কাল ছিলো গায়ে হলুদ। আজ আমার বিয়ে। বলতে গেলে সারারাত ঘুমাইনি আমি। আমার জীবনের এই এতটুকু বয়সে যত রাত পার করেছি তার থেকে এই রাতটা একেবারেই আলাদা ছিলো। আমাদের মফস্বল টাউনের সেসব দিনে রাত ১১টা মানেই গভীর রাত ছিলো কিন্তু সেই রাতটাতে ১২ টা পার হয়ে যাবার পরেও রাত ২টা ৩ টা পর্যন্ত সারাবাড়িই জেগে রইলো। বিয়ে বাড়ির কাজের লোকজনের কর্মব্যস্ততার শব্দ, মুরুব্বীদের হাক ডাক, খাসী গরু জবাই এর শব্দ, পেঁয়াজ রসুন হলুদ মরিচবাটা এ সবকিছু নিয়ে বাড়ির মহিলারাও মনে হয় রাতে একেবারেই ঘুমায়নি কেউ কেউ। শুধু ছোট ছোট ছেলেপুলেদের হাকডাকই কমে এসেছিলো। দাদীমার পাশে শুয়ে ছিলাম আমি সারা রাত। উল্টোদিকে ফিরে আমি ঘুমের অভিনয় করছিলাম। আমার বন্ধ চোখের কোল দিয়ে জল গড়িয়ে বালিশ ভিঁজে যাচ্ছিলো কিন্তু কেনো বা কার জন্য তখন আমার আর সেই বোধ ছিলো না।
ভোরের দিকে মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। তবুও ভোরের বেলা দাদীমা যখন নামাজ পড়তে উঠলো, ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। জানালা দিয়ে গাঢ় নীল আকাশ দেখা যাচ্ছিলো। পাখিদের কলকাকলী ভেসে আসছিলো কানে। আমি চুপ করে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম কাল থেকে আমার আর এ বাড়ির ভোর দেখা হবে না। এই যে এ বাড়ির পেছনের বাগানের কোনো এক ঝোঁপে বসে অদ্ভুত সূরে ডাকা কানাকুয়ো পাখির এই অদ্ভূত কুপ কুপ কুপ সূর আর শোনা হবে না আমার। এই যে জানালা দিয়ে গাঢ় নীল আকাশ ক্রমে ফরসা হয়ে আসছে এই জানালার আকাশটাকে আর দেখা হবে না আমার। হঠাৎ মনে হচ্ছিলো জীবনটা বদলে যাচ্ছে আমার। বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে আসছিলো।
দাদীমার নামাজ পড়া শেষ হতে ধীরে ডাকলেন তিনি আমাকে। প্রায় তখনই মা এবং সকল চাচীরাই দাদীমার ঘরে এলেন। আমি লেপ গায়ে জড়িয়েই বিছানার উপর গুটিসুটি বসলাম। চাচীরা আমার বিয়ে উপলক্ষে নানা উপহার নিয়ে এসেছিলেন। সেজোচাচী আমার কানে পরিয়ে দিলেন অদ্ভুৎ সুন্দর এক ঝুমকা। ঝুমকাটার আশ্চর্য্য এক ডিজাইনে চোখ আটকে গেলো আমার। এর আগে যত ঝুমকা দেখেছি তা গোলাকার ঢাকনির মত আর এই ঝুমকাটা যেন পাখির খাঁচা। লম্বাটে খাঁচায় যেমন বন্দী থাকে পাখি। সেই খাঁচাগুলোর মতন। মনে মনে এই ঝুমকার একটা প্রতিকী অর্থ দাঁড়া করাই আমি আজ। এক খাঁচা থেকে নীরুর আরেক খাঁচায় প্রবেশের সংকেত বুঝি ছিলো সেই পাখির খাঁচা ঝুমকাটাই। যাইহোক অন্যান্য চাচীরা কেউ চেইন, কেউ চুড়ি এসব নানা উপহার পরিয়ে দিচ্ছিলেন আমাকে। এমন সময় সকলের আড়াল থেকে বের হয়ে এলেন বড় চাচীমা তারপর আমার সামনে এসে বসলেন। আমার হাত দুটি টেনে নিয়ে পরিয়ে দিলেন তিনি হাঙ্গরমূখী দুটি বালা। বললেন,
- অনেক কষ্টের পরেও এই বালা দুটি হাতছাড়া করিনি আমি। ভেবেছিলাম খোকার বউকে দেবো। এটা তার বাবার দেওয়া প্রথম উপহার।
