সময়টা ২০১০ সালের ,
সবেমাত্র ক্লাস সেভেনে উঠেছি । শহরতলীর এক গলিতে কোনমতে মাথা তুলে দাঁড়ানো এক দালানের নীচ তলার অন্ধকার ফ্ল্যাটে বাস গেড়েছে আমার পরিবার । সেই সময় ঐ এলাকায় আশেপাশের ফোনফ্যাক্সের দোকানগুলোতে প্রচুর মেটাল সঙ্গীত চলতো । ওয়ারফেইজ , অর্থহীন , ক্রিপটিক ফেইট , আর্টসেল , ভাইব , স্কেয়ারক্রো , ডিইলুমিনেশন, স্টেনটোরিয়ান এমন আরও অনেক ব্যান্ডের গানে গম গম করতো পুরো এলাকা । শীতের সময় এইসব ব্যান্ডের গানগুলোতে অনেক মাদকতা থাকতো । মাঝে সাঝে কাপড় শুকোতে দিতে আমাকেই ছাদে উঠতে হত আর সেখানে গেলেই কাছের পাহাড়গুলোকে দেখতে পেতাম । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম প্লাইস্টোসিন যুগের পাহাড়গুলোর দিকে আর মাথায় ঘুরতো ওয়্যারফেইজের সেই বিখ্যাত গান , “ বসে আছি একা কাঁচা বিকেলে উদাস , বৃষ্টি শেষে রূপালি আকাশ ! ” সেই কিশোর বয়সে যে ভাবুকতা আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল তা অনেক ছোট্টবেলার স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত কিন্তু সেই ভাবুকতা যে আমার প্রেমিকা হয়ে আমাকেই নারকীয় স্বর্গের স্বাদ দেবে তা কে জানতো ?
বাসার পাশে এক বড় ভাইয়ের দোকান ছিল সেখানে বসে তিনি ক্রাউন স্পেশাল মডেলের একটা অ্যাকুস্টিক গিটার বাজাতো । আমি ঐ গিটারের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম । স্কুল থেকে ফিরতে কিংবা স্কুলে যাবার সময় আমার প্রথম কাজ ছিল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কান পেতে অ্যাকুস্টিক গিটারের ঝংকার শোনা । মনে পড়ে দুপুরে যখন উনি একলা মনে গিটার বাজাতেন সেই ঝিম ধরা দুপুরে তার গিটারের সুরকে নৈস্বর্গিক মনে হত । সেই সময় ভাবতাম একদিন এই বড় ভাইয়ের মত বয়স হলে আমিও গিটার নিয়ে এমন উদাস ঝিম ধরা দুপুর পাড় করবো !
একদম ছোট থেকেই আমার গিটারের প্রতি একটা মোহ ছিল । তবে সেটা মেটাতাম খেলনার গিটার দিয়ে । বাবার সাধ্য ছিল না বলে মা আর আমার সাধ মেটাতে যাননি সেই ছোট্টবেলায় । আমি ভাবতাম বড় হলে আমি একদিন গিটারকে লুফে নেবই নেব তবে সেটা ঠিক কতটা বড় হলে তা আমি জানতাম না ।
ক্লাস এইটে উঠলাম, সেই সময় জে এস সি পরীক্ষার ভীষণ রমরমা অবস্থা । এই পরীক্ষা নিয়ে স্কুল আর মিডিয়ার জল্পনা কল্পনার শেষ নেই । সেই সময়ে মা বললেন জে এস সিতে ভালো রেজাল্ট করলে গিটার কিনে দেবেন । আর পায় কে আমারে !! এই গিটারের স্বপ্নে কত রাত যে পাড় করেছি তার ইয়ত্তা নেই । প্রতিদিন পড়তে বসলে আমার মনে হত এই যে কষ্ট করছি একদিন এর ফল পাবোই পাবো । কিন্তু পেলাম না । আমার স্বপ্নগুলো ভেস্তে যেতে বেশি সময় নিলো না ।
পরীক্ষা শেষ হলো রেজাল্ট পেলাম , ভালোই পাশ করলাম । এবার আমার গিটার হাতে পাবার পালা । কিন্তু সেই বড় ভাইয়ের কাছে গিটারের দাম জেনে আমার আর গিটার পাওয়া হলো না । সেই সময়েই একটা গিটারের যা দাম ছিল তা আমার বাবার মাইনের চাইতেও বেশি । একটা স্বপ্নের প্রথম মৃত্যু যে কত কষ্টকর সেটা সেইদিন বুঝেছিলাম । সেই রাত থেকে প্রতিটা দিন আমার খুব কষ্টে গিয়েছিল । এতটাই কষ্টে যে এখন ভাবলে ভয় হয় কী করে আমি এমনটা সময় পাড় করেছি ? ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসে আমার ।
এদিকে ক্লাস নাইনে উঠলাম , আম্মা ঘোষণা করে দিলেন বিজ্ঞান নিয়ে আমি পড়াশোনা করতে পারবো না । আরেকটা ধ্বস নামল মাথায় , এ যেন একের পর এক স্বপ্ন ভাঙার যাত্রা চলছিল । সেই সময় থেকেই ইচ্ছে ছিল আমি হয় মনোবিজ্ঞানী হব নয়তো অপরাধবিজ্ঞানী কিন্তু আম্মার এসবে কোন মত ছিল না । তার যে পেশায় আমাকে দেখবার ইচ্ছে ছিল আমার সেই পেশায় যাবার ও সেই নিয়ে পড়বার কোন বাসনা ছিল না তবুও আম্মার কথার বাইরে যাওয়া আমার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব ছিল বলা চলে । আম্মাকে অনেক জোড়াজুড়ি করলাম তারপরও আম্মা তো মানবার পাত্রী নন শেষমেশ মেনেই নিলাম , তবে যে ইচ্ছের কারণে আমার আম্মা আমাকে বিজ্ঞান পড়তে দেননি তা অর্জিত হয়নি একদম । এবং এটাও আমার আরেকটি স্বপ্নভঙ্গের তাড়না ! মায়ের সেই ইচ্ছা আমার পুরো অনার্স জুড়ে স্বপ্ন হিসেবেই ছিল আমিই স্বপ্ন করে নিয়েছিলাম, সেটাও পূরণ হয়নি সম্ভবত এভাবেই একেরপর এক স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে আজীবন , তাই ভয়ে এখন আর স্বপ্ন দেখি না কিন্তু স্বপ্ন চিরপ্রেমিকার মত পিছু ছাড়ে কই!
