চট্টগ্রামের নুপূর মার্কেটে পুরাতন বইয়ের একটি ছোটখাটো বাজার আছে । সেখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক বইয়ের পাশাপাশি সাহিত্যের ও গল্প উপন্যাস নয় এমন সাহিত্যের বইও পাওয়া যায় । সেখানে প্রায় প্রতিটি দোকানে পুরাতন বইয়ের পাশাপাশি নতুন বইও রাখে তারা । একদিন পকেট ফাঁকা থাকলেও সেইদিকে গিয়ে একটা সাঁড়াশি অভিযান চালালাম । বুকশেলফগুলোর অধিকাংশ জায়গা একাডেমিক বই ও হুমায়ূন আহমেদ, রবীন্দ্রনাথ, সুনীল , শীর্ষেন্দু , সমরেশ এবং বাংলার দুই আজাদ ( হুমায়ন আজাদ ও আরিফ আজাদ ) দখল করে থাকলেও মাঝে মাঝে সাঁড়াশি অভিযান করে আমি অনেক চটকদার বই (এই যেমন- দস্যু বনহুর) উদ্ধার করতে পারি । কখনো সখনো হয়তো আমার দাদার থেকে প্রাপ্ত আলমারিতে সেসব আশ্রয় পায় কখনও আবার পায় না , কারণটা অবশ্য আমার আর্থিক রিক্ততা !
সে যাকগে , সেদিন আমি আমার সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছিলাম । একটা শেলফের এক কোণায় দেখতে পেলাম কার্ল মার্ক্সের পুঁজি বইয়ের দুটি খণ্ড । বেশ ঝাঁ ব চকচকে এর মলাট , দেখে মনে হচ্ছে না এগুলো পুরাতন বই । দেখে লোভ লাগল বলে দোকানিকে বললাম বইদুটো দিতে । বইদুটো দোকানি শেলফ থেকে নামিয়ে আমার সামনে রাখল । মলাট উল্টে পাল্টে দেখলাম , প্রকাশকাল ২০১৬ কিংবা ২০১৭ হবে হয়তো । অনুবাদকের নাম আমার মনে নেই , প্রকাশনির নামটাও হজম করে ফেলেছি মাথায় রাখিনি । বইয়ের ভেতরে প্রথম কয়েকপাতা উল্টে দাম দেখলাম । দামটা কম নয় , ঐ টাকা দিয়ে আমার সেই সময়ের অনার্সের একাডেমিক সব বই কেনা যাবে । রেখে দিলাম বইগুলো , ছাড় দিলেও বইদুটোর দাম কমপক্ষে ১৬০০ টাকা হবে ।মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে বলে বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত না বাড়ানোর সাবধান বাণী সেই ছোট থেকেই মাথায় রেখে এসেছি । সেই সাবধান বাণীকে মাথায় রেখে বইদুটো দোকানির হাতে দিয়ে কিছু না বলে আমি বেরিয়ে এলাম ।
বইয়ের বাজার থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামবার পর কিছু চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। আমি নিজেও সমাজতান্ত্রিকতার প্রতি অনুরাগী ছিলাম সেই কিশোর বয়স থেকে । সমাজতান্ত্রিকতার সম্পর্কে জানবার জন্য সব সময় আমি চেষ্টা চালিয়ে গেছি । সেই কবে থেকেই শুনে এসেছি সমাজতান্ত্রিক মানুষরা পুঁজিবাদদের মত কেবল মুনাফা নিয়ে চিন্তা করেন না , সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য এরা চিন্তা করে থাকে । যে শ্রমিককে শোষণ করে পুঁজিরা ফুলেফেঁপেঁ উঠে সেই শ্রমিকদের স্বার্থের জন্য তারা ভাবে ও লড়াই করে । পুঁজিবাদদের সে আর্থিক অত্যাচার ও মুনাফার প্রতি পৈশাচিক যে উন্মাদনা সেই সবের বিরুদ্ধে বিপ্লব করাটাই তো সমাজতান্ত্রিকতার নামান্তর । কিন্তু সেই সমাজতান্ত্রিকতার চেহারায় যদি পুঁজিবাদের জেল্লা পাওয়া যায় সেই দৃশ্যানুভূতি কেমন হওয়া উচিত আসলে ?