তারপর অঝর ধারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন চাচীমা। আমার দুচোখ বেয়েও নেমে এলো নিঃশব্দ কান্নার ধারা। তাকে কিছু জিগাসা করা হলো না আমার তবে আমি ঠিকই বুঝলাম এক বাড়ি লোকের সামনে কেনো সেই বালা তিনি আমাকেই দিয়ে যাচ্ছেন আজ? আমাদের নিশব্দ চোখের ভাষা পড়ে নিলো একে অন্যের মনের কথাগুলি। আমরা দুজন অসম বয়সী, একই ব্যথায় ব্যথিত দুটি নারী ছুঁয়ে গেলাম একে অন্যের মনের দুঃখটুকু নিশব্দ নীরবতায়। কেউ বুঝুক না বুঝুক আমরা জেনেছিলাম সেই কান্নার মানে তবে তখন ঐ পরিস্থিতিতে না বুঝে থাকার অভিনয়টাই আমাদের ও সকলের জন্য মঙ্গলের ছিলো।
বেলা ১০টার মধ্যেই কাজী এসে গেলো। বিয়ের পড়াবার সময়টুকুতে সারাবাড়ির হইচই কমে গিয়ে নেমে এলো এক অদ্ভুত চাপা গাম্ভীর্য্য। অপারেশনের আগে ঠিক যেমনটা হয় বা কোনো ফাঁসীর আসামীর রায়ের পরে। তেমনই মনে হল আমার। পাত্রপক্ষের দেওয়া গোসলের শাড়ি আর গয়না পরিয়ে বসিয়ে দেওয়া হলো আমাকে দাদীমার ঘরের বিশাল পালঙ্কটিতে আর পাত্রপক্ষ বসেছিলেন বৈঠকখানার ঘরে। সবার ভেতরেই কেমন গুজগুজ ফুসফুস ভাব। যেন জোরে কথা বললে এ বাড়ির সন্মান যাবে কাজী সাহেব ও পাত্র পক্ষের সামনে।
সেজোচাচী আর ছোটচাচীকে বসিয়ে দেওয়া হলো আমার পাশে। মা বলে দিলেন, খবরদার কবুল বলতে বললেই সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠে কবুল বলবি না। কয়েকবার বলার পর তারপর বলবি। আমি তো সেই কথা শুনে থ। মনে মনে হাসলাম। এরপর কাজীসাহেব ও তার সাথে পাত্রের চাচা খালু আরও কে কে আসলো জানিনা। আমাকে আধ হাত ঘোমটার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। এরপর কাজী সাহেব বললেন, নাটোর জেলার ... উপজেলার..... গ্রাম নিবাসী ওমুক হাসানের ছেলে তমুক হাসানের সাথে আপনার বিবাহ ......... হেন তেন কি কি তারপর বলেন কবুল.... মা বলেছিলো কয়েকবার বলার পর কবুল বলতে আর আমি মুখে একেবারেই খিল এটে বসে রইলাম। মা পেছন থেকে ধাক্কা দিলেন, দাদীমা বললেন, বলো নীরু, কবুল বলো। আমি আর বলিই না। কিছুতেই বলি না..... শেষে আমার পাশ থেকে সেজোচাচী বলে দিলো কবুল.... বাস কাজীসাহেব খুশি হয়ে গেলেন..... আলহামদুলিল্লাহ মাশাল্লাহ বলে উঠে দাঁড়ালেন তারা। আর সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেলো খোরমা, মিষ্টি শরবতের বিতরন, একে অন্যের মিষ্টিমুখের আনন্দ উচ্ছাস। এতক্ষন যেন সকলের দম আটকে ছিলো। তবুও শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। সেজোচাচী কবুল বলে দিলেও আমার সামনে বাড়িয়ে দেওয়া হলো বিশাল বড় এক রেজিস্ট্রী খাতা। সেখানে সাইন করতে হলো।
কাজীসাহেব আর পাত্র পক্ষের লোকজন বের হয়ে যেতে হঠাৎ মা আমাকে বুকে চেপে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। মাকে আমার সকল সময় অতি নির্দয় আর আমার প্রতি অবিবেচক মনে হয়েছে সেই মায়ের এ হেন আচরণে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। হয়ত আমার সাথে সাথে অন্যান্যরা সকলেই। মাকে সবাই সান্তনা দিচ্ছিলো। আর আমি কোন ভাবনায় মগ্ন ছিলাম ঠিক মনে নেই। তবে হঠাৎ আমাকে বুকে চেপে ধরে মায়ের ঐ অবাধ কান্নার মানে আজও খুঁজে পাইনি আমি।
