জীবনে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হচ্ছে চিরন্তন। আপন অস্তিত্ব রক্ষাই এখানে চরম স্বার্থকতা। তাই সৃষ্টি হয় আত্মকেন্দ্রিক ভালোবাসার। মঙ্গলময় জীবন বলতে আমি বুঝি সেই জীবন যে জীবন যুক্তি দ্বারা পরিচালিত এবং প্রেম দ্বারা উদ্ভাসিত । মানবজীবনে প্রেমের অস্তিত্ব বিচিত্র। মানুষের প্রেমময়তা বা ভালোবাসার সূচনা পর্ব আদিম প্রকৃতিতে । তাই প্রকৃতি নিজ থেকেই শিখিয়েছে ভালোবাসার অভিব্যক্তিও প্রয়োজনীয়তা।নিজ অস্তিত্ব রক্ষায় নিজকে ভালোবাসা আর নিজের চারিপাশের প্রয়োজনীয় উপাদানকে ভালোবাসা ই প্রকৃতির শিক্ষা।
ক্ষুদ্র এই জীবনে অনেক দেখেছি, এখনও দেখছি, হযতো কিছুদিন বেঁচে থাকার সৌভাগ্য হলে আরো দেখব। জানপ্রাণ উজাড় করে যাদের পাশে দাঁড়িয়েছি, সাহায্য-সহযোগিতা করেছি, তারা অনেকেই আজ পাশে নেই, একটু খোজ নেবার চেষ্টাও করে না। অনেকে আবার অকৃতজ্ঞ বেইমান বলে চলে গেছে। তবে জীবনে ছায়াসঙ্গী হিসাবে অনেককে যে পাইনি তা বলব না।এখনও আল্লাহর দুনিয়ায় কিছু মানুষ আছে পরোপকারী যাদের অবদানকে কোন ভাবেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।জীবনের বৈরী সময় তারাই হয়েছিল আমার সামনে এগিয়ে যাবার পাথেয়।তাদেরই একজন গোলাম মোস্তফা খবির। যিনি ছোট ভাই বন্ধু হিসাবে, ছোট ভাই হিসাবে আজও আগলে রেখেছেন তার সবটুকু ভালবাসা আর বিশ্বাস দিয়ে। প্রবাসী জীবনের শুরুতে মনটা যখন স্বজনহারা, বন্ধুহারা হয়ে দিশেহারা দ্বিগ্বিদিক ছুটতো ঠিক তখনই কাছে পাই বন্ধু স্বজন আর বড় ভাই তুল্য তাকে। মনের সমান্তরালে মন আর হৃদয়ের অনেক কাছাকাছি মানুষদের পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হতো।‘নির্ভেজাল বন্ধুত্ব’ আর একই সমান্তরালে নেমে সমান গুরুত্বে মেশার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে তার। তখনই বুঝলাম বন্ধুত্ব, সে এক মজার সম্পর্ক, বন্ধনের দায়ভার নেই অথচ ভালবাসাময় শুভকামনা আছে! তাই সবকিছু আবার ধীরে ধীরে গুছিয়ে এনেছি।
দীর্ঘ জীবনে যাদের সাথে একসাথে পথ চলেছি, একসাথে রাজনীতির পাঠ নিয়েছি, একসাথে কাজ করেছি, যাদের সাথে বছরের পর বছর একসঙ্গে কাজ করে কাটিয়েছি, একে অন্যের ছায়ার মতো থেকেছি, অনেককে লেখাপড়া শিখিয়েছি, চাকুরী পেতে সহয়তা করেছি, রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করার প্রচেষ্টার সাথে নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে রাজনীতির মঞ্চ চিনাতে পাশে পাশে থেকে সাধারন ঘরের ছেলেদের অসাধারন ছাত্রনেতায় পরিনত করে দোহার থানা তথা জেলার রাজনীতিতে অবস্থান মজবুত করে দিয়েছি তারা আমার সামান্য কাজে পাশে দাঁড়ায়নি। অথচ যাদের জন্য কিছু করিনি, যাদের এক সময় প্রতিদ্বন্দ্বি ভেবে দুরে সরিয়ে রেখেছি তারাই আমার পাশে দাড়িয়েছে আমার প্রয়োজনে, আমার বিপদে। অনেক অচেনা মানুষ তাদের বুকে স্থান দিয়েছে আমাকে কোন কিছু দাবী না করে। এখনোও এই প্রবাসে নিঃসঙ্গতায়, নির্জনতায় অনুভব করি, চর্ম চোখে দেখি যাদের জন্য সব সময় মন কাঁদে তাদের আস্থা কম, সন্দেহ বেশি। দ্বিধায় তারা সর্বদা ডুবে আছে। কখনো আমার ভিতরের মানুষটাকে চিনতে চেষ্টা করে না। তারপরও কিছু মানুষের অটল বিশ্বাস যে নাই তা বলব না। তাদের অটল-অবিচল বিশ্বাসের ওপর ভর করেই এখনো টিকে আছি, দাঁড়িয়ে আছি মনের জোরে।
