-এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলল সুদীপ। আমার স্কুল বেলার বন্ধু। একই গ্রামে আমাদের বাড়ি। কত রাত-দিন আমরা একসঙ্গে পার করেছি, তা বলে শেষ করা যাবে না। বছর দুয়েক সুদীপের সঙ্গে যোগাযোগ নাই। সেদিন শাহবাগে হঠাৎ দেখা। সুদীপকে চেনা যায় না। হ্যাংলা-পাতলা সুদীপের এখন ভূড়িও হয়েছে। নীল স্ট্রাইপ শার্ট আর জীন্স প্যান্ট। পায়ে কেডস। ইন করেছে। মানিয়েছে ভালোই। কিন্তু মুখটা একটু শুকনা লাগছিল।
আমি বলি, ‘কী সুদীপ? দীপারে পাইয়া সব চেইঞ্জ হয়্যা গ্যাছে দেখি। কিন্তু মুখ শুকনা ক্যানো?’
সুদীপ হাসে। শুকনো, মলিন হাসি। আমি বুঝলাম কোনো সমস্যা হয়েছে ওর। ওতো এমন হাসি হাসে না কখনো।
দেখা সাক্ষাত কিংবা আড্ডাবাজি না হলেও ওর খবর আমি জানতাম, মহিমের কাছে। দীপা নামে এক মেয়েরে সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছে। দীপা ইডেন থেকে মাস্টার্স করছে, বোটানীতে। ওরা মোহাম্মদপুর শেখেরটেকে থাকে। সব জানি, খালি সুদীপের সঙ্গে কথা হয় না। ও ফোন দেয় না, আমিও না।
সেদিন দেখা হওয়ার পর, সুদীপের মুখে অচেনা শুকনা হাসিটা দেখে, আমি ওকে বলি, চল দোস্ত কোথাও গিয়ে বসি। সুদীপ রাজি হয়। আমরা গিয়ে চারুকলার উল্টোপাশে ছবির হাটের ভেতরে একটা নির্জন জায়গায় বসি।
সুদীপ বলতে থাকে, ‘কিন্তু বিয়ের পর উল্টো চিত্র। ওর রাগ অনেক বেশি, নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। আমি মেনে নিয়েছি। একজন রাগান্বিত হলে আরেকজনকে চুপ করে থাকতে হয়, আমি থাকি। কিন্তু তারপরও দিন দিন সবকিছু সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কোনো মেয়ে বন্ধু সহ্য করতে পারে না। একে একে সব মেয়ে বন্ধুদের এড়িয়ে চলা শুরু করেছি। বন্ধুরা সবাই আমারে নিয়া হাসাহাসি করে।’
আমরা যেখানে বসেছি তার সামনের অংশটুকু অন্ধকার। পেছনে আলো। আমরা অন্ধাকারের দিকে মুখ করে বসে আছি। সুদীপ কিছুক্ষণ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ওর চোখের দিকে তাকাই। ওর দুই চোখ ছলছল করছে। আলো আধাঁরির মাঝেও তা স্পষ্ট আমি দেখতে পাচ্ছি। আমি সুদীপের কাঁধে হাত দেই। সুদীপ মাথা নিচু করে। চোখের জলটা লুকানোর চেষ্টা করছে।
‘অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরী হলে অকারণে রাগারাগি। অফিস থেকে যতটা পারি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাই। আড্ডাবাজি বন্ধ, বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি পরিচিত সবার কাছ থেকেই। অথচ যে চাকরী করি, তাতে যোগ্যতার পাশাপাশি সিনিয়র বড় ভাইদের সুনজর থাকতে হয়। সুসম্পর্ক রাখতে হয়। কেউ হয়তো সুপারিশ করে তার প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গেলো। এসব কিছু বন্ধ হয়ে গেছে।’ সুদীপ আবারো বলতে থাকে।