বিয়ে পড়ানো শেষ হলো কিন্তু বিয়ের আয়োজন মানে অতিথি অভ্যাগতদের খানাপিনা ছিলো দুপুরে। ছোটচাচী মীরা আপা আরও কয়েকজন মিলে আমাকে সাজাতে বসলেন। আজকালকার মত তখনকার দিনে আমাদের যশোরে বিউটি পারলার ছিলো না। কনেদেরকে বাড়িতেই মা খালা চাচীরা বা বড় বোনেরাই সাজিয়ে দিতেন। ছোটচাচী তার অসাধারণ করিৎকর্মায় সুনিপুন হাতে আমার চুলে বেঁধে দিলেন মস্ত এক বেনী খোঁপা। হাতে পায়ে নেইলপলিশ দিয়ে নক্সা করে দিলেন মীরা আপা। কাজল লিপস্টিক দেবার পর তখনকার দিনে বউ ভাব আনার জন্য কপাল জুড়ে লাগিয়ে দেওয়া হত চন্দনের নক্সা। কপালে টিকলী, টায়রা ঝাপটা মুকুট থেকে শুরু করে পায়ের পাতায় পঞ্চ অঙ্গুরীও কোনোটাই বাদ পড়লো না। মনে পড়লো দাদীমার সেই কথাটাই, আগের দিনে নাকি মেয়ে এক পাল্লায় দাঁড়া করিয়ে আরেক পাল্লায় সমান পরিমান সোনা মেপে দেওয়া হত।
আমারও ইচ্ছে করছিলো ঠিক ওভাবেই ওরকম কোনো দাড়িপাল্লার উপর দাঁড়িয়ে ওজন করে নিতে। হঠাৎ এক বিরাট বড় থালায় করে সেজোচাচী নিয়ে আসলেন অর্ধেক খাসীর মাথা, অর্ধেক রোস্ট আরও অর্ধেক অর্ধেক কিছু খাবার। এসেই আমার মুখে তুলে খাইয়ে দিতে শুরু করলেন সেই খানা পিনা। বললেন,
- খাও খাও আজ থেকে তুমি যার অর্ধাঙ্গিনী হলে তার অর্ধেক খানা খেয়ে শুভ সূচনা করো।
সেজোচাচী ছোট ছোট গ্রাস নিয়ে মুখে তুলে দিচ্ছিলেন বিরিয়ানী পোলাও যেন লিপিস্টিক নষ্ট না হয়। আর আমি ভাবছিলাম আমার চাচীমাদেরকে তো কখনও অমন চাচাদের আধা উচ্ছিস্ট খেতে দেখিনি তবে কেনো আমাকে এসব খেতে হবে? পরে বুঝেছিলাম এটা শুধু বিয়ে বাড়ির কৌতুকময় একটি আচারই ছিলো।
খানাপিনা শেষে আমাদের সেই বিশাল বাড়ির ভেতরকার উঠোনে রসুনচৌকিতে এনে বসানো হলো আমাকে। পাশে এনে বসানো হলো নতুন জামাইকেও। বেঁজে উঠলো সানাই, নহবৎ কাশি ঢোল। আসলে এই বাজনাটাই রোশনচাওকি কিন্তু ও বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে এমন করে মেয়ে জামাইকে পাশাপাশি বসিয়ে কিছু আনন্দ করা হত। আর সে সময় যে কারুকার্য্যময় চৌকিটার উপর বসানো হত সেই চৌকি বা স্টেজটার নামই হয়ে গিয়েছিলো রসুনচৌকি। এই অপূর্ব সুন্দর সেগুন কাঁঠের চৌকিটির নাম ছিলো ঐ অপূর্ব সুন্দর বাজনাটারই যে নামে সেও অনেক পরে জেনেছিলাম আমি। আমাদের ছোটবেলায় আমরা ঐ চৌকিটার নামই রসুনচৌকি ভাবতাম।
যাইহোক আমার মাথার রাঙ্গা চেলির অর্ধেক অংশ তুলে দেওয়া হলো নতুন জামাই এর মাথায় তারপর সামনে ধরা হলো একটি আয়না। এটা মূলত বাড়ির নারীদের অনুষ্ঠান ছিলো। বিয়ে উপলক্ষে আমাদের বাসায় আসা আমার নানীমা এই কাজটির দায়িত্ব নিলেন।নানীমা হাসি হাসি মুখে জিগাসা করলেন,
- ও নতুন জামাই আয়নার মধ্যি কি দেখতিসো? আসমানের চান নাকি বেহেস্তের হূরি?
