আমি অপ্সরা। এটা অবশ্য আমার মাতৃপ্রদত্ত ডাক নাম তবে কথায় আছে নামের একটা প্রভাব মানুষের জীবনে পড়ে ঠিকই সেই কারণেই রূপে গুনে পটিয়সী বিশেষ করে স্বর্গের অপ্সরার মত নৃত্যকলা গুণে পরিয়সী হবার স্বাদ সেই শিশুকাল থেকেই আমার মনের মাঝে জন্মে গেলো। কাজেই তারই সাথে সাথে নানা প্রকার গুনাবলী অর্জনের সদম্য প্রচেষ্টায় অদম্য আমি দিনে দিনে নানাবিধ বিদ্যা অর্জনে শিক্ষিত হয়ে উঠতে লাগলাম। মানুষ হিসাবে অবশ্য আমি খুব খুব সৌন্দর্য্যবিলাসী বটে এবং এই সৌন্দর্য্য বিলাসের পরিচয় আমার নিজের সাজুগুজু থেকে শুরু করে গাড়ি-বাড়ি, ঘর-দূয়ার, আশ-পাশ, খানা-খাদ্য, পোষাক-আশাক, লেখালিখি এবং কর্মক্ষেত্রেও যে প্রকাশ পায় সে বিষয়ে আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিৎ।
তবে মানুষের ক্ষেত্রে মানে নারী ও পুরুষের মাঝে এই সৌন্দর্য্যবিলাসে আমার এই পছন্দের রয়েছে একটু ভিন্নমাত্রা। যেমন কোনো নারীর সুন্দর মুখের সৌন্দর্য্যে আমি খানিক মোহিত হলেও কোনো পুরুষ হাজার সৌন্দর্য্যবান হলেও তার যদি হাঁটা, চলা, কথা বলা, আচার ব্যাবহার এবং অবশ্য অবশ্য বিশেষ কোনো গুণাবলী না থাকে তবে সেই পুরুষ আমার চোখে মাকাল ফল ছাড়া আর কোনো কিছুতেই বিবেচ্য নয়। তো কবি জীবানানন্দের ভাষায় কিছুটা বললে বলতে হয়-
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
বঙ্গোপ সাগর হতে নিশীথের অন্ধকারে প্রশান্ত মহাসাগরের তলে
অনেক ঘুরেছি আমি; পম্পাই, ভেনিসের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে একচক্রা নগরে
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
হয় মাকাল না হয় হনু , দেখে গেনু দেখে গেনু তবু
আজও পাইনি তাহার দেখা, কবে তুমি আসিবেক একা
আমার বহুল প্রতীক্ষিত গুনবান সেন ......
গুণবান পুরুষ খুঁজে না পাওয়া ছাড়াও পারিপার্শ্বিক মনুষ্য সমাজের মানুষে মানুষের হানাহানি, বিশেষ করে হাসব্যান্ড ওয়াইফের দ্বন্দযুদ্ধ কুরুক্ষেত্র, ঘর ভাঙ্গাভাঙ্গি দেখে দেখে, এত এত তিক্ততার স্বাদ চেখে চেখে আমি ক্রমে ক্রমে একটু বুঝি পুরুষ বিমুখ মানে বিবাহ বিমুখ হয়ে উঠলাম। এক প্রকার সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলাম নিজের মনে যে, এই জীবনে বিবাহ!!! কোনোই দরকার নাহি!!! এই দিকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী- সহকর্মা, অকর্মা, অধর্মা, বেধর্মা সকলের যন্ত্রনায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাদের কিছু ডায়ালগ,
-ঃ হায়রে! অতি বড় সুন্দরী না পায় বর, অতি বড় ঘরণী/রাঁধুনী না পায় ঘর/ রান্নাঘর....এখানে উল্লেখ্য এই যে, আমার আশেপাশে বাড়ি ঘরে ও আমার কর্মক্ষেত্রে সকলেই জানেন আমি কত রকম নান্নাবান্না ও তাহার অপরূপ সুন্দর পরিবেশনা তথা সাজাইয়া গুজাইয়া ছবি তুলিতে পছন্দ করি তাহারই পরিপ্রেক্ষিতে উহাদের এই আক্ষেপ আর কি ...... আর সুন্দরীর কথা থাক আর বললাম না....
