আবহমান কাল ধরে বাঙ্গালি জাতি নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অপার সম্ভাবনার পথে এগিয়ে চলছে এক সংগুপ্ত প্রাণশক্তির বলে। সেই শক্তি হচ্ছে তার সংস্কৃতি। চিরায়ত বাংলার সংস্কৃতি, বাঙ্গালির হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বহন করছে। বাঙ্গলা গান হচ্ছে এ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যা বাঙ্গালির আবেগ-অনুভূতি, ভালবাসা-ভাললাগা, সুখ-দুখের প্রতীয়মান ছবি তুলে ধরে। রূপসী বাংলার রূপ-সৌন্দর্য প্রকাশে বাংলা গানের জুড়ি মেলা ভার।
তবে বাঙ্গালির সেই গান, শাশ্বত প্রাণ বিশ্বায়নের করাল গ্রাসে ক্রমাগত বিলীয়মান। আকাশ সংস্কৃতি বদলে দিচ্ছে আমাদের অভিরুচি। রিমিক্সের নামে পরদেশী সুর-ছন্দ ক্রমশঃ আধিপত্য বিস্তার করে চলছে বাঙ্গলা গানের উপর। এক সময় শুধু গানেই চেনা যেত বাঙ্গালিকে। আজ কোথায় সেই সুর, সেই ছন্দ!
একটু পিছে ফিরে তাকালে, সেই সত্তুর-আশির দশকের বাঙ্গলা গানেও যে আবেদন ছিল, আজ যেন তার লেশ মাত্র নেই। তখনকার প্রতিটি গান যেন আমাদের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা এক একটি অনবদ্য অনুভূতি গাঁথা। এক একটি ছন্দময় স্বপ্ন-কথা। যা শুধু সুরের মুর্ছনাতেই সকলের কাছে প্রকাশ করা যেত।
ওল্ড ইজ গোল্ড। পুরাতন হলেই সব কিছুতে ময়লা জমেনা, মরিচা পড়েনা। কিছু কিছু বিষয় আছে, সময়ের সাথে সাথে যা হয় আরও শাণিত ও আকর্ষণীয়। তাইতো সুরের জগতের সেই হারিয়ে যাওয়া-পুরাতন গানগুলোকে স্বর্ণ যুগের গান বলা হয়। অতি পরিচিত সেই সুর শুনলে আজও পৌঢ়, বৃদ্ধ সকলের শিরায় শিরায় ভিন্ন এক অনুভ্থতি প্রবাহমান হয়। ভাল লাগায় হৃদয় যেন তা-থৈ তা-থৈ নেচে ওঠে।
সময়ের সাথে সাথে পাল্টে গেছে চারিদিককার দৃশ্যপট, সমাজ-সভ্যতা, দেশ-কাল। কিন্তু এতটুকু পাল্টেনি তরুন বয়সে সারাক্ষণ কন্ঠে লেগে থাকা সেই প্রিয় গানগুলো। “-----সর্বনাশা পদ্মা নদী•••••তোর কাছে শুধাই•••••বল আমারে, তোর কি রে আর কূল-কিনারা নাই••••••• কিংবা ও যার আপন খবর, আপনার হয়না, একবার আপনারে চিনতে পারলে রে •••যাবে অচেনারে চেনা•••যার আপন খবর আপনার হয়না।”, জন্ম আমার ধন্য হলো মা-গো••••••••••আমায় তুমি ডাকো•••••। এসব গানে আমরা যে হৃদয় নিংড়ানো আবেগ দেখতে পাই, সেই হৃদয়ের টান খূজে পাইনা হাল আমলের জেমসের গান-সিনায় সিনায় লাগে টান কিংবা খুলে দেখো বুকটা অথবা বাংলা সিনেমার রিমে গান-“সোনা বন্ধু তুই আমারে ভোতা দা দিয়ে কাইট্টা লা, পিরিতের খ্যাতা যাইত্যা ধইরা মাইরা লা•••••।” রিমিক্সে নামে এসব কি হচ্ছে! এ কারণেই হয়তো প্রকৃত সঙ্গীত রসিকরা রি-মিক্স শব্দটিকেও ভালভাবে গ্রহণ করতে পারেনি।
একথা অস্বীকার করা যায়না যে, “রিমিক্স” কনসেপ্টই অনেক হারিয়ে যাওয়া গানকে জীবন্ত" করে তুলেছে, তৈরী করেছে অসংখ্যা নতুন শ্রোতা। এক প্রজন্মের সুর সাধনা পৌছে দিয়েছে পরের প্রজন্মের কাছে। গানের কথাকে অপরিবর্তনীয় রেখে সুরে, ছন্দে একটু ভিন্নতা, কিছু নতুনত্ব যোগ করার মধ্যেই আপাতত গানের রিমিক্স সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে হারানো সুরকে পুঁজি করে আজকাল নতুন নতুন গানও আসছে। কিন্তু তা বাঙ্গলা গানের কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে?