মার্ক্সের পুঁজি বইটির ১৯৮৮ সালের একটি এডিশন পেয়েছিলাম এর আগে একবার , তার গায়ে দাম লিখাছিল ১০০০ টাকা । প্রকাশনি কিন্তু মস্কোপন্থি । মস্কোপন্থি প্রকাশনি বইয়ের দাম এত বেশি রাখল কেন ? এত মুনাফা দিয়ে সে কী করবে ? একটা বই ছাপাতে সে সময় ঐ টাকার ১০ ভাগের এক ভাগও খরচ হত বলে আমার মনে হয় না । যদি ধরিও যে সেই মাপের খরচ হয়েছে তবে তো এই বইয়ের ওপর মুনাফা হয়েছে ৯০০ টাকার মত শতাংশে কত হতে পারে সে নাহয় আপনারাই বুঝে নিন । তো এমন মুনাফা অর্জন তো পুঁজিবাদীদের বৈশিষ্ট্য সমাজতান্ত্রিকরা কেন এমন বৈশিষ্ট্য ধারণ করল ?
আচমকা আমার মানসপটে একটা সিদ্ধান্তের উদয় হলো , আসলে সমাজতান্ত্রিকরা পুঁজিবাদদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে তাদের সাথেই মোলাকাত করেছে কিংবা বলা যায় তাদের পোশাকই তারা পরিগ্রহণ করেছে । তাহলে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ তো এক হয়ে গেল এইদিক থেকে । একজন হয়তো সোনার থালায় খাচ্ছে আরেকজন পেতলের থালা বলে সোনার থালাতেই খাচ্ছে । পার্থক্য করা যায় কীভাবে ?
মনটা আমার বিস্বাদে ভরে গেল । এটা কী মেনে নেয়া যায় ! যে মার্ক্স একসময় পুঁজির বিরুদ্ধে লিখেগিয়েছিলেন সেই মার্ক্স এখন নিজেই পুঁজিপতি ও সমাজতান্ত্রিকদের মুনাফার পুঁজি ! আমরা যারা মধ্যবিত্ত কিংবা আমরা যারা নিম্নবিত্ত তারা তো মার্ক্সের কোন লিখাই পড়তে পারছি না । নতুন বই হোক কিংবা পুরাতন মার্ক্সের বই মানেই বিশাল অংকের মূল্য । প্রলেতারিয়েতরাই পড়তে পারছে না মার্ক্সের রচনা , কিন্তু মার্ক্স যে বুর্জোয়া সমাজের বিরোধীতা করেছিলেন সেই সমাজের পণ্য এখন তিনি নিজেই । মার্ক্স এসব দেখলে কী ব্যাখ্যা দিতেন কে জানে !!
সেদিন আমার এক নতুন বোধধয় হয়েছিল , মার্ক্স এখন আর কোন বিপ্লব নয় বরং একটি পুঁজির নাম , বুর্জোয়াদের পুঁজি । আর আমাদের ঘিরে আছে যে অনিয়মের অন্ধকার সেই অন্ধকারে যেকোন আলো জ্বলে উঠুক না কেন একসময় অন্ধকার সেই আলোকে শুষে নেবে আর বাড়িয়ে নেবে নিজের আঁধারের ঘনত্ব । শেষমেশ সবকিছুর আঁধারেতেই অবসান হবে আর আলো হলো এই আঁধারে মিথ্যে আশা নিয়ে বেঁচে থাকবার নামান্তর !!
হে মার্ক্স এসে দেখে যাও তুমি তোমার কথা এখন কাদের পুঁজি , মাজদাকের আত্মা বহন করে যে রচনা তুমি রচেছিলে সেটা এখন একেবারেই ভেস্তে গেছে কারণ তুমি এখন বুর্জোয়াদের শো-পিচ !!
রচনাকারী: নিবর্হণ নির্ঘোষ ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১১:০৩