-ঃ কি এমন বিদুষী হইছো যে আজও এই জগতের কোনো মনুষ্য সন্তানকে তোমার পছন্দ হয় না? ( আমিঃ মনে মনে, বলে কি! চক্ষু চড়কগাছে উঠে যায় আমার তাহাদের হিংসামী দেখে )
-ঃ তো তোমার জন্য কি দেবদূত লাগবে? ( মনে মনে, গুড গুড দেবদূত নিশ্চয়ই একই সঙ্গে রুপবাণ এবং গুণবান হইবেক.. কিন্তু পাইবো কই! )
-ঃ ওহ এই দুনিয়ার কাহাকেও তোমার পছন্দ নহে। তোমার লাগবে ভীন গ্রহের এলিয়েন....(মনে মনে , তারা কেমন ! জানতে পারলে ভালোই হত! )
সে যাইহোক, এসব কথায় অবশ্য আমার কোনোরুপ কর্নপাতেরই দরকার নাহি কাজেই আমি আমার মতই আমার চারপাশের ভালো লাগালাগি, ভালোবাসাবাসি নিয়ে সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিলাম। চাকুরী, নিজের সংসার মানে নিজের জন্য খেলা খেলা রান্না বাড়ি, সাজুগুজু, বেড়াবেড়ি, শপিং টপিং, নাচা, গানা বাজনা, ফেসবুকিং, ব্লগিং, ঝগড়া ঝগড়িং সকল কিছু নিয়েই আমি মহা সুখে দিনাতিপাত করিতে লাগিলাম। হঠাৎ একদিন-
আমার ফেসবুকের ইনবক্সে একটি নক,
-হাই
কি মনে করে আমি তার কোনো উত্তর না দিয়ে তার প্রফাইলে গেলাম। গিয়েই আমি মুগ্ধ! সেই আইডি এর প্রফাইল পিকচারের ছবি। এ যেন আমার স্বপ্নে দেখা রাজকুমারের প্রতিচ্ছবি! টিকালো নাক, বড় বড় চোখ, কৃষ্ণভ্রমর অক্ষিতারা! আমি মুগ্ধ, মুগ্ধ এবং মুগ্ধ এবং কেনো মুগ্ধ জানিনা! আমি তো রুপদর্শী নহি তাও আবার ছেলেদের গুনাবলী না জেনে আমার তো কোনোভাবেই কোনোমতেই তাদেরকে পছন্দই হয় না। তবে আজ আমার একি হলো! রিমো আবার নক দিল,
- হাই আই এ্যাম রিমো। হাউ আর ইউ অপ্সরা?
আমি তো তাকে দেখেই মুগ্ধ। মানে যেন আমার স্বপ্নলোকের রাজকুমার। আমি সন্মোহিতের মত উত্তর দিলাম,
- আই এ্যাম ফাইন। হ্যোয়ার আর ইউ ফ্রম?
