somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

নিবর্হণ নির্ঘোষ
আমি এক প্রব্রজ্যা , আয়ু ভ্রমণ শেষে আমাকে পরম সত্যের কাছে ভ্রমণবৃত্তান্ত পেশ করতেই হবে । তাই এই দুর্দশায় পর্যদুস্ত পৃথিবীতে আমি ভ্রমণ করি আমার অহম দিয়ে । পরম সত্যের সৃষ্টি আমি , আমি তাই পরম সত্যের সৃষ্ট সত্য !!

কিশোরবেলার স্মৃতিচারণ : আমার গিটার

২০ শে মে, ২০২৩ রাত ৮:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





সময়টা ২০১০ সালের ,

সবেমাত্র ক্লাস সেভেনে উঠেছি । শহরতলীর এক গলিতে কোনমতে মাথা তুলে দাঁড়ানো এক দালানের নীচ তলার অন্ধকার ফ্ল্যাটে বাস গেড়েছে আমার পরিবার । সেই সময় ঐ এলাকায় আশেপাশের ফোনফ্যাক্সের দোকানগুলোতে প্রচুর মেটাল সঙ্গীত চলতো । ওয়ারফেইজ , অর্থহীন , ক্রিপটিক ফেইট , আর্টসেল , ভাইব , স্কেয়ারক্রো , ডিইলুমিনেশন, স্টেনটোরিয়ান এমন আরও অনেক ব্যান্ডের গানে গম গম করতো পুরো এলাকা । শীতের সময় এইসব ব্যান্ডের গানগুলোতে অনেক মাদকতা থাকতো । মাঝে সাঝে কাপড় শুকোতে দিতে আমাকেই ছাদে উঠতে হত আর সেখানে গেলেই কাছের পাহাড়গুলোকে দেখতে পেতাম । এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম প্লাইস্টোসিন যুগের পাহাড়গুলোর দিকে আর মাথায় ঘুরতো ওয়্যারফেইজের সেই বিখ্যাত গান , “ বসে আছি একা কাঁচা বিকেলে উদাস , বৃষ্টি শেষে রূপালি আকাশ ! ” সেই কিশোর বয়সে যে ভাবুকতা আমাকে আঁকড়ে ধরেছিল তা অনেক ছোট্টবেলার স্মৃতির সাথে সম্পর্কিত কিন্তু সেই ভাবুকতা যে আমার প্রেমিকা হয়ে আমাকেই নারকীয় স্বর্গের স্বাদ দেবে তা কে জানতো ?


বাসার পাশে এক বড় ভাইয়ের দোকান ছিল সেখানে বসে তিনি ক্রাউন স্পেশাল মডেলের একটা অ্যাকুস্টিক গিটার বাজাতো । আমি ঐ গিটারের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম । স্কুল থেকে ফিরতে কিংবা স্কুলে যাবার সময় আমার প্রথম কাজ ছিল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কান পেতে অ্যাকুস্টিক গিটারের ঝংকার শোনা । মনে পড়ে দুপুরে যখন উনি একলা মনে গিটার বাজাতেন সেই ঝিম ধরা দুপুরে তার গিটারের সুরকে নৈস্বর্গিক মনে হত । সেই সময় ভাবতাম একদিন এই বড় ভাইয়ের মত বয়স হলে আমিও গিটার নিয়ে এমন উদাস ঝিম ধরা দুপুর পাড় করবো !


একদম ছোট থেকেই আমার গিটারের প্রতি একটা মোহ ছিল । তবে সেটা মেটাতাম খেলনার গিটার দিয়ে । বাবার সাধ্য ছিল না বলে মা আর আমার সাধ মেটাতে যাননি সেই ছোট্টবেলায় । আমি ভাবতাম বড় হলে আমি একদিন গিটারকে লুফে নেবই নেব তবে সেটা ঠিক কতটা বড় হলে তা আমি জানতাম না ।



ক্লাস এইটে উঠলাম, সেই সময় জে এস সি পরীক্ষার ভীষণ রমরমা অবস্থা । এই পরীক্ষা নিয়ে স্কুল আর মিডিয়ার জল্পনা কল্পনার শেষ নেই । সেই সময়ে মা বললেন জে এস সিতে ভালো রেজাল্ট করলে গিটার কিনে দেবেন । আর পায় কে আমারে !! এই গিটারের স্বপ্নে কত রাত যে পাড় করেছি তার ইয়ত্তা নেই । প্রতিদিন পড়তে বসলে আমার মনে হত এই যে কষ্ট করছি একদিন এর ফল পাবোই পাবো । কিন্তু পেলাম না । আমার স্বপ্নগুলো ভেস্তে যেতে বেশি সময় নিলো না ।

পরীক্ষা শেষ হলো রেজাল্ট পেলাম , ভালোই পাশ করলাম । এবার আমার গিটার হাতে পাবার পালা । কিন্তু সেই বড় ভাইয়ের কাছে গিটারের দাম জেনে আমার আর গিটার পাওয়া হলো না । সেই সময়েই একটা গিটারের যা দাম ছিল তা আমার বাবার মাইনের চাইতেও বেশি । একটা স্বপ্নের প্রথম মৃত্যু যে কত কষ্টকর সেটা সেইদিন বুঝেছিলাম । সেই রাত থেকে প্রতিটা দিন আমার খুব কষ্টে গিয়েছিল । এতটাই কষ্টে যে এখন ভাবলে ভয় হয় কী করে আমি এমনটা সময় পাড় করেছি ? ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসে আমার ।



