
ভূমিকা
নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়। পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন শুরু হয় ১৮শ শতকের শেষভাগে, যার ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে নারীবাদ (Feminism) একটি রাজনৈতিক ও দার্শনিক মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই নারীবাদের ঢেউ এসে লাগে উপমহাদেশের মুসলিম সমাজেও। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে প্রশ্ন হলো, ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি রাষ্ট্রে পাশ্চাত্য ঘরানার নারীবাদ কতটা গ্রহণযোগ্য? আরও গভীর প্রশ্ন হলো, এই নারীবাদ কি প্রকৃতপক্ষে নারীর সম্মান ও অধিকার রক্ষায় সহায়ক, নাকি তা ইসলামি সমাজ কাঠামো ধ্বংসের একটি উপায়মাত্র?
ইসলামী শরীয়তে নারীর মর্যাদা
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব সমাজে নারী ছিল অবহেলিত ও নির্যাতিত। ইসলাম নারীর মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। কুরআনে বহু আয়াতে নারীর অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। যেমন:
উত্তরাধিকার: “পুরুষদের জন্য রয়েছে যা তারা উপার্জন করে এবং নারীদের জন্য রয়েছে যা তারা উপার্জন করে।” (সূরা আন-নিসা: ৩২)
শিক্ষা: হাদীসে এসেছে—"জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর উপর ফরজ।" (ইবনে মাজাহ)
পরিবারে সম্মান: হাদীসে এসেছে—"তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।"
অর্থাৎ ইসলাম নারীকে ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করেছে—সমান নয়, বরং তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী ন্যায়ের ভিত্তিতে।
বাংলাদেশের নারী নীতির বিতর্ক
বাংলাদেশের বর্তমান নারী নীতির খসড়া ও প্রস্তাবনার দিকে তাকালে দেখা যায়, একাধিক ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীসের নির্ধারিত বিধান অগ্রাহ্য করে পশ্চিমা আদর্শকে অনুসরণ করা হয়েছে। বিশেষ করে ড. মুহাম্মাদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত নারী নীতি বাস্তবায়ন কমিটির কিছু সুপারিশে স্পষ্টভাবে ইসলামী শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক উপাদান লক্ষ্য করা গেছে:
উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সুপারিশ: শরীয়তে পুত্র ও কন্যার অংশ নির্ধারিত, যেখানে পুত্র দ্বিগুণ পায়। কিন্তু প্রস্তাবিত নারী নীতিতে সমান ভাগের কথা বলা হয়েছে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও পোশাক: নারীর পর্দা, মসজিদে অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে এমন কিছু নির্দেশনা রয়েছে যা ইসলামের নির্ধারিত সীমার বাইরে।
পারিবারিক কাঠামো: পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থাকে ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যা দিয়ে বিকল্প ‘লিঙ্গ-সমতা’ভিত্তিক কাঠামোর প্রস্তাব এসেছে।
এসব প্রস্তাব সরাসরি কুরআন, হাদীস ও ইসলামী শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক।
নারীবাদ: একটি আদর্শিক অনুপ্রবেশ?
নারীবাদ শুধুমাত্র একটি অধিকার আন্দোলন নয়, এটি একটি দার্শনিক মতবাদ। এতে নারীর ‘নিজস্বতা’কে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়, যা বহুক্ষেত্রে পারিবারিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্ব অস্বীকার করার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। মূলত নারীবাদ তিনটি তরঙ্গে (wave) বিভক্ত:
প্রথম তরঙ্গ – ভোটাধিকার ও শিক্ষার সুযোগের দাবিতে।
দ্বিতীয় তরঙ্গ – ১৯৬০-৭০ এর দশকে যৌন স্বাধীনতা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের বৈধতা ইত্যাদি বিষয়ে আন্দোলন।
তৃতীয় তরঙ্গ – সমকামী অধিকার, জেন্ডার নিউট্রাল নীতিমালা এবং 'টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি' ইত্যাদি।
এই তিনটি তরঙ্গই মূলত পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থায় নারীর নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত হলেও, তা এখন মুসলিম সমাজে আমদানি করা হচ্ছে, যেখানে ধর্ম ও সংস্কৃতি ভিন্ন।
ধর্মবিরোধী এজেন্ডা?
গবেষণা বিশ্লেষণে দেখা যায়, বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা (যেমন UN Women, USAID, Amnesty International) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘জেন্ডার ইকুইটি’ বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়ন করে। এই অর্থায়নের পেছনে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্যও থাকে। লক্ষ্য করা গেছে, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দেশের ভেতরে কিছু এনজিও, ব্যক্তিবিশেষ ও তথাকথিত নারীবাদী গোষ্ঠী সক্রিয় ভূমিকা রাখে, যারা ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বাঁধা হিসেবে চিহ্নিত করে।
উপসংহার
বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নারী উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তা হতে হবে ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। কুরআন ও হাদীসের আলোকে নারীকে যে সম্মান, অধিকার ও নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে তা পাশ্চাত্য নারীবাদের চেয়ে বহু গুণ শ্রেষ্ঠ ও টেকসই। কাজেই যারা ইসলামী আদর্শ অস্বীকার করে নারীবাদী নীতিমালা চাপিয়ে দিতে চান, তারা আসলে দেশের ধর্মীয় ও সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংস করতেই সচেষ্ট।
আমাদের করণীয় হলো—নারী উন্নয়নের নামে কোনো ধর্মবিরোধী মতবাদ বা নীতিকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে না দেওয়া এবং ইসলামের মূলনীতির আলোকে নারীর প্রকৃত মর্যাদা রক্ষায় সক্রিয় থাকা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



