাদেশে তাদের আর নিরাপদ আশ্রয় নেই। জনগণের এই তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়ে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, যা জনমনে তাদের দায়িত্ব এড়ানোর প্রমাণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা নিজে ভারতে আশ্রয় নেন, এবং অনেক আওয়ামী লীগ নেতা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক সম্পর্ক এবং হাসিনার ভারতপ্রীতি তাদের জন্য ভারতকে একটি নিরাপদ গন্তব্য করে তুলেছে। কেউ কেউ রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন, আবার কেউ নতুন করে সেখানে জীবন শুরু করার চেষ্টা করছেন। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় দাবি করেছেন যে তার মা রাজনীতিতে ফিরবেন এবং আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করবেন। এটি ইঙ্গিত দেয় যে কিছু নেতা বিদেশ থেকে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তবে, জনগণের কাছে এই পলায়ন তাদের জনগণের মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে পিছু হটার স্পষ্ট প্রমাণ।
আওয়ামী লীগের নেতারা যদি ধোয়া তুলসি পাতা হতেন, সত্যিই যদি নির্দোষ হতেন, তাহলে কেন তারা জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন না? কেন তারা বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সাহস দেখালেন না? জনগণের তীব্র ক্ষোভ, দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও নির্যাতনের অভিযোগ, এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ভয় তাদের পালাতে বাধ্য করেছে। তাদের এই পলায়ন শুধু তাদের নিরাপত্তার জন্য নয়, বরং তাদের অতীত কর্মের ফল এড়ানোর একটি কৌশল। জনগণের কাছে এটি স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগের নেতারা জনগণের রায়ের মুখোমুখি হতে ভয় পেয়েছেন। তাদের পলায়ন বাংলাদেশের জনগণের বিজয় এবং আওয়ামী লীগের নৈতিক পরাজয়ের প্রতীক।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১১:১০