খিচুড়ি নিঃসন্দেহে রুচিকর ও তৃপ্তিদায়ক। তবে তা রান্নার জন্য প্রয়োজন মুন্সীয়ানা। ডাল-চাল-পেয়াজ-রসুন দিয়ে চুলোয় হাড়ি বসিয়ে দিলেই মজাদার খিচুরি হয়না। কথাটি রিমিক্স গানের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। যে গানের সাথে যতটুকু তাল, লয় প্রয়োজন, যেখানে তবলা কিংবা হারমোনিয়াম ছিল, সেখানে ইলেকট্রিক গীটার কতটুকু প্রজোজ্য? রিমিক্স করা গানের কথা ও ভাবের সাথে মিউজিকের সামঞ্জস্য আছে তো?
প্রতিটি বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় রয়েছে। যা দেখে, যা শুনে তাকে চেনা যায়, বোঝা যায়। প্রতিটি গানের রয়েছে নিজস্ব সত্ত্বা, সেই সত্ত্বা হচ্ছে তার সুর। সুরই সেই গানের জনপ্রিয়তার মূল উতস, প্রাণভোমরা। রিমিক্স এসে সেই সুরকেই আমুল বদলে দিচ্ছে। চিরচেনা গানটি অত্যাধুনিক মিউজিক ইন্সট্রুমেন্টের আশীর্বাদে (!) হয়ে যাচ্ছে অচেনা।
জনপ্রিয় একটি গান যে সময়ে রচিত ও সুরারোপিত হয়েছিল, ই-থারে-ভেসে বেড়াচ্ছিল দিনের পর দিন। দুই যুগ পরে রিমিক্স হওয়া সেই গানে পুরাতন আবহের আর কিছুই অবশিস্ট নেই। যেন পস্নাস্টিক সাজারির পর ভিন্ন চেহারা এক মানব/মানবী।
হারিয়ে যাওয়া গানগুলোকে পুণরুজ্জীবনের নামে যে প্রায়াস চলছে তা কার্যত বাঙ্গালা গানের স্বর্ণ যুগের গৌরবময় অতীতকে সমূলে বিনস্ট করার নামান্তর মাত্র।
“উচাটন মন ঘরে রয়না--“প্রিয়া মোর•••••কিংবা খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট ও শিশু আনমনে খেলিছ••••••”, যেন তেন সুর দিলেই কি এমন গান গাওয়া সম্ভব? এতো শুধু গান নয়, এর মধ্যে আরও কত কিছু অব্যক্ত রয়ে গেছে। হৃদয়ের সবটুকু আবগে নিংড়ে দেয়া এ সব গান রিমিেক্সর জন্য প্রয়োজন আরেকজন নজরুলের।
দক্ষ শিল্পীর হাতে না পড়লে বিখ্যাত কোন শিল্পকর্ম যেমন ধ্বংস হয়ে য়ায়, তেমনি রিমিক্সের নামে আজ -কাল যা হচ্ছে তা বাঙ্গলা গানের ঐতিহ্যকে বিলীন করার প্রায়াস মাত্র।
আর তাইতো একজন িবখ্যাত ব্যান্ড তারকা যখন রবীন্দ্র সংগীত রিমিক্সের অভিযানে নেমেছিেলন, ঝড় উঠেছিল বাংলার দু’পাড় জুড়ে। উপায়ন্তর না দেখে রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়েছিল রবীন্দ্র রিমিক্স কারিগর েক।
আর এই রিমিক্স জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে বাংলার আউল-বাউল, জারি-সারি-ভাটিয়ালী গান। সে স্থান জুড়ে বসছে পপ, র-প , ব্যান্ড সহ পাশ্চাত্য সংগীত। জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীর সেই গানটি এখানে বেশ প্রাসঙ্গিকঃ
“আউল, বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকশন আইলো রে••••,
আরে সবার মাথা খাইলো রে••••”
