ঈদ। ঈদ মানেই আমার মনে সবার আগে জেগে ওঠে সেই সন্ধ্যাটা। যে সন্ধ্যায় টিভি অন করা থাকবে। বাসার সবাই ইফতারের পর্ব না শেষ করেই ছাদে বা বারান্দায় দৌড়াবে চাঁদ উঠেছে কিনা দেখতে। একটু পরে পরে টিভির দিকেও নজর রাখা হবে আমাদের আগে টিভিটা চাঁদ দেখে ফেললো কিনা সেটা দেখতে।
তারপর বাইরে রাস্তায় গলিতে হইচই চেচামেচি সাথে অবশ্য অবশ্য দু একটা পটকার দুমদুম আওয়াজ।এইবার নিশ্চিৎ চাঁদ উঠেছেই।
"ও মন রমযানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ"
মানুষজন যতই গানটি নিয়ে হাসি তামাসা করুক না কেনো, আমার মনের মাঝে এই গানটি মানেই ঈদের রাত। এই গানটি মানেই বুকের মধ্যে ফিরে যাওয়া ছোটোবেলার ভালোলাগারা।কোনোদিন যদি বিটিভি ঈদের রাতে মানে চাঁদরাতে এই গানটি দেখানো বন্ধ করে দেয় আমি খুব কষ্ট পাবো। আমার ছেলেবেলা আমি কখনও হারিয়ে ফেলতে চাইনা।
যাইহোক, ঈদের চাঁদ দেখা যাবার পর পরের দিনটির জন্য মায়ের তোড়জোড়,ব্যাস্ততা।কিচেনে বাটা মশলার গন্ধ। কাজিনরা মিলে মেহেদী লাগানো।পরদিন সকালে ঘুম ভেঙেই সবখানেই ভরপুর উৎসবের আনন্দে ভরা একটা অন্যরকম আমেজ। বিছানায় নতুন চাদর, বসারঘরটি পরিপাটি, ফুলদানীতে তাজা ফুল।খাবারটেবিলে নতুন টেবিলক্লথ, তুলে রাখা ভালো বাসনপত্র।সবকিছু এত ভালো লাগতো!!!
এত বছর পরেও সেই ভালোলাগার স্মৃতিটুকুর জন্যও মনেমনে মায়ের উপরে কৃতগ্গতায় মনটা ভরে ওঠে। আমার মা ছিলেন খুবি সৌন্দর্য্যবিলাসী একজন মানুষ। হয়তোবা তার সৌন্দর্য্যবিলাস দেখেই আমি খুব ছোটো থেকেই হয়ে উঠেছিলাম সুন্দরের পূজারী। একটু বড় হবার পর যখন ক্লাস সেভেন এইটে পড়ি তখন নিজেই সাজিয়ে তুলতাম বাড়ীঘর আমার চারিদিক।
ঈদে নতুন জামা জুতো, চুড়ি,মালা দুল এসব তো অপরিহার্য্য। বিশেষ করে মেয়েদের বেলায় তো ঈদের অনেক আগে হতেই এসব রিতীমত জল্পনা, কল্পনার বিষয়।লুকিয়ে রাখায়, হিংসুটিপনায় আমার জুড়ি ছিলোনা।কাজেই আমার সাথে সমবয়সী বন্ধুদের, কাজিনদের বিশেষরকম মনোমালিন্য হয়ে যেত। আবার সবশেষে ঈদের দিন সবাই সবকিছু ভুলেই গলাগলি মিলে যেতাম।
সকালে উঠে গোসল, তারপর নতুন জামা জুতো, সাজুগুজুতে নিজেকে সাজিয়ে তোলা। মা সবসময় ঈদের সকালটিতে নতুন নতুন মজাদার খাবার তৈরীতে ব্যাস্ত থাকতেন। সেসব দিয়ে ভুরিভোজন শেষে আমরা বেড়াতে বেরুতাম। দলবেঁধে কাজিনরা মিলে। আমাদের লিডার ছিলেন আমাদের ছোটচাচা। উনি মাইক্রোবাসের সামনের সিটে বসতেন আর আমরা সবাই পিছে। আমাদের বাসাটাকে বলা যেত মেয়েদের গোডাউন। একবার একটা ছেলে টিজ করে এই উপাধী দিয়েছিলো।
যাইহোক সারাদিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে সকালের সাজুগুজুতে বিকালে ঘেমে নেয়ে ভুত হয়ে বিকালে বাসায় ফিরেই শুরু হত ঈদের অনুষ্ঠান দেখা। ঈদের নাটক, ঈদের আনন্দমেলা। ভাবতেই কি রকম এক ভালোলাগার আবেশ ছড়িয়ে পড়ছে। লিখতে গিয়ে সত্যিই ফিরে যাচ্ছি সেই ছেলেবেলায়।