‘যাক বন্ধ হয়ে যাক, তবু ঘরে শান্তির কল্যাণে আমি সব মেনে নিচ্ছি। সব ছেড়ে দিয়েছি কপালের উপর। ওকে ভালোবাসি। কিন্তু আমার ভালোবাসার প্রকাশ হয়তো অন্য সবার চাইতে একটু অন্যরকম। এ কারণেও অশান্তি। তবু চেষ্টা করি, ও বলে এসব নাকি ‘ঢং’! তখন কী করার থাকে আমার?’ কিছুক্ষণ চুপচাপ আমরা দুজনই, আমি আর সুদীপ, আমার স্কুল বেলার বন্ধু।
‘ফেইসবুকে ওর একটা একাউন্ট খুলে দিলাম। তারপর থেকে শুরু হলো নতুন যন্ত্রণা। আমার ফেসবুকের পাসওয়ার্ড চায়, আমার ফেসবুক ঘেঁটে দেখে আমি কাদের সঙ্গে কথা বলি। অনেক দিন আগের করা আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীর (মেয়ে) ছবিতে একটা কমেন্ট দেখে হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে বসল। আমি রীতিমতো আশ্চর্য। বোঝানোর চেষ্টা করলাম এইটা সাধারণ বিষয়...এতে মাইন্ড করার কী আছে? সে আমাকে বিশ্বাস করে না।’
‘ফেইসবুক গেল, এইবার আমার ই-মেইল এর পাসওয়ার্ড চায়। সন্দেহ। ই-মেইল চেক করে দেখবে। আমি বোঝাই, সত্যিই যদি আমি কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়াই তাইলে কি তুমি ধরতে পারবা? বিশ্বাস রাখো...বিশ্বাস না থাকলে ক্যামনে সম্পর্ক টিকব? বোঝে না, বোঝার চেষ্টাও করে না।’
এইবার দেখি সুদীপের চোখ ভিজে উঠেছে। আমি নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে যাই। কোনো কথা বলি না। কি স্বান্তনা দিব, ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করি আমি। ধরাই, সুদীপকেও একটা দেই। সেই ৯/১০ বছর পার হইয়া গেলো আমারা সিগারেট খাই, গোল্ডলীফ। দুজনরে কেউই ব্র্যান্ড চেইঞ্জ করি নি। আগেরটাতেই আছি।
সিগারেটে একটা টান দেওয়ার পর যেন আমার মাথাটা একটু খোলে। আমি বলি, মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়া যাস নাই। এইটা তো রোগ। সাইকোথেরাপি দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
‘মনোচিকিৎসকের কাছে নিয়া যাইতে চাই। যাবে না। চেষ্টা করেছিলাম লাভ হয় নাই। জেদ... যাবে না। কোনো কিছুতেই রাজী হয় না। ও বলে আমারই নাকি চিকিৎসা প্রয়োজন!’ সুদীপ বলে।
‘সবকিছু মেনে নিয়ে চলার চেষ্টা করছি। কিন্তু কত আর সহ্য করব? ভাবি একদিন সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে বিদেশে পালিয়ে যাই। কী জানি হয়তো একদিন কিছু একটা আমিই হয়তো করে বসবো...! কারণ আমি চাই না আমার জন্য ও সুইসাইডের মতো কিছু একটা করে বসুক। সামান্য বিষয় নিয়ে এর আগে দুই দুই বার চেষ্টা করেছে। আল্লাহ সহায়। বেঁচে গেছে। আমি মানছি ও আমাকে ভীষণ ভালবাসে। ‘ভীষণ’টাই কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে যাপিত জীবনে। আমি তো ধীরে ধীরে পিস্ট হয়ে যাচ্ছি।’
বলতে বলতে সুদীপ উঠে দাঁড়ায়। রাত ১০ টা বেজে গেছে। ওর বাসায় যেতে হবে। তা না হলে আবারো দীপার সঙ্গে ঝগড়া লাগবে। সুদীপ বাসায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। আমি দাঁড়াই কিছুক্ষণ। কী বলবো সুদীপকে? আমি নিজেও যে একই যন্ত্রণায় আছি......!!!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১১ বিকাল ৪:১১