পৃথিবীতে যেক’টি পেশা বেশ সম্মানজনক ও বেশ চাহিদা সম্পন্ন তার মধ্যে একটি হলো সিএ বা চার্টার্ড একাউন্টেন্ট পেশাটি । বাংলাদেশেও এর চাহিদা ও সম্মান কম নয় । বাংলাদেশের মত একটি ছোট দেশে এই পেশার প্রয়োজনীয়তাও নেহাত কম নয় । কিন্তু এই পেশার জন্য যে পড়াশোনা মানে সিএ পড়াশোনা করাটা কিন্তু সব শিক্ষার্থীর জন্য প্রতিকুল নয় । সিএ পড়া অবস্থায় , বিশেষ করে আর্টিকেলশিপ করা অবস্থায় কেউ কোন চাকরি করতে পারবে না , আর সেটা সম্ভবও হয় না । ফলে আর্থিক সমস্যা লেগেই থাকে । মধ্যবিত্ত সংসারের শিক্ষার্থীরা সিএ করতে পারেই না বললেই চলে । কারণ , এমন সময়ে এসে সিএটা করতে হয় যখন না পরিবার ভার নিতে পারে আর না সিএ করতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থী নিজের ভার বহন করতে পারে । ফলত , অনেকের ইচ্ছা থাকলেও তারা সিএ করতে পারে না বা পড়তে পারে না ।
শিক্ষার্থীর সামর্থ্য ছাড়াও আরও কিছু বিষয় আছে যেগুলো সিএ পড়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে থাকে । এইসব বিষয় সিএ পড়াটাকে একদম প্রতিকুল করে তোলে সমস্ত শিক্ষার্থীদের কাছে । সেগুলো নিয়েই আজকের লিখা । তো সেইসব বিষয়গুলো হল :
সিএ আর্টিকেলশিপ অ্যালাউন্সে বৈষম্য
সিএ-তে আর্টিকেলশিপের অ্যালাউন্সের ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা যায় । স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা কোন ছাত্র যদি সিএ পড়তে আসে তবে তার অ্যালাউন্স হবে ১০ হাজারের উপরে । আবার এদিকে যদি ছাত্রটি হয় সাধারণ কোন কলেজ থেকে পাশ করা তবে তার অ্যালাউন্স হবে ৩ হাজার থেকে একটু বেশি যা দিয়ে একটি ছাত্রের নিজের ব্যয় বহন করা অসম্ভব । এই যে ফারাক তার কারণ ফার্মের ম্যানেজার বলে থাকেন যে স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রদের একাউন্টিং সম্পর্কিত জ্ঞান বেশি থাকে , এদের যোগাযোগের দক্ষতা থাকে বেশি , এরা কথায় ও কাজে বেশ পটু হয় , এদের কাজ করবার ক্ষমতাও বেশি চাপ নেবার ক্ষমতাও বেশি ইত্যাদি । বলা বাহুল্য তাদের প্রায় সব কটা অজুহাত একদম সব দিক থেক সত্য নয় , বলা যায় অনেক দিক থেকে তাদের কথাতে সন্দেহের কোন কমতি থাকে না ।
ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাউন্টিংয়ের জ্ঞান বেশি থাকে এটা সব সময় সত্য নয় । সাধারণভাবে দেখলে এইসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই সাধারণ জাবেদা ও সেই জাবেদার যুক্তি সম্পর্কে কিছুই বলতে পারবে না । এছাড়াও তাদের মধ্যে যদি একাউন্টিং বুঝবার এত বেশি ক্ষমতা থাকে তবে তো তাদের আর্টিকেলশিপ করবার প্রয়োজনই পড়ে না ।
তাদের যোগাযোগ দক্ষতা বেশি বলে যে অজুহাত দেয়া হয় তাও বোগাস একটা কথা । স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোগাযোগ তো দূরে থাক ঠিকভাবে কথা বলবার কোন দীক্ষার লেশমাত্রও তাঁদের মধ্যে পাওয়া যায় না । তাছাড়া একজন ব্যক্তি তার কাজের জন্য যতটুকু যোগাযোগ করবার প্রয়োজন তা সে শিখে নেয় নিজ দায়িত্বে আর তা তার শেখা থাকলে সে তো সরাসরি চাকরির বাজারে প্রবেশ করতেই পারে আর্টিকেলশিপের প্রয়োজন কী ? তাছাড়া সিএ-তে তো পণ্য বিক্রির কোন বালাই নেই সেখানে আসলে কেমন যোগাযোগের দক্ষতা প্রয়োজন ? সেটা কী অফিস কেন্দ্রিক যোগাযোগের বাইরে কিছু ? আর সেই যোগাযোগের বিষয়ে কী কেবল স্বনামধন্য ভার্সিটিতেই পড়ানো হয় ? তাদের এই যোগযোগ দক্ষতা যে কী তা নিয়ে রহস্য রয়েই যায় ।
আরেকটি কথা হলো কেবল তাদেরই কাজ করবার দক্ষতা ও ক্ষমতা বেশি তার কী কোন প্রমাণ আছে নাকি এর কোন যথার্থতা আছে । আর সাধারণ কলেজ থেকে পাশ করা ছাত্ররা যদি কাজ করতে নাইবা পারে তো তাঁদের কেন ফার্মে নেয়া হয় ? শুধু শুধু এমন অগণিত অদক্ষ কর্মী গঠন করবার কারণ কী ? এছাড়াও স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীগণ যদি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কারিগরি দক্ষতা নিয়ে বের হয় তো তারা সরাসরি কেন চাকরিতে অবদান রাখছে না ? তাঁদের আর নতুন করে প্রশিক্ষিত করবার কী দরকার আছে ?