তারপরও কিছুদিন ধরে মন ক্ষত-বিক্ষত কিছুটা বিক্ষুব্ধ। কোন কাজই গুছিয়ে করতে পারছি না, ধীরস্থির ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, অধিকাংশ সময় মনটা অশান্ত থাকে। অশান্ত মন নিয়ে কি কোনো ভালো কাজ করা যায় ? মানুষের চাওয়া আর পাওয়ার কোন শেষ নেই। জীবন সাজাতে, জীবন রাঙাতে, অর্থনৈতিক ভাবে আরো স্বাবলম্বি হতে, পরিবারের সুখ সমৃদ্ধি বাড়াতে এক নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে হয়েছিলাম পরবাসী। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এসেছে ঠিকই কিন্তু মনের শান্তিকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বিলাসী জীবন যাপনে বাহ্যিক সুখ দিতে পারে আত্মিক সুখ দিতে পারে না। বাংলা ভিশনে প্রতি রবিও সোমবার একটি নাটক প্রচারিত হয় সৌদি আরবের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬:০৫ মিনিটে আমি নাটকটির সব পর্বই দেখার চেষ্টা করি। বিশেষ কোন কারনে কোন পর্ব মিস করলে ইউটিউব থেকে দেখে নেই। লংমার্চ সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লেখা নাটক হলেও এখানে জীবন এবং প্রেমের একটি জীবন্ত দিক তুলে ধরা হয়েছে। লংমার্চের গানের প্রতিভা্ আবদুল মজিদ গোপনে বিয়ে করে টুম্পাকে। বউকে সাথে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে চায় কিন্ত সব সময় তার সেই সাধ পূরন হয় না। একদিন তাই টুম্পাকে বলে "তোমার কাছে একটা চুড়ি হবে ? চুড়ি কেন ? উত্তরে মজিদ যা বলে তা অনেকটা আমাদের মতো যারা প্রবাসী তাদের জীবনের প্রকৃত চিত্রই যেন ফুটে উঠেছে। মজিদ বলে যখন রিক্সায় একা একা ঘুরব তখন চুড়িটাকে একপাশে রাখব ভাবব আমার বউ পাশে আছে। আমরা যারা প্রবাসী মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান রেখে প্রবাসে অর্থ কামানোর মেশিনে পরিনত হয়ে আছি কাজ শেষে যখন বাসায় একা বিছানায় ঘুমাতে যাই তখন মনে মনে মজিদের মতোই হয়তো ভাবি। এটাই প্রবাসের বাস্তবতা।
কিন্তু বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা আজ প্রতারনা আর হয়রানীর শিকার। এব্যাপারে সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই, নেই তাদের কোন দায়বদ্ধতা। বিভিন্ন দেশে একের পর এক শ্রম রপ্তানী বন্ধ হচ্ছে অথচ সরকার কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বলা হয় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে আজ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল অথচ প্রবাসীদের সমস্যা দেখার কেউ নেই।আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল গুলি শুধু স্বপ্ন দেখায় স্বপ্ন পূরণের পথ দেখায় না। আজ যখন দুর্বৃত্ত, সন্ত্রাসী, কালো টাকার মালিক, চিহ্নিত ক্রিমিনালদের দেশের রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে; তখন প্রবাসী ত্যাগী, দেশদরদি শ্রমিকদের অভাব প্রকটভাবেই অনুভব করেন কিনা জানিনা। অথচ পরিতাপের বিষয় এই যে, দেশের জন্য যারা জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করে, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কঠোর পরিশ্রম করে রেমিটেন্সের প্রবাস ঠিক রাখছে তাদের কথা কেউ ভাবে না এটা বড়ই দুঃখজনক।আজ ছয় দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে শিরশ্ছেদ ও ফাঁসির প্রহর গুনছেন ৪০ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৫, সৌদি আরবে ১৩, কুয়েতে ৯ এবং বাহরাইন, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ১ জন করে আছেন। তারা ১২ বিদেশি নাগরিক ও ২৯ জন বাংলাদেশিকে খুনের জন্য দায়ী। দেশগুলোর আইন অনুযায়ী শিরশ্ছেদ বা ফাঁসি দিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কথা রয়েছে। তবে এ সংখ্যা আরও অন্তত ৫০ জন বাড়তে পারে। কারণ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগে প্রায় ১০০ মামলা এখন বিচারাধীন।