এদিকে ক্লাস নাইনে উঠলাম , আম্মা ঘোষণা করে দিলেন বিজ্ঞান নিয়ে আমি পড়াশোনা করতে পারবো না । আরেকটা ধ্বস নামল মাথায় , এ যেন একের পর এক স্বপ্ন ভাঙার যাত্রা চলছিল । সেই সময় থেকেই ইচ্ছে ছিল আমি হয় মনোবিজ্ঞানী হব নয়তো অপরাধবিজ্ঞানী কিন্তু আম্মার এসবে কোন মত ছিল না । তার যে পেশায় আমাকে দেখবার ইচ্ছে ছিল আমার সেই পেশায় যাবার ও সেই নিয়ে পড়বার কোন বাসনা ছিল না তবুও আম্মার কথার বাইরে যাওয়া আমার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব ছিল বলা চলে । আম্মাকে অনেক জোড়াজুড়ি করলাম তারপরও আম্মা তো মানবার পাত্রী নন শেষমেশ মেনেই নিলাম , তবে যে ইচ্ছের কারণে আমার আম্মা আমাকে বিজ্ঞান পড়তে দেননি তা অর্জিত হয়নি একদম । এবং এটাও আমার আরেকটি স্বপ্নভঙ্গের তাড়না ! মায়ের সেই ইচ্ছা আমার পুরো অনার্স জুড়ে স্বপ্ন হিসেবেই ছিল আমিই স্বপ্ন করে নিয়েছিলাম, সেটাও পূরণ হয়নি সম্ভবত এভাবেই একেরপর এক স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে আজীবন , তাই ভয়ে এখন আর স্বপ্ন দেখি না কিন্তু স্বপ্ন চিরপ্রেমিকার মত পিছু ছাড়ে কই!


সে যাক , পড়তে পড়তে এক সময় এস এস সি পরীক্ষা দিলাম । রেজাল্ট দেবার কিছুদিন আগে ঘোষণা করলেন আমার আম্মা আমাকে গিটার কিনে দেবেন । আমি অবাক হয়ে গেলাম । আম্মা খুব সযতনে মনের মধ্যে এই বাসনা রেখেছিলেন যে আমাকে একদিন তিনি গিটার কিনে দেবেন । অথচ এই আমার আম্মাই আমার গিটার ও গানের মোহ নিয়ে কত কথাই না শোনাতেন । কত বকা খেয়েছি তার হিসেব রাখলে মনে হয় ১২ হাত লম্বা শাড়ির মত শ’খানেক ব্যালেন্স শিট তৈরী করা যাবে ।

আম্মা আমাকে গিটার কিনে দিলেন ঠিক রেজাল্ট দেবার দুইদিন আগে ।মনে আছে আমার সেদিনটার কথা । আন্দরকিল্লার নাথ নামের একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান থেকে আম্মা আমাকে কিনে দিয়েছিলেন গিটারটা । আমি যখন গিটার দেখতে ব্যস্ত শুনতে পেলাম আম্মা দোকানিকে বলছেন , “ মাউথ অর্গান আছে ?” চমকে উঠলাম আমি যিনি কিনা গিটার কিনতেই গড়িমসি করেছেন এতদিন সেই তিনি কিনা এখন গিটার আর হারমোনিকা কিনে দিচ্ছেন এক সাথে ? অবাক হবার যেন শেষ নেই ।



শেষমেশ গিটার হাতে পেলাম । আম্মা গিটার কিনে দিয়ে জারি করলেন নিজে নিজে শেখো কোথাও শিখতে যেতে পারবে না । সেই থেকে যা শিখেছি নিজে নিজেই । আমার কোন ট্রেইনার ছিল না কোনদিন । তবুও ভালো আমি তো আমার প্রেমিকাকে পেয়েছি । যার বিরহ আমাকে কত রাত স্বপ্ন থেকে বাস্তবে তাড়া করেছিল , আর দম বন্ধ করে কাটিয়েছি কতগুলো সময় ।


এখন আমি ভাবি একটা স্বপ্ন পূরণ হতে কতরাতের অস্বস্তি আর দুঃখ সহ্য করতে হয় ? কতটা আশা পুষে রাখলে একদিন কাঙ্খিত বস্তুকে পাওয়া যায় ? আমি এর উত্তর সঠিকভাবে পাইনি , কারণ আমার অনেক স্বপ্ন এখনও অপ্রাপ্তিব্য হয়ে রয়েই গেছে ।হয়তো সেসবের কোন সম্ভাবনা নেই হয়তো সেসব আমার মৃত্যুর মতই অতল আঁধারের মত কিছু , আমি নৈরাশ্যবাদী মানুষ । জীবনের সব কিছুকে হতাশার কেন্দ্র বলে মনে হয় !


তবুও বাঁচি , কেন ? কারণ আমি নিজের ইচ্ছেতে জন্মিনি বলে ।


এরপর থেকে আমি অগণিত সময় পাড় করেছি আমার গিটারকে নিয়ে । কত বিষন্ন দুপুর আমার , কত অস্বস্তির সময় , কত নগ্ন বিষাদ আমার কেটে গেছে আমার ফেন্ডার ক্রাউন স্পেশাল গিটারকে আকঁড়ে ধরে । আমার গিটারের সুর অত ভালো উঠে না তবুও বলব আমার প্রেমিকা সে , প্রেমিকা পুরো পৃথিবীর কাছে সুন্দর না হলেও প্রেমিকের কী তাতে কিছু যায় আসে ? প্রেমিকের চোখেই তো তার সর্বমূল্যায়ন ! তাই না ?


রচনাকারী: নিবর্হণ নির্ঘোষ ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০২৩ রাত ১১:৪০
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×