২০০৭ সালে বাংলাদেশ ভ্রমন করে যাওয়া কিংবদন্তী মাইকেল জ্যাকসনের সহোদর গ্রামী এওয়ার্ড বিজয়ী পপ সুপারস্টার জারমেইন জ্যাকসন এ প্রসঙ্গে চমতকার একটা ব্যাখা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন-“বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বৃহত একটি কালচার, তুলনামূলক ক্ষুদ্র কালচারকে গ্রাস করতে চাইবে-এটাই স্বাভাবিক। এ চিত্র শুধু গানেই নয়, রাজনীতি-অর্থনীতি-ভৌগলিক সীমারেখা সর্বত্রই বিরাজমান।”
পাশ্চাত্যের লোক সংখ্যা, ভৌগলিক আয়তন, শক্তি-মত্তার তুলনায় বাঙ্গালিরা অনেক পিছিয়ে থাকলেও তাদের রয়েছে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস। হাজার বছরের লালিত এই বাঙ্গালী সভ্যতার রয়েছে স্বকীয়তা। এদেশের খাল-বিল, নদ-নদী, মেঠো পথ, পাল তোলা সম্পান নাও, বৈচিত্রময় ষড় খতু, রং-বেরঙ্গের ফুল, পাখির সুর, জীব-বৈচিত্র আর মানুষের সহজ-সরল, সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের গভীর থেকে উঠে এসেছে বাঙ্গালীর গান। এদেশের গানে মিশে আছে বাঙ্গালির বীরত্ব গাঁথা, কৃষকের হাসি-কান্না, রাখালির করুণ বাশি, কোকিলের সুর, বিরহীনীর ব্যাথা, চির সুন্দর বাঙ্গালি নারীর রূপ-যৌবন। বাঙ্গালির জন্ম ও বিয়ের উতসব, মৃত্যুর মাতম, নবান্ন সহ নানা পার্বনের জন্য রয়েছে ভিন্ন সুর, ভিন্ন গান।
আজকাল আর বিয়ের আসরে শোনা যায়না-”হলদি বাটো, মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মৌ•••••।” সেখানে জুড়ে বসেছে-ধুম্মাচলে ধুম্মাচলে ধুম•••••••••••।
বাংলা গানের সুরের সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবে মিশে আছে হারমোনিয়াম, তবলা, এক তারা, দোতারা, সেতার, ঢোল-চাকী, বাঁশী আরও কত কী••••। কোকিল কণ্ঠী সাবিনা ইয়াসমীনের কন্ঠে তাইতো শোনা যায় 'একতারা লাগেনা আমার, দোতারাও লাগেনা; দেশেরই গান গাইতে আমার হৃদয় থেকেই সুর আসে আহারে আকাশে, বাতাসে কতই জারি-সারি ভাসে....'
কিন্তু রিমিক্স করা গানে এই সব ইনস্ট্রুমেন্টের বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে পাশ্চাত্য সংগীত যন্ত্রাংশ। যা আমাদের ভাষা, ভাবের সাথে কখনোই সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারছেনা, যেমন তেলের সাথে কখনো জলের সম্প্রীতি হয়না।
বাংলা গান শান্ত-নিবিঢ় কিছু অনুভূতির উপস্থাপনা। কিন্তু আমদানীকৃত রিমিক্স সুর ও ছন্দ সেই শান্তির নীড়ে এনেছে অস্থিরতা। বর্তমান রিমি প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে এটা কোন গানের সংস্কার নয়, যেন অসহায় বৃদ্ধকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। তাই গানের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব স্বত্তাও।
নবজাতকের জন্ম সর্বদাই আনন্দের। নতুনকে তাই সুস্বাগতম। তবে নতুনের সাথে পুরাতনের একটি সুসম্পর্ক বাংলা গানের অস্থির অবস্থায় ভারসম্য এনে দিতে পারে। (রিেপাষ্ট)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১০ দুপুর ১২:৩৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