একটা নাটক ছিলো আমজাদ হোসেনের রমজান আলী যার নায়ক । প্রতিঈদে ধারাবাহিক ভাবেই ফিরে ফিরে আসতো সেই রমজান আলী।এই নাটকের একটা ডায়ালগ মনে পড়ে মাঝে মাঝে। রমজান আলীর মা একবার ইংলিশ শিখেছিলো। তো "রমজান আলী ইজ মাই সান" কথাটাকে সে বললো রমজান আলী মরিচ আন। মাঝে মাঝে স্কুলে বাচ্চাদেরকে ইংলিশ আর বাংলিশ মিলিয়ে এই রকম কিছু কথা বলতে শুনে আমার রমজান আলীর মায়ের এ কথাটাই মনে পড়ে।
যাই হোক নাটক , ঈদের অনুষ্ঠান এসব দেখার ফাঁকে ফাঁকেই আত্নীয় স্বজনের আনাগোনা, তাদেরকে আপ্যায়নে মায়ের ব্যাস্ততা সবকিছু নিয়ে ঈদের দিনটি যখন শেষ হয়ে যেত প্রতিবারই মনটা খারাপ হয়ে যেত ঠিক রাত ১২টায়। যখন টিভিটা অফ হয়ে যেত। টিভির সুইচটা অফ করার সাথে সাথেই মনে হত ঈদের আনন্দটা দপ করে নিভে গেলো।
এখনও ঈদ মানে আনন্দ। নতুন শাড়ী , জামা,জুতো মেহেদী সাজুগুজু। শুধুই দিন গুলো পাল্টে গেছে। ভালোলাগারাও হয়তোবা। আগে মা কিনে আনতেন জামা জুতো, আত্নীয় স্বজনেরা দিতেন নানারকম উপহার । এখন নিজেই কিনে ফেলি নিজের জন্য পছন্দমত, ইচ্ছে মত যা খুশী তাই। আত্নীয় স্বজনের উপহার এখনও আছে।
এখন ঈদে নিজেই শখ করে রান্না করি দু একটা ডিশ। আমাদের সংসার আমার আর ফুপীর। মায়ের সাথে থাকিনা আমি বেশ কয়েকবছর। মায়ের বাসা আত্নীয় স্বজনের বাসায় ঘুরে আসি। কলিগদের বাসায় আর দু একজন বন্ধুদের বাসায়ও যাই। দলবেঁধে ঘোরা হয়না।সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যাস্ত। মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ কোনো বাসায় সেমাই এর চেনা স্বাদে , বা ডিমের হালুয়ার রংটা দেখে বা হাড়ি কাবাবের ঘ্রানে অনেকঅনেক দিন আগে ফেলে আসা ছেলেবেলায় ফিরে যাই আমি। মনটা কেমন যেন ব্যথাতুর হয়ে ওঠে। ভাবি যেভাবেই থাকি, যেভাবেই কাটুক আমার শৈশব, আমার কৈশর। আমি কেনো বড় হয়ে গেলাম???
কাল ঈদ
ঈদ উপলক্ষ্যে দেওয়া আমার মেহেদী নক্সা
এখন আমি অনেক বড় তাই নিজেই প্রিয়জনদের জন্য কিনি উপহার। বেশী ভাগ সময় নিজে হাতে বানিয়ে দিতেই ভালোবাসি।এবারে প্রিয়জনদের তালিকায় যোগ হয়েছে ব্লগের মানুষগুলোও । ভার্চুয়ালী তাদেরকে গিফট দিলেও এই অপরবাস্তবের উল্টোপিঠের বাস্তব জগতেই আমি এবার এই ব্লগেই পাওয়া আমার এক খুব প্রিয় ভাইয়াকে নিজে হাতে বানিয়ে দিয়েছি এই পান্জাবীটা।
আঁকার পরে
এমব্রোয়ডারীর পরে
পুরো পান্জাবীটা।
যে ভাইয়াটাকে বানিয়ে দিলাম এ পান্জাবীটা, তিনি ১৪ বছর ঈদে নতুন কোনো পোষাক পরেননি। তার সে শপথ ভঙ্গ করে দিয়েছি আমি।আমি চাই আমার এই প্রিয় ভাইয়াটার কাছে থাকুক এই অদেখা ছোটবোনটার ক্ষুদ্র উপহারটুকু।
সবাইকে জানাই ঈদের শুভেচ্ছা!! যে যেখানে আছে আনন্দ উচ্ছাসে ভরে উঠুক তাদের ঈদের দিনটির প্রতিটি মূহুর্ত!!!।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




