সেইদিনের পর থেকে আমার যে কি হলো! আমি আর সেই আগের আমি রইলাম না। হয়ে উঠলাম পুরোই আরেক আমি। আমার দুপদাপ চলাফেরা, হাউ মাউ চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করা বলতে গেলে প্রায় নাই হয়ে গেলো। ঐ রকম ডানপিটে টাইপ আচরণ কমে এসে আমি হয়ে উঠলাম এক অন্য আমি। কিছুটা শান্ত সুবোধ এবং আনমোনা। আসলে আমি তো সারাক্ষণ এক বাড়ি মানুষের মাঝে বসে বা পড়ার টেবিলে একাকী বসে শুধু সেই ভোরের বেলাটাকেই তখন ভাবছি। আয়নার বার বার নিজের চেহারা দেখি আর লাল হয়ে উঠি। নিজেকেই প্রশ্ন করি, নীরু তুই এত সুন্দর কেনো! হা হা (কেউ কিন্তু হাসবা না এখানে এই কথা পড়ে) যাইহোক বাড়ির সকলে খেয়াল না করলেও মা কিন্তু ঠিকই খেয়াল করলেন। সেটা আমিও খেয়াল করলাম। মা আমার দিকে কেমন সন্দেহের চোখে তাকায় মাঝে মাঝেই। আমি অন্য দিকে চোখ সরিয়ে চলে যাই। একদিম দুপুরে মা বললেন, তোর কি হয়েছে রে! আমি বললাম কি হবে আবার! কিছুই হয়নি। মুখটা একদমই করুন ভালোমানুষ বানিয়ে বললাম যদিও তবুও মায়ের কি আর সন্দেহ যাবে! মা তক্কে তক্কে রইলেন। আমিও পাতায় পাতায় মানে আরও সাবধানী হয়ে রইলাম।
তবুও ধরা পড়লাম। মানে একদিন বিকেলে, সেদিন স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠান। আমরা সবাই শাড়ি পরেছিলাম। তো আমার তো কোনো শাড়ী ছিলো না। সবই মা আর চাচীদের শাড়ি। আবার সব চাচীদের সব শাড়িগুলিই বেশিভাগ এক রকম ছিলো। ঈদ পার্বন ছাড়াও এমনিতে এক চাচীর আত্মীয় স্বজনও কোনো উপহার আনলে ও বাড়ির সব চাচীদের জন্যই আনতে হত। সেটাই ছিলো ও বাড়ির নিয়ম। কাজেই এতগুলো চাচী থাকা সত্বেও শাড়ির অতগুলো বৈচিত্র ছিলো না। তবুও ছোটচাচীর বাপের বাড়ি থেকে বিয়ের সময় পাওয়া এক লাল টুকটুক জরিপাড় শাড়ি আমার খুব পছন্দের ছিলো। তাই সেটাই আমাকে পরিয়ে দিলো চাচীআম্মা। সাথে কপালে টিপ আর লাল লিপস্টিক। বিয়ের আগে যদিও ও বাড়ির কোনো মেয়ের লিপস্টিক লাগাবার অনুমতী ছিলো না তবুও সেদিন ঐ অনুষ্ঠান উপলক্ষে অনুমতী দেওয়া হলো। মানে ছোটচাচীই জোর করে রাজী করালেন মাকে। তো সেই শাড়ি পরে লাল টুকটুক লিপস্টিক আর টিপ সাথে ছোট চাচীর গহনার বাক্স হতে সরু মালা আর বালা এবং ছোট্ট পিচ্চি একটা অপরূপ ঝুমকা এসব পরিয়ে দিলো চাচী নিজেই।
সেই সাজ সেজে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই লজ্জায় শেষ আমি। আর চাচীমা বললেন, একদম একটা ছোট্ট নতুন বউ এর মত লাগছে তোকে। এত সুন্দর হয়েছিস তুই! আমি লজ্জায় লাল হয়ে বললাম। ধ্যাৎ কই সুন্দর! কি বলো তুমি! কিন্তু মনে মনে আড়চোখে চেয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেকেই নিজে বললাম। নীরু তুই যে এত সুন্দর!!! হা হা আর তারপর এই সাজ কি খোকাভাইকে না দেখিয়ে চলে যাওয়া যায়! সে কি সম্ভব হত কারো জন্য! কখনই না। কিন্তু কি করে যাবো! তখন বিকেল বেলা। চাচী আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছিলেন আর মা খাঁটে বসে বসে দেখছিলেন।