ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর দমন-পীড়নের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় এবার যুক্ত হলো একটি নতুন উপকরণ—ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫। গুলি বা বুলডোজার নয়, এবার কাগজ-কলমের ছুতোয় রাষ্ট্রীয় আইনকাঠামোর আড়ালে মুসলিম ধর্মীয় ও জনকল্যাণমূলক সম্পদের উপর হস্তক্ষেপের পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। ওয়াকফ (আমানত) বিল, ২০২৫-এর মাধ্যমে মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান এবং অন্যান্য ওয়াকফ সম্পত্তির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও অমুসলিমদের প্রভাব বাড়ানোর পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। এই বিল মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের উপর সরাসরি আঘাত এবং ভারতের সংবিধানের মূলনীতির লঙ্ঘন।
ওয়াকফ: ইসলামী জনকল্যাণের চিরন্তন ভিত্তি
ইসলামী সমাজে ‘ওয়াকফ’ হলো এমন সম্পত্তি, যা চিরস্থায়ীভাবে ধর্মীয়, শিক্ষামূলক বা জনহিতৈষী কাজে ব্যবহারের জন্য উৎসর্গ করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই প্রথার মাধ্যমে মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, এতিমখানা ও দরিদ্র-সহায়তা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, এই সম্পদ ব্যবহার হয়েছে সর্বধর্মের মানুষের কল্যাণে।
বর্তমানে ভারতে প্রায় ৮.৭ লাখ ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, যা প্রায় ৯.৪ লাখ একর জমির উপর বিস্তৃত—এটি দেশের তৃতীয় বৃহত্তম ভূমি মালিকানা। এসব সম্পত্তি মুসলিম শাসক ও দাতাদের ঐতিহাসিক জনসেবামূলক চিন্তার প্রতীক। কিন্তু ওয়াকফ বিল, ২০২৫-এর মাধ্যমে সেই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর একটি নতুন হিন্দুত্ববাদী ছুরি চালানো হয়েছে।
ওয়াকফ বিল ২০২৫: একটি সংবিধানবিরোধী পদক্ষেপ
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট লোকসভায় বিলটি প্রথম উত্থাপন করা হয় এবং ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল লোকসভায় (২৮৮–২৩২ ভোটে) ও ৪ এপ্রিল রাজ্যসভায় (১২৮–৯৫ ভোটে) পাস হয়। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ৫ এপ্রিল এতে সম্মতি প্রদান করেন। বিলটি ওয়াকফ আইন, ১৯৯৫-কে আমূল বদলে দিয়ে নিচের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যুক্ত করেছে:
১. অমুসলিমদের নিয়োগের বিধান
ওয়াকফ বোর্ড ও কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলিম সদস্য নিয়োগের পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। এটি ভারতের সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদ—ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অধিকার—লঙ্ঘন করে এবং মুসলিমদের ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ করে।
২. ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বাতিল
অতীতে বহু সম্পত্তি শতাব্দীর পর শতাব্দী জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহৃত হওয়ায় ‘ওয়াকফ’ হিসেবে স্বীকৃত ছিল, এমনকি লিখিত দলিল ছাড়াই। নতুন আইনে এই প্রথাকে বাতিল করে বহু প্রাচীন মসজিদ ও প্রতিষ্ঠানকে অনিরাপদ করে তোলা হয়েছে।
৩. সরকারি হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি
ওয়াকফ সংক্রান্ত বিরোধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জেলা কালেক্টরের হাতে, যা কার্যত সরকারের হাতে মুসলিম সম্পদ দখলের বৈধ অস্ত্র তুলে দিচ্ছে।
৪. ধর্মবিশ্বাসের প্রমাণের শর্ত
ওয়াকফ প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম ব্যক্তিকে কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে ইসলাম পালনের প্রমাণ দিতে হবে—যা ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং ইসলামী শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৫. কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা
ছয় মাসের মধ্যে সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তিকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিবন্ধনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বহু পুরোনো সম্পত্তির যথাযথ দলিল না থাকায় এতে বহু সম্পত্তি বেসরকারিভাবে হস্তান্তরের ঝুঁকিতে পড়বে।
দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া
ওয়াকফ বিলকে কেন্দ্র করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে—কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, চেন্নাই, আহমেদাবাদ প্রভৃতি শহরে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমেছে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড (AIMPLB), জমিয়তে উলামা-ই-হিন্দ, AIMIM সহ নানা সংগঠন বিলটিকে বৈষম্যমূলক ও অসাংবিধানিক হিসেবে নিন্দা জানিয়েছে।
কংগ্রেস, তৃণমূল, DMK, AAP, RJD, AIMIM প্রভৃতি বিরোধী দলও বিলের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছে। রাহুল গান্ধী বলেছেন, “এই বিল সংবিধানের উপর সরাসরি আক্রমণ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকারের চরম হরণ।” AIMIM নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি এই বিলকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং DMK সরকার রাজ্য বিধানসভায় বিল প্রত্যাহারের প্রস্তাব পাস করেছে।
সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ: আশার আলো
বিলটির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে ইতোমধ্যেই ৭৩টির বেশি আবেদন জমা পড়েছে। প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ১৬ এপ্রিল থেকে শুনানি শুরু করে এবং বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে। বিশেষ করে ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বিলুপ্তি ও অমুসলিমদের বোর্ডে নিয়োগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
১৭ এপ্রিল কোর্ট একটি আংশিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যেখানে বলা হয়:
৫ মে ২০২৫ পর্যন্ত কোনো ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ সম্পত্তিকে ডি-নোটিফাই করা যাবে না।
ওয়াকফ বোর্ড বা কাউন্সিলে অমুসলিমদের নিয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
এছাড়া কেন্দ্রকে সাত দিনের মধ্যে জবাব এবং আবেদনকারীদের পাঁচ দিনের মধ্যে পাল্টা প্রতিক্রিয়া জমা দিতে বলা হয়।
বিজেপির বক্তব্য বনাম বাস্তবতা
সরকার বলছে, এই আইন ওয়াকফ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াবে। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। সমালোচকদের মতে, এটি মুসলিমদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন হরণ এবং সম্পদ দখলের আইনগত হাতিয়ার। ‘ওয়াকফ বাই ইউজার’ বাতিলের ফলে বহু শতাব্দী পুরোনো মসজিদ, মাদ্রাসা ও কবরস্থান আইনি সুরক্ষা হারাতে পারে।
সম্ভাব্য পরিণতি: একটি অস্তিত্ব সংকট
এই বিল কার্যকর হলে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের সামনে একটি ভয়াবহ বাস্তবতা দাঁড়াবে:
লাখ লাখ ওয়াকফ সম্পত্তি সরকারের দখলে চলে যেতে পারে।
মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন হুমকির মুখে পড়বে।
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও অস্থিরতা বাড়বে।
বিরোধী নেতা মল্লিকার্জুন খড়গে যথার্থই বলেছেন, “এই বিল সংখ্যালঘু অধিকার হরণের একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।”
উপসংহার: এই লড়াই কেবল মুসলমানদের নয়
ওয়াকফ বিল ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও গণতন্ত্রের মূল কাঠামোর বিরুদ্ধে এক মারাত্মক হুমকি। এই বিল বাতিল না হলে কেবল মুসলমানদের অধিকার নয়, ভারতের বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থাও আক্রান্ত হবে। সুপ্রিম কোর্টের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ এই দুঃসময়ে আশার আলো দেখাচ্ছে।
এই লড়াই কেবল মুসলিমদের নয়—এটি ভারতের আত্মার লড়াই। ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধান রক্ষায়, সব ধর্মের মানুষকে এক হয়ে দাঁড়াতে হবে। এটাই সময়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যের, ভয়ের বিরুদ্ধে সাহসের, নীরবতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০২৫ সকাল ৮:৫২