somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নষ্ট হয়ে যাওয়া প্রাচ্যের অক্সফোর্ড

২৪ শে অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ১২:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সায়েম হন্তদন্ত হয়ে ডাইনিং এ ঢুকল। তার হাতে খাওয়ার জন্য সময় আছে মাত্র ১০ মিনিট। ১টা পর্যন্ত ক্লাস শেষে তাকে বেশ তাড়াহুড়া করেই হলে ফিরতে হয়। ২টার প্র্যাক্টিকেল ক্লাস ধরার আগে গোসল-খাওয়া এবং আরও আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করতে হয় প্রায় প্রতিদিন। এই কাজগুলো না করলে আবার ৫টা পর্যন্ত চলা ক্লাসে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না তার পক্ষে।

গোগ্রাসে খাবার গিলার ফাঁকেই হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠে। সায়েম বিরক্ত হয়ে চিন্তা করে ফোনটা ধরবে না। কিন্তু ফোনের রিংটোন বাজতেই থাকে। ৪র্থবার রিংটোন বাজার পর ফোন সে পকেট থেকে বের করে। দেখল বাঁধনের ছোটভাই রিপন ফোন দিচ্ছে বারবার। খাওয়া ততক্ষণে শেষ সায়েমের। হাত ধুতে ধুতে কথা হয় রিপনের সাথে। পিজিতে ভর্তি হওয়া এক রোগীর জন্য ইমার্জেন্সী ব্লাড দরকার। রোগীর ব্লাড গ্রুপ আর সায়েমের ব্লাড গ্রুপ মিলে যাওয়াতেই সায়েমকে তলব করা হয়েছে। দ্রুত রিপনের সাথে কথা শেষ করে নেয় সায়েম। সিদ্ধান্ত হয় বিকালে ক্লাসের শেষে সায়েম পিজিতে ব্লাড দিতে যাবে। রোগীর আত্নীয়ের কোন নির্দিষ্ট নাম্বার নাকি নেই। তাই সায়েমের নিজ থেকে যোগাযোগের কোন উপায় থাকল না।


প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। সায়েম পিজির নিচ তলায় বসে আছে বিরক্ত মুখে। তার কাছে প্রায় এক ঘণ্টা আগে একবার ফোন এসেছিলো। তারপর আর রোগীর আত্নীয়ের কোন খবর নেই। হঠাৎ সায়েমের পিছন থেকে এক পুরুষ কন্ঠ বলে উঠে,"সার, আপনের নাম কি সায়েম?" সায়েম পিছন ফিরে তাকায়। তার সামনে দাঁড়ানো ধুলিমলিন শার্ট আর আধময়লা লুঙ্গী পরিহিত লিকলিকে গড়নের এক পুরুষ। চেহারায় রোদে পোড়ার ছাপ স্পষ্ট। লোকটা তার ময়লা দাঁত বের করে একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। সে বলে উঠে, "সার, আমার ফোন নাই, তাই এই ঝামেলাডা হইল।" সায়েমের হাতে সময় নেই। সে জিজ্ঞেস করে, "ব্লাড কার লাগবে ?" লোকটার ভিতরের লুকিয়ে থাকা কষ্টটা যেন হঠাৎ এক লাফে বের হয়ে আসল। সে কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল, "সার, আমার পোলার ব্লাড লাগব সার।" সায়েম আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। সে উঠে লোকটার সাথে এগিয়ে যায় ব্লাড দেওয়ার জন্য।


ব্লাড দেওয়া শেষে সায়েম বসে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। এখান থেকে তাকে ধানমন্ডি যেতে হবে টিউশনির জন্য। জ্যাম ঠেলে ধানমন্ডি যেতে হলে তাকে কিছু শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। আজকে টিউশনিতে না যেয়ে উপায়ও নেই। টিউশনির বেতনটা নেওয়া খুব দরকার। আজকে ডাইনিং এর টাকা জমা না দিতে পারলে মিল অটোমেটিক অফ হয়ে যাবে। বাসা থেকে ১০০০ টাকা পাঠায় মাঝে মাঝে। এই মাসে পাওয়া সেই টাকা থেকে বেচে আছে ৬০০ টাকার মত। এইরকম সাতপাচ ভাবতে ভাবতে সে তার পাশে রাখা ফ্রুটিকা ম্যাংগো জুসের বোতলটার দিকে তাকায়। সায়েম ভাবতেছে জুসটা টিউশনিতে যাওয়ার পথে বাসে খেয়ে নিবে। এমন সময় তার চোখ যায় সেই ধূলিমলিন শার্ট পরিহিত লোকটির দিকে। কথায় কথায় সায়েম জানতে পেরেছে যে লোকটা রিকশা চালায় আর ঢাকা শহরেরই এক বস্তিতে থাকে। তার ছেলেটা এক্সিডেন্ট করেছে। অনেক রক্ত ঝরে গেছে তাই ব্লাড ট্রান্সমিশনের দরকার পড়েছে। কিন্তু লোকটা এখনও এখানে বসে আছে কেন !! ছেলেকে মুমূর্ষু অবস্থায় রেখে কেউ এমন নির্লিপ্তভাবে বসে থাকতে পারে !! সায়েম ধীর পায়ে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়। সায়েমের প্রশ্নের জবাবে রিকশাওয়ালা শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পাশে থেকে কে যেন বলে উঠে, "আহারে, বেচারার ব্লাড টেস্ট করার মত টাকাও নাই।" সায়েম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে লোকটা মাথা নিচু করে ফেলে। সায়েম যা বুঝার বুঝে ফেলেছে। সে মানিব্যাগ বের করে লোকটার হাতে ৫০০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দেয়। তাকে দেওয়া ফ্রুটিকাটাও সে লোকটাকে ফেরত দেয়। সায়েম একটু আগে ভালোভাবে খেয়াল করেই আন্দাজ করতে পেরেছে যে তার সামনে বসা লোকটা টাকার অভাবে ঠিকমত খেতেও পারেনি সারাদিন। যা টাকা ছিলো ছেলেটার জন্য ওষুধপত্র কিনতেই শেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ সায়েমকে অবাক করে দিয়ে রিকশাওয়ালা তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। সায়েম কোনরকমে সেই বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে দৌড়ে বের হয়ে আসে। তার চোখে জমে থাকা পানিটুকু সে কাউকে দেখাতে চায় না। হাটতে হাটতে কাটাবনে পৌছে যায় সায়েম। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তার মনে কেন জানি এক অনাবিল প্রশান্তির নহর বয়ে যায়।