সে যাক , পড়তে পড়তে এক সময় এস এস সি পরীক্ষা দিলাম । রেজাল্ট দেবার কিছুদিন আগে ঘোষণা করলেন আমার আম্মা আমাকে গিটার কিনে দেবেন । আমি অবাক হয়ে গেলাম । আম্মা খুব সযতনে মনের মধ্যে এই বাসনা রেখেছিলেন যে আমাকে একদিন তিনি গিটার কিনে দেবেন । অথচ এই আমার আম্মাই আমার গিটার ও গানের মোহ নিয়ে কত কথাই না শোনাতেন । কত বকা খেয়েছি তার হিসেব রাখলে মনে হয় ১২ হাত লম্বা শাড়ির মত শ’খানেক ব্যালেন্স শিট তৈরী করা যাবে ।
আম্মা আমাকে গিটার কিনে দিলেন ঠিক রেজাল্ট দেবার দুইদিন আগে ।মনে আছে আমার সেদিনটার কথা । আন্দরকিল্লার নাথ নামের একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান থেকে আম্মা আমাকে কিনে দিয়েছিলেন গিটারটা । আমি যখন গিটার দেখতে ব্যস্ত শুনতে পেলাম আম্মা দোকানিকে বলছেন , “ মাউথ অর্গান আছে ?” চমকে উঠলাম আমি যিনি কিনা গিটার কিনতেই গড়িমসি করেছেন এতদিন সেই তিনি কিনা এখন গিটার আর হারমোনিকা কিনে দিচ্ছেন এক সাথে ? অবাক হবার যেন শেষ নেই ।
শেষমেশ গিটার হাতে পেলাম । আম্মা গিটার কিনে দিয়ে জারি করলেন নিজে নিজে শেখো কোথাও শিখতে যেতে পারবে না । সেই থেকে যা শিখেছি নিজে নিজেই । আমার কোন ট্রেইনার ছিল না কোনদিন । তবুও ভালো আমি তো আমার প্রেমিকাকে পেয়েছি । যার বিরহ আমাকে কত রাত স্বপ্ন থেকে বাস্তবে তাড়া করেছিল , আর দম বন্ধ করে কাটিয়েছি কতগুলো সময় ।
এখন আমি ভাবি একটা স্বপ্ন পূরণ হতে কতরাতের অস্বস্তি আর দুঃখ সহ্য করতে হয় ? কতটা আশা পুষে রাখলে একদিন কাঙ্খিত বস্তুকে পাওয়া যায় ? আমি এর উত্তর সঠিকভাবে পাইনি , কারণ আমার অনেক স্বপ্ন এখনও অপ্রাপ্তিব্য হয়ে রয়েই গেছে ।হয়তো সেসবের কোন সম্ভাবনা নেই হয়তো সেসব আমার মৃত্যুর মতই অতল আঁধারের মত কিছু , আমি নৈরাশ্যবাদী মানুষ । জীবনের সব কিছুকে হতাশার কেন্দ্র বলে মনে হয় !
তবুও বাঁচি , কেন ? কারণ আমি নিজের ইচ্ছেতে জন্মিনি বলে ।
এরপর থেকে আমি অগণিত সময় পাড় করেছি আমার গিটারকে নিয়ে । কত বিষন্ন দুপুর আমার , কত অস্বস্তির সময় , কত নগ্ন বিষাদ আমার কেটে গেছে আমার ফেন্ডার ক্রাউন স্পেশাল গিটারকে আকঁড়ে ধরে । আমার গিটারের সুর অত ভালো উঠে না তবুও বলব আমার প্রেমিকা সে , প্রেমিকা পুরো পৃথিবীর কাছে সুন্দর না হলেও প্রেমিকের কী তাতে কিছু যায় আসে ? প্রেমিকের চোখেই তো তার সর্বমূল্যায়ন ! তাই না ?
রচনাকারী: নিবর্হণ নির্ঘোষ ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০২৩ রাত ১১:৪০