এত লিপস্টিক দিও না এত কাজল না, শুধুই না আর না করেই যাচ্ছিলেন তবুও ছোটচাচী তেমন মায়ের কথা গ্রাহ্য করছিলেন না। যাইহোক সাজ শেষ হলো। একটু পরেই বের হয়ে যেতে হবে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, হায় হায় আমার লাল রং স্যান্ডেল তো ছাঁদে রোদে দিয়েছিলাম। এখুনি নিয়ে আসি বলেই দৌড় দিলাম ছাদের ঘরে।
খোকাভাই তার ঘরের মধ্যে জানালার সামনে চেয়ারে বসে আলসেতে পা তুলে কি যেন একটা মোটা বই পড়ছিলো। আমি চুপি চুপি গিয়ে আস্তে করে পিছে দাঁড়িয়ে দুই হাতে তার চোখ চেপে ধরলাম । খোকাভাই কিছুই বললো না, কারণ সে তো জানেই এইভাবে তার চোখ ধরার লোক এই বাড়িতে শুধু একজনই আছে। ঘুরেই জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমি পড়তে পড়তে ছেড়ে দিলাম চোখ। আর খোকাভাই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আজকাল জি সিরিয়াল স্টার জলসায় এইভাবেই ক্যামেরা থমকে গিয়ে এক ঘন্টা ধরে একেকজনের চেহারায় ক্যামেরা আটকে থাকে। আর সাথে ঢিং ঢং ঢিং ঢং করে মিউজিকের দামামা বাজে। আমাদের সেসব দিনে কোনো সিরিয়াল ছিলোনা বটে তবে সেই মুহুর্তে খোকাভায়ের চোখও জি সিরিয়ালের ক্যামেরা হয়ে আটকে রইলো আমার চোখে। কতক্ষন মনে নেই আমার বা সময় গুনিনিও আমি বা দেখিনিও সেই দৃশ্যপট কয় মিনিট কয় ঘন্টা বা কয় সেকেন্ড ছিলো।
নীচে ফিরেই দৌড় লাগালাম স্কুলের উদ্দেশ্যে। তার আগেই ধরে ফেললেন মা। দেখি দেখি, তোকে না চাচী ওমন গাঢ় করে লিপস্টিক লাগিয়ে দিলো! লিপস্টিক কই গেলো! আমার হাত চেপে ধরে রইলেন মা। চোখ থেকে তার আগুন ঝরছে। আমার বুকের ভেতরে তখন হাতুড়ির বাড়ি। কি উত্তর দেবো খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেজচাচা বাইক নিয়ে বাইরের গেট থেকে হর্ণ দিচ্ছিলেন। নীরু মা তাড়াতাড়ি আয়, আমার দেরী হয়ে যাবে তো বার লাইব্রেরীতে মিটিং আছে। চাচা বিরক্ত হয়ে উঠলেন, নীরু কতক্ষন লাগাবি! চল তাড়াতাড়ি। সেই কথা শুনে মায়ের হাত শিথিল হয়ে এলো। হিস হিস করে রাগে বললেন, এখন যা, কিন্তু ফিরে আসার পর বুঝাবো তোকে কত ধানে কত চাল! ভয়ে কাঁটা হয়ে উঠলাম আমি। কি জবাব দেবো! কি বলবো! কি করবো! কি হবে আমার! কি হবে খোকাভায়ের! এসব নানান প্রশ্ন মাথায় নিয়ে সেজোচাচর বাইকের পিছনে গিয়ে উঠলাম।
পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে আমার মন খারাপ হয়ে রইলো। দুশ্চিন্তা আর ভয়ে কোনো কিছুতেই মন বসছিলো না আমার। পপলী আপু যখন গান গাইছিলেন যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেনো মনে রাখো তারে! সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো আর আমি! মাথায় শুধুই মায়ের শাসানী। বাড়ি ফিরলে গুনাবেন কত ধানে কত নাকি চাল! অনুষ্ঠান শেষ হতে সন্ধ্যা পেরিয়ে প্রায় রাত হয়ে গেলো। আমি বিধাতার কাছে মনে প্রাণে প্রার্থনা করছিলাম, খোদা যে কোনো মূল্যে মায়ের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও। খোদা আমার ডাক ঠিকই শুনেছিলেন। এমনই ভাবে যে সেই ডাক না শোনাই আমার জন্য আসলে মঙ্গল ছিলো সেদিন।
অনুষ্ঠান শেষে সেজোচাচাই আমাকে নিতে এসেছিলেন। আমার ওমন গোমড়া মুখ দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কিরে এত দিনের স্কুল ছেড়ে যাচ্ছিস তাই মন খারাপ বুঝি! আমি কিছু বললাম না। সেজোচাচার বাইকের পিছে গিয়ে উঠলাম। আমাদের ঐ মফস্বল শহরের রাস্তাগুলি তখন এত আলো ঝলমলে ছিলো না। ল্যাম্পপোস্টের মিটমিটে আলো আর মানুষ-জনের বাড়ি ঘরের আলোগুলিই ছিলো রাতের পথিক বা যানবাহনের চলাচলের একমাত্র দিশারী। যদিও সেজোচাচার বাইকের আলোয় পথঘাট পরিষ্কারই দেখাচ্ছিলো। তবুও সে দিনটির কথা মনে হলে আমার কেনো যেন অন্ধকার এক নিশুথী রাতের কথাই মনে হয়। হয়ত আমার সেদিনের ভীতিটাই আমার ফেলে আসা অতীত স্মৃতিচারণের অপ্রত্যাশিত ভীতিকর পরিস্থিতিটুকু বুঝাতেই ওমন দৃশ্যের জন্ম দেয় আমার মনে।
যাইহোক সেজোচাচার বাইকে করে ছুটে যাবার মাঝে কিছু মন্থর গতীর সময়টুকুতে উঁকি দিচ্ছিলো কারো কারো বাড়ির জানালার পর্দা ফুড়ে নানা রকম দৃশ্য। আজ যখন সে সব মনে পড়ে তখন ভাবি সেই দৃশ্যগুলিতে এত মায়া ছিলো কেনো! সত্যিই সে কথা আজও ভেবে পাই না আমি। কই আজকের এই পৃথিবীতে ওমন মায়াগুলি তো আর চোখে পড়ে না। সবাই বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। বদলে গেছে মানুষ, পাড়া, শহর আর গ্রাম। সত্যিই আজও ভেবে পাইনা আমি। প্রায় প্রতি বাড়িতে সন্ধ্যার পর পড়ার টেবিলে ছেলেমেয়েরা পড়তে বসেছে। কেউ কেউ চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে পড়ছে। কেউ কেউ চুপচাপ মনে মনে। তবে চুপচাপ মনে মনে পড়ার চাইতে সেই চেঁচিয়ে পড়ার শব্দই বুঝি সেদিনের বাবা মায়ের প্রাণে শান্তির বানী শুনিয়ে যেত। সেই তীব্র চিৎকারে পাড়া পড়শীর শান্তি হরণ করা কর্মকান্ডটিই যেন ছিলো বাবা মাসহ পাড়াপড়শীরও সকলেরই শান্তির কারণ এবং সেটাই যেন খুব স্বাভাবিক। এত শত শব্দ দুষন, প্রাইভেসী, দরজা জানালা বন্ধ এসি রুম ছিলো না তখন একেবারেই।