সিএ পড়াশুনাতে বিদ্যমান এই অ্যালাউন্স কেন্দ্রিক বৈষম্যের কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না । প্রায় সব কটা ফার্ম পরীক্ষা নিয়ে আর্টিকেলশিপ স্টুডেন্টদের নিয়োগ দেন , তো তখন তারা কেন তাদের যোগ্য আর্টিকেলশিপ স্টুডেন্ট বেছে নেয় না ? একটা রহস্য থেকে যায় এদিক থেকে ।
সিএ ফার্মগুলোর অত্যাচার
সিএ ফার্মের কাজের চাপ সবচেয়ে বেশি । একজন আর্টিকেলশিপ স্টুডেন্টকে অনেক ক্ষেত্রে প্রায় রাত্রি ৯ টা বা তারও বেশি সময় ধরে কাজে থাকতে হয় । এত সময় ধরে কাজে থাকার কারণে একজন শিক্ষার্থী লাইব্রেরীতে যেতে পারে না , ক্লাস করতে পারে না এবং বাসায় পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে না । ফলে বেচারা পরীক্ষা ও সিএ-র পড়াশোনার চাইতে আর্টিকেলশিপের প্রতি বেশি নজর দেয় । এতে করে সে পরিপূর্ণ সিএ হতে পারে না আর হলেও সময় লাগে অনেক বেশি । ফার্মে কাজের পরিমাণ বেশি রাখার ক্ষেত্রে ফার্মের মানুষেরা বলে থাকেন , “ কাজের চাপ নিয়ে পড়াশোনা যদি করতে না পারে তবে তো এই পড়াশোনাতে না আসাই উচিত ।”
সে ঠিক আছে কিন্তু কাজের চাপ বেশি হলে একজন ছাত্র পড়াশোনা করবে কী করে ? ফার্মে তো সে চাকরি করছে না বরং প্রশিক্ষণরত অবস্থায় আছে , এবং ফার্ম যে সিএ-র মূল প্রতিষ্ঠান আইসিএবি-র সাথে সরাসরি সম্পর্কিত ও দায়বদ্ধ নয় তাও নয় । তবে এত বেশি কাজের চাপ তাকে কেন দিতে হবে যখন সে তার পড়াশোনা করবার সময় পাবে না এবং তার সিএ পড়বার যে উদ্দেশ্য তা থেকেও রীতিমত ছিটকে পড়ে ? একে তো অ্যালাউন্স কম তার ওপর শিক্ষানবিশ কোন শিক্ষার্থীকে অমানুষিকভাবে খাটানো , এটা তো শিক্ষানবিশের ওপর চাপানো একটি অত্যাচার বাদে আর কিছু নয় ! সিএ ফার্মের মানুষেরা যেসব কথা বলে বেড়ান তা আসলে নিজেদের অসঙ্গতি ঢাকবার একটি অজুহাতমাত্র । এটা কোন সমাধান নয় ! মানুষকে তার সাধ্যের অতীত কাজ চাপানো ও করাটা কোন গর্বের বিষয় নয় !!
দেখা যায় ফার্মের কাছে একজন শিক্ষার্থীর পড়াশোনা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই । তাদের মাথাব্যথা তাদের কাজ হাসিল নিয়ে , মূলত আর্টিকেলশিপ স্টুডেন্টরা হলো ফার্মের কম খরচের শ্রমিক যাদের কাজে লাগিয়ে ফার্ম কম ব্যয়ে নিজেদের কাজ চালাতে পারে ।
এছাড়াও, একজন শিক্ষানবিশ আইনমতে একটি ফার্ম থেকে ৪৫ দিন ছুটি পাবে পরীক্ষার আগে । কিন্তু সেই জায়গায় ছুটি পায় ২০ দিনেরও কম ।
আবার একজন শিক্ষানবিশকে অণেক বেশি মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হয় যদি না শিক্ষানবিশের সাথে ফার্মের উপরস্থদের একটা সুসম্পর্ক তৈরী না হয় তো । এদের মানসিক অত্যাচার সম্পর্কে যেকোন শিক্ষানবিশদের কাছে জানতে চাইলে কখনওই ইতিবাচক কোন জবাব পাওয়া যায় না । অনেকেই ফার্মের মানুষদের মানসিক অত্যাচার সহ্য করে একটি স্বপ্নের জন্য কিন্তু সেই সহ্যের ফল সব সময় মধুর হয় না । কারণ অতিরিক্ত মানসিক চাপ তাকে পঙ্গু করে দেয় , আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয় , তার দক্ষতাও কমিয়ে দেয় । ফলে সে নিজেই বিচ্যুত হয়ে পড়ে তার লক্ষ্য থেকে ।
ফার্মের কাছে শিক্ষানবিশরা হলো দাসের সমতূল্য তবে তাদের এই মনোভাব লুকিয়ে রাখবার অজুহাত হলো এটি , “ কাজের চাপ নিয়ে পড়াশোনা যদি করতে না পারে তবে তো এই পড়াশোনাতে না আসাই উচিত ।” এটাকে হুমকি ও তাচ্ছিল্য এবং স্পষ্ট গুণ্ডামি বাদে আর কী বলা যেতে পারে ?