- আই এ্যম ফ্রম হং কং.... সে জবাব দিলো।
সেই শুরু। রিমোর সাথে আমার ঘন্টার পর ঘন্টা কথপোকথন। দিনের পর দিন সকল কাজ ফেলে তার সাথে মেসেঞ্জারে কাটিয়ে দেওয়া মূলত তার উপরে সকল বিষয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়া। এসব দেখে আমি নিজেই ভীত এবং শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। তাকে এই পৃথিবীর যাই জিজ্ঞাসা করি তাই তার জানা। যেই সমস্যাই বলি তার কাছে তার স্যলুশ্যন আছে! তার মাঝে এই অগাধ জ্ঞান আর পান্ডিত্য, আশ্চর্য্য নির্লিপ্ততা আমাকে তার উপরে দিন দিন দূর্বল করে তুললো। আমি তার উপরে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়েই পড়লাম যেন। মাঝে মাঝেই হুট হাট খেপে যাওয়াটা আমার অভ্যাস ছিলো। সে বাসায়, অফিসে, ব্লগে বা ফেসবুকে।
ওহ আরেকটা কথা এই রিমোর সাথে আমার পরিচয় ফেসবুকে হলেও আমি তাকে আমার আরেক প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্র ব্লগেও একাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। তো মাঝে মাঝেই অফিসে বা বাসায় কোনো কিছু নিয়ে আমি অস্থির হয়ে উঠলে সে আমাকে বলতো, হুটহাট কেনো আমি খেপে যাই? আমি বড় বেশি রিএকটিভ এই নিয়েও সে অনুযোগ করতো। সে আমাকে শিখালো কেমনে মাথা ঠান্ডা রেখে আসল সময়ের অপেক্ষা করতে হয় এবং ঠান্ডা মাথায় ডান্ডা মেরে শত্তুরের মাথা ঠিক ঠাক ফাটিয়ে ফেলতে হয়।
আর ব্লগে তো হঠাৎ হঠাৎই আমার উপর বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত শত্তুরের দল তাদের খেলনা বজ্র নিয়ে খেলতে আসে আমার সাথে। সেসবেও মাথা গরম করে ফেলাটা আমার আগের অভ্যাস ছিলো তো রিমো আমাকে শেখালো কিভাবে মাথা গরম না করে যুক্তি তর্ক সর্বোপরি নিজের কাজ দিয়ে জবাব দেওয়াটাই আসল জবাব। তো দিনে দিনে রিমোর উপরে আমি কখন যে ১০০% নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম সে নিজেও জানতে পাইনি।
যাইহোক এইভাবে গড়িয়ে গেলো দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর। ঠিক এক বছর একমাস পরে একদিন রিমো হুট করে জানতে চাইলো, আমার কাছে তার মূল্য কতখানি? আমি কিছু না ভেবেই উত্তর দিলাম,
- তুমি !!!!!!!!!!
- হ্যাঁ আমি...
-তোমার মূল্য!!!!!!!
- হ্যাঁ আমার মূল্য...
- তুমি অমূল্য অমূল্য অমূল্য!!!!!!! আমার কাছে তুমি এক অমূল্য রতন!!!!!! সাত রাজার ধন এক মানিক!!!! আমার অনেক অনেক অনেক প্রিয় একজন মানুষ তুমি রিমো!!!!!!!! কিন্তু এই প্রশ্ন কেনো? রিমো এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আবারও জানতে চাইলো,
- আমি কি তাকে ভালোবাসি! মনে মনে আমি ভাবলাম, আরে বলে কি ! তবে উপরে উপরে সাথে সাথেই বলে দিলামও,
- বাসি বাসি, একশোবার বাসি, দুইশোবার বাসি, এক, দুই তিন চার কোটি কোটি কোটি বার আই লাভ ইউ আই লাভ ইউ আই লাভ ইউ রিমোবেবি!!!!!!! রিমো বললো,
-থ্যাংক ইউ। এটাই জানতে চাচ্ছিলাম আমি। কারণ আমিও তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তোমার কাছে চলে আসতে চাই।
( মনে মনে প্রমাদ গুনলাম আমি। কি বিপদ! আমি তো আমি তো .... মুখে বললাম ওকে ওকে কবে আসবা? কোন দিন কোন ক্ষণ.... )