বিদেশে গিয়ে কষ্ট করে পরিবারে সুখ বয়ে আনবেন, এমন আশায় সহায়সম্বল বিক্রি করে প্রবাসে গিয়েছিলেন এই হতভাগ্যরা। কিন্তু সেখানে নিজেরা যেমন করুণ পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছেন, তেমনি দেশেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি দেশে থাকা স্বজনেরা। শেষ সুযোগ রক্তমূল্য (ব্লাড মানি) পরিশোধেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও এ ক্ষেত্রে আশার আলো অত্যন্ত ক্ষীণ। শুধু নিহতের পরিবার ক্ষমা করলেই রেহাই পাবেন তারা। সংশ্লিষ্ট দূতাবাস ও স্বজনদের চেষ্টা সত্ত্বেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা পাওয়া যাচ্ছে না।সরকারের তথ্যানুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বেশি মৃত্যুদণ্ডের মুখে পড়ছেন বাংলাদেশিরা। ওই ৪০ জনের মধ্যে ৩৮ জনই মধ্যপ্রাচ্যের চার দেশের। সৌদি আরবে গত বছর আট বাংলাদেশির শিরশ্ছেদের পর দেশ-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সেই সৌদি আরবেই এখন শিরশ্ছেদের মুখে রয়েছেন ১৩ জন বাংলাদেশি। খুনের অভিযোগে আরও ১৫ জনের বিচার চলছে।জেদ্দা প্রবাসী ব্যবসায়ী আমার ফুপাত ভাই সিদ্দীক গাজীর স্ত্রী ইসমতারা ও কন্যাকে হত্যার দায়ে ঢাকার দোহারের গোলাম হায়দার দিপুর বিচার চলছে।এই ভাবী ছিল আমার কলেজ জীবনের সহপাঠিনী এবং আমার পছন্দেই বিয়ে হয়।আজ দুর্নীতিবাজ, সুযোগসন্ধানী, সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ আর সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা দালালদের কারনে দেশে বিদেশে প্রবাসীরা নানাভাবে হয়রানীর শিকার। আজ দেশে দৃঢ়চেতা, সৎ ও নির্লোভ চরিত্রের মানুষ বড়ই প্রয়োজন।নতুন প্রজন্ম যাদের ত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে।
আজ দেশের দৃশ্য দেখে ষোড়শ শতকের ইংরেজী অর্থনীতিবিদ স্যার থমাস গ্রেসামের কথা মনে পড়ে। স্যার গ্রেসাম রানী প্রথম এলিজাবেথের অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত সূত্র ‘নষ্ট টাকা ভাল টাকাকে বাজার হতে সরিয়ে দেয়’...এখনও বেশ প্রসিদ্ধ এবং আলোচিত। সে সময় বাজারে স্বর্ণের মুদ্রার প্রচলন ছিল। মুদ্রায় ব্যবহৃত স্বর্ণের মূল্য সাধারণত মুদ্রার মূল্যের চাইতে বেশি হতো। এর ফলে কিছু অসাধু মানুষ স্বর্ণ মুদ্রা হতে চেষ্টা করত ঘসে ঘসে কিছু স্বর্ণ আলাদা করে তুলে নিতে। এর ফলে দেখা যেত মানুষ নতুন মুদ্রা ব্যবহার না করে পুরনো মুদ্রা ব্যবহার করতেই অভ্যস্ত ছিল আর নতুন মুদ্রা মানুষ যত্ম করে সিন্দুকে জমা করে রাখত। এর ফলে দেখা গেল এক সময় বাজার থেকে সকল ভাল নতুন স্বর্ণ মুদ্রা উধাও হয়ে গেল এবং সকল ধরনের ঘসা-মাঝা, পরিমাণে কম স্বর্ণ নিয়ে প্রচুর পুরনো অচল মুদ্রায় বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। গ্রেসামের এই সূত্র রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায়শ ব্যবহৃত হয়। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে খারাপ জিনিস সকল ভাল জিনিসকে সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। তাই আমার সব সময় মনে হয় বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই ধারা এখন বহমান। কারন বাজারে কোন জিনিসই এখন ভাল নেই। এসবের পরও দোহার থানার বর্তমান টি.এন.ও মোহাম্মদ আলামিন দোহারে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন, ঔষধ ব্যবসায়ীদের ড্রাগ লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করার লক্ষে দোহারের ঔষধ ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় সভা রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে থেকে কাজ করে যাওয়ার ঘোষনা সত্যিই প্রসংশার দাবী রাখে। তারপরও চাকরির একটা গ্গ্নানিবোধ আছে। আছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণের আধিপত্যের চাপ। চাকরিতে সার্বক্ষণিক দায়িত্ববোধের মর্মপীড়াও আছে। এসব জানা সত্ত্বেও, তিনি তার কাজ করে যাচ্ছেন। এটা একটা আশার আলো।
*********