রহস্যের জালে আবৃত রাজধানীর খিলগাও এলাকার কলেজ শিক্ষক চন্দন প্রকাশ সাজ্জাদ হত্যাকান্ড। তবে তার চেয়ে আরও বেশি রহস্যাবৃত তার লাশ নিয়ে দুই স্ত্রীর (?) কাড়াকাড়ি নিয়ে। স্বামীর লাশ কে পাবেন প্রথম স্ত্রী তিথি না কি দ্বিতীয় স্ত্রী পলি? সাজ্জাদ কি সত্যিই ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। আরও নানা প্রশ্ন ঘিরে ধরেছে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত এই হত্যাকান্ডের পরে। বিষয়টি এখন আদালতে বিচারাধীন। সহসাই যে এর সুরাহা হচ্ছে না, তাও বলে দেয়া যায়। মনে হচ্ছে - জটিল কোন কাহিনী আছে এর মধ্যে। ······
আজ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ বিষয়ে দ্বিতীয় দফা সাক্ষ্য নেয়া হবে। চন্দন ওরফে সাজ্জাদের মুসলমান স্ত্রী আকলিমা আকতার পলির সঙ্গে আনিসুল ইসলাম নামে যে মৌলভি বিয়ে পড়িয়েছিলেন আজ তার সাক্ষ্য নেবেন আদালত। একই দিন ওই বিয়ের হলফনামা সম্পাদনকারী নোটারি পাবলিক নাসিরুজ্জামানের সাক্ষ্য নেয়া হবে। এর আগে গত রোববার মুখ্য মহানগর হাকিম এ কে এম এনামুল হক পলির বিয়ের হলফনামার দুই স্বাক্ষীর সাক্ষ্য নেন।
আইনজ্ঞরা বলছেন, চন্দনের সঙ্গে বিয়ের প্রমাণ দিলেই স্বামীর লাশ ফেরত পাবেন না পলি। কারণ স্বামীর লাশের দাবিদার হিসেবে প্রথম স্ত্রী তিথির অগ্রাধিকার রয়েছে। স্বামীর লাশ ফেরত পেতে হলে পলিকে চন্দনের প্রথম স্ত্রী হিসেবে দাবিদার তিথির দাবি-দাওয়া মিথ্যা প্রমাণ করতে হবে।
এদিকে চন্দনের মৃত্যুর পর পুলিশ বাদী হয়ে খিলগাঁও থানায় একটি মামলা করলেও তিথি ফেরার পর আদালতে আরেকটি মামলা করেন। ওই মামলায় ঢাকার মহানগর হাকিম এ এম জুলফিকার হায়াত বুধবার চন্দন হত্যা মামলা তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দিয়েছেন। এ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত লাশের সতকারের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না আদালত।
এদিকে তদন্তে সংিশ্লষ্ট সিআইডি সূত্রগুলো জানিয়েছে, চন্দন ওরফে সাজ্জাদের খুনের মোটিভ এখনো উঞ্ছঘাটন করা সম্ভব হয়নি। রহস্যময় পুরুষ চন্দনের জীবনযাত্রা, ধর্মান্তরিত হওয়া, প্রথম স্ত্রীকে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে এবং পরিবারের কাছে তা গোপন রাখাসহ তার কর্মেক্ষেেত্রর অনেক বিষয়ই রহস্যে ঘেরা। এসবের জট না খুললে তার খুনের নেপথ্য কারণ শনাক্ত করা কঠিন হবে।
এদিকে চন্দনের লাশ দাফন করার জন্য ২৭ ডিসেম্বর আদালতে আবেদন করেন পলি। তিনি জানান, চন্দন ২০০৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হন এবং তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে তারা একসঙ্গে খিলগাঁওয়ের বাসায় বাস করতেন।
পলি বলেন, বিয়ের পর থেকে সাজ্জাদ নিয়মিত নামাজ পড়তেন, রোজা রাখতেন, কয়েকবার কোরবানিও দিয়েছেন। এখন যদি কেউ দাবি করে তার হিন্দু ধর্মের একজন স্ত্রী রয়েছে, তা মেনে নেন কিভাবে? সাজ্জাদের অর্থ-সম্পদের ভাগিদার হতেই তিথি এ খেলায় মেতেছেন বলে পলি অভিযোগ করেন।
অন্যদিকে চন্দনের প্রথম স্ত্রী হিসেবে দাবিদার তিথি জানিয়েছেন, সবশেষ সরস্বতী পূজায় চন্দন তার সঙ্গে থেকে পূজা করেছেন। ২৩ বছরের সংসারজীবনে কখনো চন্দন তার কাছে কোনো কথা গোপন করেননি। দ্বিতীয় বিয়ে করার মতো এতো বড় একটা ঘটনা চন্দন তার কাছে কোনোভাবেই চেপে রাখতে পারেন না বলে দাবি করেন তিথি। একইসঙ্গে চন্দনের ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।
তিথি বলেন, এখন তার কপালের সিঁথির সিঁদুর মুছতে হবে স্বামীর পা দিয়েই। ১৬ দিন ধরে তার লাশটা মর্গে পড়ে থেকে আত্মার কষ্ট হচ্ছে। হিন্দু রীতিতে দাহ করতে হবে। তিনি তার লাশ চান। স্বামীর মৃত্যুর ১৭ দিন পরও তিনি ‘অমলিন’ হয়ে আছেন এর চেয়ে বড় যন্ত্রণা আর কিছু নেই।
এক লাশের জন্য দুই স্ত্রী দাবিদার হওয়ায় বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। তবে গতকাল পর্যন্ত আদালত এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেননি। তাই মর্গ থেকে লাশ নিয়ে দাফন কিংবা দাহ করা যাচ্ছে না।