উপরের ঘটনাটি শুনেছি আমি আমার এক বন্ধুর মুখ থেকে। সে আবার ঘটনাটি বলেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অমর একুশে হল বাঁধনের এক অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে তাকে নিয়মিত ব্লাড ডোনার হিসেবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিলো। (তখন পর্যন্ত সে ১৬ বারের মত রক্ত দিয়েছিলো বাঁধনের হিসাবে। হিসাবের বাইরে ধরলে তার এতদিনে ২৫ বারের বেশি ডোনেশন হয়ে যাওয়ার কথা) একুশে হল হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ছোট হলগুলার মাঝে একটি। অথচ বাঁধনের অফিসিয়াল হিসাব মোতাবেক এই হল থেকেই এ বছর অক্টোবরের আগ পর্যন্ত প্রায় ৩৫১ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। আনঅফিসিয়ালী হিসাব করলে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। অন্যান্য বড় হলের কথা বাদই দিলাম। ও হ্যা, এখানে ঘটনার বর্ণনায় চরিত্রের আসল নাম ব্যবহার করা হয়নি।


এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন আমি আমার লেখার শিরোনামটি এমন দিলাম। এর কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৈতালী বাসকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া এক দুঃখজনক ঘটনাকে পুঁজি করে কিছু মানুষের নোংরা আস্ফালন। হ্যাঁ, চৈতালী বাসে যে ঘটনা ঘটেছে তা দুঃখজনক এবং অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু এর মানে এই না যে, আপনি ঢাবিকে অবাধে গালি দেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলেন। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যতবার বড়ধরনের রাজনৈতিক আর সামাজিক পরিবর্তন এসেছে তা সবই এসেছে ঢাবির হাত ধরে। এবং এখনও দেশের রাজনৈতিক যে হালঅবস্থা, তাতে কোন বড় পরিবর্তন আসতে হলে একমাত্র শক্তিশালী প্লাটফর্ম হচ্ছে ঢাবি। এই ক্যাম্পাসেই আপনারা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ঘুরতে আসেন। প্রেমিকাকে নিয়ে ডেটিং করাটা আপনাদের অপূর্ণ থাকে অন্তত একবার টি.এস.সি না আসলে। এক একটা উৎসবে এই ক্যাম্পাসে বহুজাতিক কোম্পানীগুলো আপনাদের মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন আয়োজন কিংবা কনসার্টের পসরা সাজিয়ে বসে। আপনারা সারাদিন আনন্দ ফুর্তি করে যান আমদের ক্যাম্পাসে। আমরা তখন নিজ ক্যাম্পাসেই পরবাসী হয়ে বসে থাকি। তারপরও আমাদের আনন্দ হয়। কারণ আমরা বুঝি ঢাবি শুধু আমাদের নয়। ঢাবি এখন বাঙ্গালী জাতিতত্ত্বের আত্নার একটি অংশ। আপনারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আপনাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে এসে শহীদ মিনারে হাই ভলিউমে মাইক বাজিয়ে মিছিল-মিটিং করেন। সায়েন্স এনেক্স ভবনে বসে আমরা হাসিমুখেই এই আওয়াজের মাঝে পরীক্ষা দেই। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে বইমেলা হয়।ক্যাম্পাসের মাঝে এমন একটা প্রাণের মেলার সঙ্গী হতে পেরে আমরা ধন্য হই। ঢাকা শহরে প্রচন্ড জ্যাম। গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক করার জন্য ক্যাম্পাসের মাঝে দিয়ে গাড়ি চলে। সেই গাড়ির চাপায় আমাদেরই এক-দুইজন ভুলক্রমে মারা যায়। আমরা হঠাৎ ক্ষীপ্ত হয়ে উঠি।(এর মানে কিন্তু আমি গাড়ি ভাঙ্গাকে সাপোর্ট করছি না) তারপর আবার হাসিমুখে মেনে নেই। আমরা জানি এই রাস্তাটা সবসময় বন্ধ রাখলে ঢাকা শহর এক অর্থে অচলই হয়ে যাবে। আমরা আসলে আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ আপনাদের দেওয়া ট্যাক্সের টাকাতেই আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা হয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে আমাদেরকে দেওয়া আপনাদের মুল্যবান উপহারের প্রতিদান দেওয়ায় প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকি। আপনারা যখন বলেন ঢাবিতে কোন পড়ালেখা হয় না আমরা তখন বিনয়ের হাসি হেসে এড়িয়ে যাই। উল্লেখযোগ্য অনেক একাডেমিক সাফল্য থাকলেও আমরা চুপচাপ আমাদের কাজ করে যাই। কারণ আমরা জানি , আমরা সারাদিন খেটে গেলেও, এই গরিবদেশে আপনারা আমাদেরকে পড়ালেখার যে সুযোগটা দিয়েছেন- তার ঋণ আমরা কোনদিন শোধ করতে পারব না।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১২ রাত ১:০২
৬১টি মন্তব্য ৬১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×