সিএ সিসি পাশ শিক্ষার্থীদের চাকরিতে অসুবিধা
সিএ কারিকুলামের সব সাবজেক্ট পাশ করতে না পারলেও তিনবছর আর্টিকেলশিপ করবার পর একটা সার্টিফিকেট দেয়া হয় একে বলে কোর্স কমপ্লিট সার্টিফিকেট । আর এই সার্টিফিকেটধারীকে সংক্ষেপে বলে সিসি । এই সিসিগণ কিন্তু সিএ নন । কারণ সিএ হতে হলে সম্পূর্ণ ১৭টি সাবজেক্ট পাশ করতে হবে । তো এই সিসিদের ক্ষেত্রে বলা হয় চাকরির বাজারে এদের চাহিদা প্রচুর । এদের বেতনের হারও অনেক । কিন্তু তাই কী ?
একজন সিসি কখনই একজন সিএর মত কাজ করতে পারবেন না । সিএ যেমন অডিট করে থাকেন সেভাবে তিনি অডিট করতে পারবেন না , কারণ অডিট করবার লাইসেন্স তার নেই । ট্যাক্সের কাজ করতে পারেন বটে তবে সেটা সব সিসি করতে পারেন না কারণ ফার্ম সবাইকে ট্যাক্সের কাজে অংশগ্রহণ করাতে চায় না সেটা সম্ভবও হয় না । তো একজন সিসিকে আপনি কী বলে গণ্য করবেন ? তাকে সর্বোচ্চ একাউন্ট এগজেকিউটিভ বলতে পারবেন । কিন্তু বাস্তবে এদের কাজ সর্বোচ্চ একজন বুক কিপার হিসেবেই সীমাবদ্ধ ।
কিন্তু আজকাল বুক কিপারের কাজ কুইকবুকস , জেরো , টালি ইআরপির কারণে একজন সাধারণ গ্র্যাজুয়েট পাশকৃত ছাত্রের দ্বারাও সম্ভব হচ্ছে । ফলে সিসির চাহিদা অনেকটাই কমে যাচ্ছে । একজন গ্র্যাজুয়েটপাশ ছাত্রকে যখন বুককিপার হিসেবে নিয়োগ দেয়া যায় কম বেতনে সেখানে বেশি বেতনে সিসি পাশকে কেন রাখবে ? তাই বেতনের হার কমে যায় সিসিদের । তিন বছরের সকল পরিশ্রম আর মানসিক অত্যাচার শেষে না সে তার সিএ হবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারছে না সে তার মানানুযায়ী চাকরিতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে , সে রীতিমত ব্রাত্যই থেকে যাচ্ছে ।
এছাড়াও আইসিএবির কর্তৃক প্রণীত পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থা ও পাশ মার্ক নির্ধারিত না থাকবার ফলে শিক্ষার্থীরা এক প্রকার অনিশ্চয়তা নিয়ে পরীক্ষা দেয় । তাই পাশ করার পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়াটা একজন শিক্ষার্থীর জন্য একদম অসম্ভব হয়ে পড়ে ।
পরিশিষ্ট
একটি সম্ভাবনাময় পেশাক্ষেত্র ও বেশ জরুরি পেশা ক্ষেত্র হবার পরও এই পেশাতে শিক্ষার্থীদের যাবার অনীহা তৈরী হচ্ছে দিনকে দিন । এবং এই অনীহা বেড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । এমনিতেই এইদেশে স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত পাশ করা সিএ-র সংখ্যা ২০০০ এর মত । যার অধিকাংশ আবার বিদেশে অথবা মৃত । তো ভবিষ্যতে কী এই দেশের একাউন্টিং খাত হুমকির মুখে পড়ছে না ? এই প্রশ্নের জবাব কার কাছ থেকে পাওয়া যাবে সমাধানই বা করবে কে ?
রচনাকারী:নিবর্হণ নির্ঘোষ
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ৮:৩৬