কিস্তি-১
ফুটকী থেকে রাত্রি। এ বাড়িতে কেউ ওকে বৌমা বলে ডাকে না। ঠিক বিয়ের পর শাবশুড় দু’একবার মুখ ফসকে বৌমা বলে ফেলতেন। দু’একবারই শুধু। মনে পড়লে রাত্রির এখনও হাসি পায়। সঙ্গে সঙ্গে শ্বাশুড়ির সে কি দাবড়ানি। চোখে কড়া ধমক দিয়ে বলে উটেছিল, তুমি বুড়ো হতে চাও হও, আমি সেকেলে শ্বাশুড়ি হব না। একটা কমা না সেমিকোলন দিয়ে, রাত্রির মনে পড়ে, নিলয়ের মা, মানে রাত্রির শ্বাশুড়ি মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে যেতে বলেছিল, কেন রাত্রি বলে ডাকতে কি জিভে তেতো লাগে...এত সুন্দর নাম।
রাত্রি বলে বাপের বাড়িতে কেউ ডাকতো না। সেখানে ও সবার মুখে ফুটকী। বেশ বাজে নাম।স্কুলের মেয়েরা কেউ কেউ জেনে গিয়েছিল বলে প্রথম প্রথম ক্ষ্যাপাত। ডাক নামগুলোর কি সব সময় কোন ইতিহাস থাকে! বাবা-মা আদও করতে গিয়ে সেই মুখে কথা না ফোটার বয়সে কত যে ইকড়ি-মিকড়ি নাম দিয়ে বসে, সেটাই হয়ে যায় ডাক নাম। আর বেচারী বড় হওয়ার পর সেটাই হয়ে যায় অস্বস্তি। বিয়ের পর নিলয় ওদেও বাড়ি গিয়ে যেদিন জানতে পারেছিল, রাত্রির সে কি লজ্জা। ফুটকি ছিল শুধু স্কুল করেজের গন্ডির মধ্যে, ছেলেবেলাতেই তাকে রাত্রি বানিয়ে নিলে কত ভালো হত। তা হলে নামটা নিশ্চয়ই খুব আপন লাগতো। এখন লাগে না, কেমন একটা দুরত্ব আছে। বড় হওয়ার পর কি নাম বদল হয়।
ফুটকি বা রাত্রি কোনটাই অবশ্য ওর কাছে সুন্দর নাম বলে মনে হয় না। শ্বাশুড়ি যাই বলুক, ও বোধহয় মন রাখা কথা। আর ফুটকি নামটাতে ওর যতই লজ্জা তাক, বাপের বাড়িতে গেলে কেউ যখন ফুটকি বলে ডাকে কি ভালো লাগে। কত নিজের মনে হয়। ছোটবেলাতে একটু ছোটখাটো দেখতে ছিল বলে, নাকি মুখে খই ফুটতো বলে, মা একবার হাসতে হাসতে কাকে যেন বলেছিল। নিলয় জানে না, জানলে বলতো, তখন যদি এত কথা ফুটতো, এখন এত চুপচাপ কেন?
রাত্রি এখন যে একটু চুপচাপ তা অবশ্য নয়। তবে ওর মর্ডান শ্বাশুড়ির মতো অতিরিক্ত প্রগলভতা, অত্যধিক হাসি মস্করা ওর পছন্দ নয়। শ্বাশুড়ি শ্বাশুড়ির মত হলেই যেন বেশি মানায়। মীনা বলেছিল, তোর মতো শ্বাশুড়ি পেলে আমি বর্তে যেতাম। পেয়েছিস তো, তাই জানিস না তুই কি লাকি। শুনে বিষন্ন হেসেছে রাত্রি-দ্যাখ মীনা এদেও কারো বাইরেরটা মর্ডাণ, হাসিকুশি, কেউ ব্যকডেটেড, তারপরও বেতেও ভেতেও সব এক, শুনতে তো পাস।
মীনার সঙ্গে তুই তোকারিতে নেমে এসেছে এই ক’মাসেই। আরো কয়েকজনের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। কারণ অন্তরের অসন্তোষ বোধহয় সকলেরই এক। একজন শুরু করলেই ভেতরের ক্ষোভ বের করে আনে অন্যজন। শুধু জয়া যা একটু পৃথক। বেশ চাপা ধরণের। শোনে, কিন্তু পেট থেকে একটা কথাও বের করে না। হাসি হাসি মুখে এমন একটা ভাব কেও যেন বেদম খুশির জীবন। সংসােও কোন অতৃপ্তি নেই। অতচ তাকে তো জয়েন্ট ফ্যামিলিতে। জয়েন্ট ফ্যামিলি! বাপরে। শুনে রাত্রি মীনা দু’জনেই বলে উঠেছিল, হেসে ফেলেছিল। তখন খেয়াল হয়নি, ওদেও নিজেদের গুলোও তো তাই, তুলনায় একটু ছোট এই যা।
জয়া কে সেজন্যই ওরা কুব একটা পচন্দ করে না। দুঃখ এক না হলে কি এক হওয়া যায়। সর্ম্পক গড়ে উঠে? দুঃখ নেই তা হতে পারে না। তবে এত চাপা স্বভাব কিছুতেই মানতে দেবে না। কুটিয়ে খুটিয়ে জিগ্যেস করলে হ্যাঁ অথবা না। মনি, সেমাদেও তাও বোঝা যায়। ওরা দিব্যি স্বামি আর বাচ্চা নিয়ে আলাদা ফ্লাটে থাকে, শ্বশুড় শ্বাশুড়ির সাথে কোন সর্ম্পক নেই। দুপুেও চট কেও বাপের বাড়ি যাওয়া যায়। টেলিফোনে আধঘন্টা গল্প করে বলা যায় মা একটু আমের আচার করো তো, গিয়ে নিয়ে আসবো।
আসলে রাত্রিদেও একটা ক্লাব আছে। যে কেজি স্কুলটায় রাতুলকে ভর্তি করেছে তার সামনের মাঠে এই ক্লাব। অনেক মায়েরাই সকাল বেরা ছেলেকে স্কুলে পৌছে দিতে এসে বসে থাকে, গল্পগুজব করে, যাকে বলে আড্ডা। ছুটির পরও তাদের গল্প চলতে থাকে, ক্ষিধে পেটে ছেলেটার কথা মনেই থাকে না, সে তাড়া দিলে উল্টে ধমক দিয়ে ফেলে।
(চলবে…)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১০ বিকাল ৩:১২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