দ্বিতীয় স্ত্রী আকলিমা আকতার পলি বলেন, তিনি যখন ক্লাস নাইনে পড়েন তখন থেকে তিনি তাকে পড়াতেন। চন্দন স্যার ভিন্নধর্মাবলম্বী ছিলেন সেটা তার জানা ছিল। একসময় তিনি তাকে ভালোবাসতে শুরু করেন। তার প্রতি পলির একধরনের মোহ তৈরি হয়। একপর্যায়ে তাকেও ভালো লাগে। তবে প্রেম-ভালোবাসার বিষয়টি পরিবারের পক্ষ থেকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া হয়নি। ভালোবাসার টানে তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছেন। এখন তার লাশটা তিনি চান। তার দাফনকাজ সম্পন্ন করতে হবে। তা না হলে তার ভালোবাসার যে কষ্ট হবে, অপমান হবে। এ কথা বলতে বলতে অঝরে কাঁদছিলেন পলি।
পলি বলেন, তিনি (সাজ্জাদ চন্দন) যে আগে বিবাহিত ছিলেন, এটা কখনো বলেননি। তিনি জানতেনও না। একজন মানুষ যদি এসব গোপন রেখে প্রেম করে তাহলে তার কী করার থাকে? পলি বলেন, তার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার আগে তার কোনো আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় আসতেন না। তার কোনো খোঁজ নিত না। এখন তার এতো স্বজন কোথা থেকে আসে? স্বামীর লাশ তিনিই নেবেন।
এদিকে প্রথম স্ত্রী তিথি চক্রবর্তী গতকাল আদালতপাড়ায় আইনজীবীর ক েক্ষ বলেন, খুনের রহস্য ধামাচাপা দেয়ার জন্য তারা এখন সাজানো কথা বলছেন। তার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। আগে তিনি তার লাশ চান; পরে বিচার চাইবেন। তিনি বলেন, স্বামীকে হারিয়ে তিনি এখন চরম অসহায়। লাশের সতকারের পর আরো কতো কিছু করতে হবে তাকে। তিথি বলেন, ১৯৮৬ সালের ১২ জুলাই পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। পলি ও তার পরিবারের দাবিকে প্রতারণা বলে মন্তব্য করেন তিথি। মরে যাওয়া তার স্বামীকে নিয়ে তারা তামাশা করছে। তিথি বলেন, তার স্বামীর ভোটার আইডি কার্ড, পাসপোর্ট, নাগরিকত্বের সনদ, ব্যাংক হিসাব ও মোবাইল বিলসহ সর্বত্র চন্দন চক্রবর্তী। খুন হওয়ার পর তাকে জোর করে মুসলমান বানানোর চেষ্টা চলছে। তাছাড়া পলি যে কাবিননামা করেছে সেখানে চন্দনের জন্মতারিখ লেখা হয়েছে ১৯৭৩ সালের ৫ ডিসেম্বর। অথচ পাসপোর্টে ১ জানুয়ারি ১৯৭০। এ পাসপোর্ট দিয়ে চন্দন কলকাতায়ও গেছেন। এছাড়া রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীতের ওপর এমফিল করার সব ঠিকঠাক করে দিয়েছেন তিনি। আর এখন পলিরা লাশের কপালে ধর্মান্তরিতের নিশানা লেপ্টে দিচ্ছেন।
এদিকে আদালতে করা মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে আজ। তিথির আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুলতান উদ্দিন জানান, পলি যে কাগজপত্রের ভিত্তিতে চন্দন চক্রবর্তীর মুসলমান ও বিয়ে হওয়ার দাবি করছেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আরেক আইনজীবী শ্যামল চক্রবর্তী জানান, হিন্দু আইন অনুযায়ী তাকে সতকার করতে হবে। কারণ চন্দন হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করলেও তিনি এ ধর্মের আচার-আচরণ মেনে চলেছেন। অ্যাডভোকেট শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, তারা এর ভিত্তিতে চন্দনের লাশ ফিরে পেতে ও দাহ করতে চান। তিথি তার আইনজীবীর মাধ্যমে ২৭ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে স্বামীর লাশ পাওয়ার আবেদন করেন।
হাকিম এ কে এম এনামুল হক কয়েক দফায় ওই আবেদনের ওপর শুনানির পর গতকাল চন্দনের দ্বিতীয় বিয়ের কাজী ও হলফনামা সম্পাদনকারী নোটারি পাবলিকের বক্তব্য শোনা দিন ধার্য করেন। রোববার শুধু কাজী আদালতে উপস্থিত হয়ে তার সাক্ষ্য দেন।
উেল্লখ্য, ২৫ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় দুবৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হন খিলগাঁও আইডিয়াল সিটি কলেজের সাবেক শিক্ষক চন্দন চক্রবর্তী।
Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




