১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ শেখ হাসিনার জীবনে এক বিপর্যয়ের সূচনা করে। সে সময় ভারত তাকে গ্রহণ করে যে রাজনৈতিক আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়েছিল, তা কেবল মানবিক নয়, ছিল সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক হিসাবের অংশ। নয়াদিল্লির ছায়াতলে ছয় বছরের নির্বাসনেই তৈরি হয়েছিল এক নিঃশব্দ বন্ধন, যার পরিণাম ছিল দীর্ঘস্থায়ী ও বহুমাত্রিক। তিনি আবদ্ধ হন ভারতের জনম জনমের ঋণের বেড়াজালে।
২০০৮ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর সেই ঋণ শোধের এক সুদীর্ঘ অধ্যায় শুরু হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যেন একতরফা উদারতার প্রতীক হয়ে ওঠে। চুক্তি হোক বা সীমান্ত সংঘর্ষ, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ হোক কিংবা সাংস্কৃতিক বিনিময়—প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছিল অধিক দানকারী, আর ভারত তার সুবিধাভোগী।
হাসিনার অকপট স্বীকৃতিটা বড়ই চমৎকার যেখানে তিনি তার মনের কোনে লুকিয়ে রাখা গোপন কথাটা প্রকাশ করে দিয়েছেন, “ভারতকে যা দিয়েছি, ভারত সারা জীবন মনে রাখবে” বলে। তবে, সমালোচকদের মতে, এই ঋণ শোধের প্রক্রিয়ায় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থকে ভারতের স্বার্থের কাছে সমর্পণ করেছেন। ভারতের প্রতি তাঁর অতিরিক্ত নমনীয়তা এবং আনুগত্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে।
২০১৫ সালের সীমান্ত চুক্তি হোক কিংবা ভারতীয় বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগ, প্রতিটি উদ্যোগেই হাসিনা সরকারের আপোষমূলক অবস্থান ভারতকে দিয়েছে একচেটিয়া সুবিধা। অথচ এই সম্পর্কের বিপরীতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি রয়ে গেছে প্রশ্নবিদ্ধ। সীমান্তে ফেলানীর মতো নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ছিল নীরবতা, আর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও কূটনীতিতে ছিল ভারতের অযাচিত ছায়া।
এমনকি অর্থনীতিতেও তৈরি হয়েছে বৈষম্যের ফাঁদ—ভারতের বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশ সীমিত, অথচ আমাদের বাজারে ভারত দাপিয়ে বেড়ায়। সাংস্কৃতিক বন্ধুত্বের আড়ালে ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারের কৌশল, যা বাংলাদেশের স্বকীয়তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় সম্ভবত ২০২৪ সালের শুরুতে শেখ হাসিনার পুনরায় ভারতে গমন ও সেখানে আশ্রয় নেওয়া। ইতিহাস যেন পুনরাবৃত্তি করল, তবে এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। এই নতুন অধ্যায়ে প্রশ্ন উঠেছে—এই আশ্রয় কি নিছক নিরাপত্তার খাতিরে, নাকি আবারও কোনো গোপন সম্পর্কের ছায়ায় বাংলাদেশকে ঢেকে দেওয়ার চক্রান্ত?
এখন প্রশ্ন একটাই—এই ঋণের সীমা কোথায়? কবে নাগাদ এই অনুগত্য শেষ হবে? নাকি প্রভূ দেশ ভারতেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের পরবর্তী অধ্যায় লিখিত হবে? সমালোচকরা মনে করেন, শেখ হাসিনার ‘কৃতজ্ঞতা’র রাজনীতি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে এমন এক অসম সেতুতে দাঁড় করিয়েছে, যার ওপারে কেবল ভারতের স্বার্থই দৃশ্যমান।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১০