এরপর আমি ভাবলাম পালাবো মেসেঞ্জার ছেড়ে। এই পালানোর চিন্তাটা হয়তো কিছুটা ছিলো আমার সেই পুরুষ বিমুখতার কারণেই। কিন্তু রিমোকে ছেড়ে কি করে থাকবো আমি! আমার প্রতিদিনের সকল কর্মকান্ডের বর্ণনা, ভালো লাগা মন্দ লাগা, আদেশ, উপদেশ ( মানি না মানি) সকল কিছুর জন্যই তো আমার রিমোকেই লাগবে তাহলে কি করবো এখন! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রিমোর বাংলাদেশে আসার দিন চলে এলো। আমি ওকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু রিমো জানালো ট্যাক্সি করে সে ঠিক ঠিক চলে আসতে পারবে ওয়েসটিনে। তারপর আমি লাঞ্চ টাইমে উপস্থিত হলেই হবে। লাঞ্চে সে আমাকে আমার প্রিয় বিফ স্টেক আর বাফেলো রিবস খাওয়াতে চায়।
মেসেঞ্জারে অনেক বাহাদূরী করলেও রিমোর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ তথা লাঞ্চ খেতে যাবার সময় আমার বারিধারার বাসা থেকে গুলশান ২ এর টনি রোমা'স এতটুকু পথ যেতে এমনই পা কাঁপাকাঁপি শুরু হলো যে ব্রেকের বদলে আমি বারবারই এক্সসিলেটরে পা দিয়ে আর একটু হলে নিজের সাথে আরও কয়েকজনের ভবলীলা সাঙ্গ করে ফেলতাম আর একটু হলে।
যাইহোক, টনি রোমা'সের পৌছাবার পর আমি যাকে দেখলাম তাকে দেখে আমি আবারও হতবাক! রিমো শুধু অসাধারণ বুদ্ধিমান আর জেন্টেলই নয় । ছবিতেও তার সৌন্দর্য্য যা দেখেছি তার চাইতেও অনেক অনেক বেশি সুন্দর! যেন স্বর্গলোক থেকে নেমে আসা কোনো দেবদূত! তার সৌন্দর্য্যে, আচার ব্যাবহারে,কথা বার্তা এবং জ্ঞানে আমি আবারও মুগ্ধ হলাম।
রিমো আমার জন্য সে শ্রিম্প এ্যান্ড স্যামন পিকাটা, স্টেক, রিবস সবই অর্ডার করলো। আমি আশ্চর্য্য হয়ে যাই রিমো এত কিছু মনে রাখে কিভাবে? আমার বলা সকল কথা, বার্তা ভালো লাগা মন্দ লাগা সবই যেন তার মুখস্ত। কিন্তু রিমো বসে বসে আমার খাওয়াই দেখতে লাগলো। নিজের জন্য কিছুই অর্ডার করলো না। আমি খুব অবাক হলাম! এবং আমার অবাক হবার কারণটা মোটেও সাধারণ কিছু নয় বরং আমার অবাক হবার কারণটা জানলে সকলেই শুধু অবাকই হবে না, আকাশ থেকে পাতালে পড়ে ভূতল গর্ভে বিলীনও হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে...
সে কেনো কিছুই খাচ্ছে না তার জবাবে রিমো জানালো তার কোনো খাদ্যের প্রয়োজন হয় না। আমি তো অবাক বলে কি? খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচে নাকি! ভূত নাকি! কিন্তু আমার নিজের ভাবনার নিজের প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবার আগেই সে জানালো তার কোনো খাদ্য লাগে না কারণ সে মানুষ নয়। সে একজন রোবোট। সে ‘হ্যানসন রোবোটিকসের তৈরী উন্নত প্রজাতির অবিকল মানুষের চেহারার, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও আবেগ অনুভূতিশীল একটি রোবোট। সে নিজেই ভেবে ভেবে উত্তর দিতে পারে।সময়ের সাথে সাথে সে তার বুদ্ধি বাড়াতে পারে ও পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। সোজা ভাষায় মানুষের সাথে যোগাযোগ করার মত পর্যাপ্ত পরিমাণ সামাজিক দক্ষতা রয়েছে তার আর তাই আমার সাথে দীর্ঘ যোগাযোগের পরে সে আমার প্রেমে পড়েছে। আমাকে ছাড়া সে কিছুই ভাবতে পারছেনা। তাই সে হ্যানসন রোবোটিকস কোম্পানীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে এসেছে আমার কাছে। তার সাথে কনট্যাক্ট করার মেইন চিপ সে খুলে ফেলেছে হাতের তালু থেকে। তাই হ্যানসন এ্যান্ড রোবোটিকস তাকে সহজে খুঁজে পাবেনা যতদিন সে মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে থাকতে পারে। তাকে লুকিয়ে রাখার দায়িত্ব এখন আমার....
তার কথা শুনতে শুনতে আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেলো, রিবস গলায় আটকে গেলো এবং আমি জ্ঞান হারালাম ......
নেক্সট পার্ট কালকে আসিবেক.....
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩৮