
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক নৈকট্যের গভীর বন্ধনে আবদ্ধ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংকটে দুই দেশ একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছে, সহযোগিতার অসংখ্য নজির স্থাপন করেছে। তবে, সময়ের সঙ্গে এই সম্পর্ক নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে—এটি কি সত্যিকারের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত, নাকি একতরফা প্রভাব ও কর্তৃত্বের ছায়ায় ম্লান?
বিশেষ করে বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক প্রায়শই ‘বড় ভাই-ছোট ভাই’ ধরনের গতিপথে চলেছে। এই সময়ে সম্পর্কের ভিত্তি কখনো কখনো নির্দিষ্ট দলীয় স্বার্থ ও আনুগত্যের ওপর নির্ভর করেছে, যা বাংলাদেশের সার্বভৌম মর্যাদার প্রতি প্রশ্ন তুলেছে। জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ, বিচারিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ—যেমন সুখরঞ্জন বালীকে বাংলাদেশের আদালত প্রাঙ্গন থেকে গুম করে নিয়ে ভারতের কারাগারে আটকে রাখার ঘটনা—এবং অন্যান্য বিতর্কিত ঘটনা জনমনে অস্বস্তি তৈরি করেছে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সদ্ভাব, সম্মান ও ন্যায় প্রত্যাশা করে, কোনো গোষ্ঠী বা দলের একচেটিয়া প্রভাব নয়।
নদী পানিবণ্টন, বিশেষত তিস্তা চুক্তির বিলম্ব, সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা, বাণিজ্যে অসমতা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হস্তক্ষেপের অভিযোগ এই সম্পর্কের ভারসাম্যকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সীমান্তে শতাধিক বাংলাদেশি নাগরিকের প্রাণহানির ঘটনা কেবল পরিসংখ্যান নয়, দুই দেশের মধ্যে আস্থার ঘাটতির প্রতীক। একইভাবে, ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশাধিকার বাড়ানোর ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বাধা দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে সীমিত করছে। এসব ইস্যুতে স্বচ্ছ ও ন্যায্য সমাধান ছাড়া সম্পর্কের গভীরতা প্রশ্নবিদ্ধ হতেই থাকবে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে টেকসই করতে হলে এটি অবশ্যই সমতা, ন্যায় ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে গড়ে উঠতে হবে। ভারতের উচিত বাংলাদেশকে একটি সমমর্যাদার অংশীদার হিসেবে দেখা, যার সার্বভৌমত্ব ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ সম্মান পায়। একইভাবে, বাংলাদেশেরও দায়িত্ব ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য বা বিতর্ক এড়িয়ে কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বন করা। সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো দল বা গোষ্ঠীর মনোপলি গ্রহণযোগ্য নয়; এটি রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে আস্থা ও বোঝাপড়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।
এই সম্পর্কের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কূটনৈতিক সদিচ্ছা ও স্বচ্ছ সংলাপ অপরিহার্য। তিস্তা পানিবণ্টনের মতো জটিল ইস্যুতে উভয় দেশের স্বার্থ বিবেচনা করে দ্রুত চুক্তি প্রয়োজন। সীমান্তে প্রাণহানি রোধে যৌথ টহল বা অস্ত্রের অ-প্রাণঘাতী ব্যবহারের নীতি কার্যকর করা যেতে পারে। বাণিজ্যে ভারসাম্য আনতে ভারত বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্কহ্রাস বা বাজার প্রবেশ সহজ করতে পারে। এছাড়া, সাংস্কৃতিক বিনিময়, শিক্ষার্থী ও পর্যটকদের জন্য ভিসা সহজীকরণ এবং যৌথ উৎসবের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্য বাড়ানো যায়।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কেবল সরকারি পর্যায়ে নয়, জনগণের মধ্যেও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে বা মিডিয়ায় একে অপরের প্রতি অপপ্রচার বা উসকানিমূলক মন্তব্য এই সম্পর্কের ক্ষতি করে। দুই দেশের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের দায়িত্ব ইতিবাচক সংলাপ প্রচার করা। উদাহরণস্বরূপ, যৌথ চলচ্চিত্র উৎসব, সাহিত্য মেলা বা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা দুই দেশের তরুণদের মধ্যে বন্ধন জোরদার করতে পারে। দলবদলের সঙ্গে সম্পর্ক বদলে যাওয়া কোনো রাষ্ট্রীয় কূটনীতির অংশ হতে পারে না।
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্বের সম্ভাবনা বহন করে, যদি তা ‘বড় ভাই-ছোট ভাই’ মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়ে সমতা ও আস্থার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। বন্ধুত্ব মানে একপাক্ষিক সমর্থন নয়, বরং দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ ও ন্যায্যতার প্রতি সম্মান। এই সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিতে হলে দরকার স্বচ্ছ কূটনীতি, জনগণের মধ্যে সৌহার্দ্য এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রতি অটল শ্রদ্ধা। সময় এসেছে সেই বিশ্বাস পুনঃস্থাপনের, যাতে ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের প্রকৃত অংশীদার হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:৫০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