খোলা জানালার পর্দার ফাঁকে ফাঁকে তখন কোনো কোনো বাড়িতে বাড়ির কর্তা বা বৃদ্ধ ব্যক্তিটি টিভি খুলে বসেছে। সাথে বাড়ির দু একজন মহিলাও আছেন কিন্তু প্রায় কোনোবাড়িতেই সেই সন্ধ্যা রাত্রীরে কোনো ছেলেমেয়েদের বোধ হয় টিভি দেখার অনুমতী ছিলো না। স্কুল কলেজ এমনকি ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীরাও মনে হয় সে সময় কেউ ৯টা বা ১০টার আগে টিভি দেখার অনুমতী পেত না। সেজোচাচার সাথে ঐ সন্ধ্যা পেরুনো রাতটিতে আমার মনে পড়ে আমাদের পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় যে সব ছোট ছোট চা সিঙ্গাড়ার দোকান ছিলো। সেসব দোকানে অফিস ফেরৎ লোকজনের জটলাগুলি। ঐ সব পান চা সিগারেটের দোকানে রেডিও চলতো অবিরাম আর সেসব ঘিরে বসে থাকতো কর্মফেরৎ কিছু মানুষ। সেজোচাচার সাথে বাইকে করে ফেরার সেই রাতটি আমার জীবনের ভীষন রকম স্মৃতিকাতর এক রাত। যে রাতটিকে বড় বেশি মনে পড়ে আমার প্রায়ই।
সেদিন মনে হয় অমাবশ্যা ছিলো। ছোট গলিটিতে ছিলো ঘুরঘু্ট্টি অন্ধকার। হিরু স্যুইপার মদ খেয়ে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছিলো। চাচার বাইকের সামনে এসে প্রায় পড়ে পড়ে। চাচা বাধ্য হয়ে কড়া ব্রেক কষলেন এবং হিরুকে জোরসে এক ধমক লাগালেন। সেই ধমকে হিরু গান থামালো বটে তবে তার মুখ ছুটে গেলো, ছালা, তুমি কে হে ছালা! কোন নবাব সিরাজ আইছো হে! আমারে ধমকাও! তোমার টেংরি ভাঙ্গবো ছালা। যদিও মাতাল মানুষ আমার অনেক ভয় লাগে। কিন্তু মাতাল হয়ে নির্দ্বিধায় ওমন করে সেজোচাচাকে ছালা ছালা বস্তা বস্তা বলা দেখে আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি আর একটু হলে আরকি। আর টেংরি কি জিনিস! আজও তার উত্তর জানিনা আমি। তবে আমার কাছে মনে হয় টেংরি মাঝে ঘাড় টাড় কিছু একটা হবে।
দূর থেকে কি রকম এক আজব গন্ধ আসছিলো। গন্ধটা পরিচিত তো নাই বটে কেমন যেন নাড়িভূড়ি উলটে আসা গন্ধ! আমার ভয় লাগছিলো। ভূত প্রেতের গন্ধ নাকি মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করছিলাম। শেষে চাচাকে জিগাসা করতেই চাচা বললেন এটা নাকি শুয়োর পোড়ানো গন্ধ! সেই কথা শুনে তো আমার চক্ষু চড়কগাছ! শুয়োর কথাটা উচ্চারণ করাই নিষিদ্ধ ছিলো আমাদের বাড়িতে সেখানে সেই কথাটা উচ্চারণের সাথে সাথে চাচা বলছেন কারা আবার সেসব পোড়াচ্ছেও! আমি অবাক বিস্ময়্ব জানতে চাইলাম, কে পোড়াচ্ছে চাচা? চাচা বললেন কে আবার। হবে হিরু বদমাশটার বাড়ির লোকজন। কিছুদূরেই তো মেথর পট্টি। আজ ওদের কোনো ফিস্ট টিস্ট হবে। উৎসবের দিনে ওরা শুয়োর পোড়ায় আবার মদও গেলে বদমাশগুলা। এমন করে চাচা বলছিলেন যেন অনেক বড় অপরাধী ওরা। কিন্তু আসলে তো তা নয়। এই মদ খাওয়া, এই শুয়োর পুড়িয়ে বারবিকিউ বানিয়ে উৎসবে খাওয়া এসবই তো ওদের উৎসবে বৈধ ছিলো।