- ও জামাই তুমি বোবা নাকি কালা? চুপ করে আছো কেন? লজ্জা পাইসো?
এমন নানা রকম রসিকতায় কাটলো কিছুক্ষন আর তারপর মিষ্টিমুখ করানো হলো বরের হাতে ধরে বউকে মুখে তুলে খাওয়ানো আবার বউ এর হাতে ধরে বরকে মুখে তুলে শরবৎ, মিষ্টি খাওয়ানো। আমাদের দেশে এই অনুষ্ঠানটিকে বলা হত শাহ নজর। জানিনা তার কারণ কি ছিলো।
এই অনুষ্ঠানের সর্বশেষ পরিসমাপ্তি ছিলো কন্যাদান পর্ব। দাদীমা আমার হাতখানি নিয়ে তুলে দিলেন নতুন জামাই এর হাতে। বললেন, নীরু আমাদের অতি আদরের মেয়ে। আজ থেকে তোমার হাতে ওকে সম্প্রদান করে দিলাম। আজ থেকে ওর সকল দায় দায়িত্ব ভালো মন্দের ভার তোমার। তারপর আমার শ্বাশুড়িমার হাত ধরেও বললেন, আজ থেকে ও আর আমাদের মেয়ে নয়, আপনার মেয়ে। কোনো দোষ ত্রুটি করলে মাফ করে দেবেন নিজের মেয়ে মনে করে আরও আরও কি কি সব অনুরোধ উপরোধ। আমি নতুন বরের মুখের দিকে চাইনি বটে তবে শ্বাশুড়িমাকে যখন দাদীমা এসব বলছিলেন তখন ঘোমটার ফাক দিয়ে আড়চোখে চেয়েছিলাম। সেই প্রথম দিনের মতনই উনার ভ্রু দু'টি কোচকানোই ছিলো। যেন ছেলেকে বিয়ে করাতে এসে উনি বড় বিরক্তিতে পড়েছেন।
সে যাইহোক, শেষ মেষ রাঙ্গা চোলি আর বেনারসীতে সেজে গুজে মাঘ মাসের কনকনে শীতের সেই ভর সন্ধ্যায় আমি চললাম শ্বশুর বাড়ি। বিদায়কালে গাড়ি ঘিরে থাকা একবাড়ি মানুষ পাড়া প্রতিবেশী সকলকে ছেড়ে এগিয়ে চললো সেই ফুলপাতায় সজ্জিত বিয়ের গাড়ি। সন্ধ্যার আগমনে সারা বাড়িতে মিট মিট করে জ্বলে উঠেছে তখন বিয়ে উপলক্ষ্যে সাজানো টুনি বাল্বগুলি। আমি ঘোমটার ফাক দিয়ে শেষবারের মত আড়চোখে দেখে নিলাম আমার আজন্ম লালিত চিরচেনা সেই বাড়িটিকে। যে বাড়ির ছাদের ঘরটিতে সকলের অজান্তে চাপা পড়ে রইলো একটি বিফল অথবা সফল এক ভালোবাসার ইতিহাস।
আগের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০২২ দুপুর ১২:৩০