একটা জিনিস এইখানে না লিখে পারছি না। সেদিন রাতে ঐ বিদঘুটে গন্ধের সাথে শুয়োর পোড়ানো বারবিকিউ এর সেই আনইউজ্যুয়াল ঘটনাটা আমার মনে গেঁথে রইলো। অনেক পরে আমাদের বাড়িতে পূজার বখশিষ চাইতে আসা লছমী ঝাড়ুদারনীকে আমি জিগাসা করেছিলাম ঐ বারবিকিউ সম্পর্কে। তার কাছেই শুনেছিলাম তারা নাকি লম্বা একটা বাঁশের সাথে শুয়োরটার চার হাত পা বেঁধে আস্ত ঝুলিয়ে দেয় আরও দুইটা বাঁশের সাথে আলনার মত করে বা যেমন করে কাঁপড় মেলি আমরা তারে। তারপর তেল মসলা মাখিয়ে নীচে গনগনে আগুন জ্বালিয়ে পোড়ানো হয় সেই মাংস। তারপর সবাই মিলে চাকু দিয়ে কেটে কুটে খায়। লাছমীরা পেছন দিয়ে আঁচল টেনে এনে সামনে আঁচল ঘুরিয়ে এক অন্য স্টাইলে ঘাঘরীর মত করে শাড়ি পরতো। ওর হাঁতে কালো করে পুড়িয়ে হিন্দীতে ওর নাম লেখা ছিলো। আমি কৌতুহলে জিগাসা করেছিলাম কি লেখা সেখানে? সে বলেছিলো লাছমী লেখসি আপামনি। ইন্ডিয়া থিকে লাছমী লিখখে আনসি। সুই পুড়াই পুড়াই শরীলে লেখা দেয় দিদিমনি! সোনামনি... লছমী মাঝে মাঝে লুকিয়ে ইন্ডিয়া থেকে শাড়ি এনে বিক্রি করতে আসতো আমাদের বাসার কাজের মেয়েদের কাছে।লছমী পায়ের আঙ্গুলে অনেকগুলো রুপোর অঙ্গুঠি পরত। কানে অনেকগুলো দুল ঝুলঝুল করতো ওর। লছমী এক অন্যরকম যাদুকরী ছিলো আমার চোখে। খুব নিকৃষ্ঠ কাজ করে ও নিকৃষ্ঠ গোত্র ও বংশের হয়েও ও ছিলো এক যাদুকরী মানবী যে বাস করতো আমার অজানা অচেনা এক অন্য রকম রাজ্যে। ভীষন সুখে। যেই সুখের জীবনে ছিলো না এত বিধি নিষেধ বাধ্য বাধকতা বা ছিলো না কোনো মিথ্যে অহং।
যাইহোক সেই রাত্রীতে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই চমকালাম আমরা। মানে আমি আর সেজোচাচা। আমাদের বাসার পুরানো কাজের মানুষ রুস্তম ছুটে আসছে আমাদের দিকে। ভাইসাব ভাইসাব শেগগিরি ডাগদর আনেন। মেজোভাইর জান যাতিছে। মেজভাইর মানে আমার বাবা! বহুদূর থেকে বুঝি ভেসে এলো কথাটা কানে! কি বলছে এসব রুস্তম! আজ সকালেও তো গরম ভাত, আর ডিম আলু ডালের ভর্তা দিয়ে এক ডাবু ঘি পাতে নিয়ে ভাত খেয়ে বেরুলো বাবা। আর সন্ধ্যার মাঝে কি হলো তার!! সেজোচাচা চিৎকার করে বাইক থামিয়ে দৌড়ে ঢুকলো বাড়ির ভেতরে। আমি কিছুক্ষন স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে হঠাৎ সম্বিত ফিরে দৌড়ে ঢুকলাম।
বাবার ঘরে বাড়ির সকলে ভেঙ্গে পড়েছে। সকলের কোলাহলে ঠিক বুঝা দায় ছিলো কি হয়েছে সেখানে। আমার বুকের ভেতরে ভীষন এক ভীতির সঞ্চার হলো। কিন্তু কিছু বুঝা তো দূরের কথা ও ভীড় ঠেলে ভেতরে উঁকি দিয়েও দেখতে পারছিলাম না ঠিক কি হয়েছে সেখানে। সেই একান্নবর্তী পরিবারের সকল মানুষজনের হই হট্টগোল ভেদ করে হই হই করে পাড়ার ডক্টর নিয়ে হাজির হলেন ন'চাচা। ডক্টর আর চাচার আগমনে সকলে সরে গিয়ে পথ করে দিলো আর সেই সুযোগে আমিও ভেতরে ঢুকবার সুযোগ পেলাম। বাবা বিছানায় শুয়ে আছে। চোখ দুটি বোজা মা চাচী দাদী চাচারা সব তাকে ঘিরে। ডক্টর গিয়ে পাশে বসলো! আমি দূরে ঐ লোকজনের মাঝে দাঁড়িয়ে রইলাম। কাছে গেলাম না। ভীষন কষ্ট হচ্ছিলো আমার। মাথায় ঘুরছিলো তখন একটাই কথা, বাবা কি তবে মারা গিয়েছেন!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১০:৫৯