২০০৮ সালের জানুয়ারী মাসের একটা দিন । সেদিনটা ছিল শনিবার ও খুবই দূর্যোগপূর্ণ একটা দিন । আকাশ থেকে মুসুলধারে স্নো পরছিল সাথে প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস ছিল। সকাল ১১টা বাজলেও কোন সূর্য ছিল না ।
ইটালী থেকে আগত ভাইয়ার পরিচিত এক বাংলাদেশী ফ্যামেলী( মা সাথে তিন বাচ্চা, একটা বাচ্চা ১২ বছর ছোট দুটো বেশ ছোট তিন ও চার বছর) কয়েকদিন ধরে আমাদের বাসায় অবস্থান করছিল।এখানে মাইগ্রেশন অফিসে উনাদের কিছু কাজ আছে, ভদ্র মহিলা এখানে নতুন কিছু চিনে না তাই উনাদের ওখানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা আমার উপরই আসে।শনিবার ছাড়া যেহেতু আমার সময় নেই তাই এই ওয়েদারেই বের হলাম উনাদের নিয়ে। আমাদের বাসা থেকে যেতে হবে প্রথমে মেট্টোতে সেন্টাল ইষ্টেশন, এর পর ট্রেন ধরে কিছু দুর, এর পর বাসে করে মাইগ্রেশন অফিস।
মেট্রো ও ট্রেন ভাল ভাবেই পার হলাম। বাস ইষ্টিশনে যেয়ে দেখি কয়েকটা বাস ছেড়ে যাচ্ছে আমিও তারাহুরা করে উনাদের নিয়ে একটা বাসে উঠি, আজকে ছুটিরদিন বাস ৩০/৪০ মিনিট পর পর। কিছুদুর যাওয়ার পর খেয়াল করলাম আমি এয়ারপোর্টে যাওয়ার বাসে উঠেছি ।ভদ্র মহিলাকে বল্লাম, ভাবী আমি ভুল বাসে উঠেছি, আমরা সামনে যে স্টপেজ আসবে সেখানে নেমে যাব, আবার অন্য বাস ধরে আগের জায়গায় ফিরে যেয়ে বাসে উঠতে হবে ।
শহর থেকে দুর বাহিরে হওয়াতে এখানে বাস স্টপেজ গুলো একটু দুরে দুরে।সামনে যেই স্টপেজ আসল আমরা সেখানেই নেমে অপজিট পাশের ষ্টপেজে যেয়ে দেখি বাস আস্তে ৩৮ মিনিট, মাত্রই একটা বাস চলে গেল যেটা আমরা একটুর জন্য ধরতে পারিনি। এই জায়গাটা ছিল খোলা আশে পাশে কোন ঘর বাড়ি নেই কোন গাছ পালাও নেই ,যতদুর চোখ যায় শুধু সাদা আর সাদা প্রচন্ড স্নো পরছে সাথে প্রচুর বাতাস। এত বেশী ঠান্ডা ছিল ছোট বাচ্চাদুটো কাঁপতে ছিল । তাদের অবস্থা দেখে খুব ভয় পাচ্ছিলাম আমার ভুলের জন্য বাচ্চাদুটো খুব কষ্ট পাচ্ছে।এমন সময় অপজিট পাশে একটা বাস এসে থামে। বাস ড্রাইভার হাত ইশারায় আমাকে ডাকে। আমি যেতে চাইনি কিন্ত সেও আমাকে ডেকেই যাচ্ছে, যেহেতু আমি অপজিট দিকে যাব তবু অনিচ্ছা স্বত্বেও উনার কাছে গেলাম ।
- তুমি কোথায় যাবে?
- আমি মাইগ্রেশন অফিস যাব ?
- তাহলে তুমি এখানে এসেছ কেন ?
- আমি ভুল বাসে উঠে এখানে এসেছি , তাই আবার ফিরত যাচ্ছি।
- ও পাশের বাস আস্তে তো দেরী আছে তুমি উনাদেরকে নিয়ে আমার বাসে উঠ।
- তুমি তো এয়ারপোর্ট যাচ্ছ , আমরা তো যাব অন্য দিকে ।
- ওহ্ মেয়ে তুমি বুঝতে পারছ না ঠান্ডায় বাচ্চাদুটো তো মারা যাবে ! তুমি উনাদের নিয়ে তারাতারি আমার বাসে উঠ।
আমি কিছু চিন্তা না করেই উনাদের নিয়ে বাসে উঠলাম ।
বাসে মাত্র দুই জন লোকই ছিল দুই স্টপেজ পরেই উনারা নেমে গেলেন , শুধু আমাদের নিয়েই উনি এয়ার পোর্ট এলেন কারন প্যাসেঞ্জার থাক বা না থাক উনাকে এ পর্যন্ত আসতেই হবে ।
এয়ার পোর্ট আসার পর আমিও মনে সাহস পেলাম , লোকটাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বল্লাম আমরা এবার একটা ট্যাক্সি নিয়ে যেতে পারব।
না তোমরা বস, আমার আজকের ডিউটি শেষ, আমি এখন বাস কাউন্টারে ফেরত দিয়ে বাসায় চলে যাব । বাসের কাউন্টার তোমরা প্রথম যেখান থেকে বাসে উঠেছ সেখানে আমাকে একটু ঘুরে যেতে হবে তবু আমি তোমাদের মাইগ্রেশন অফিসে নামিয়ে দিয়ে যাব ।
আমি অনেক মানা করােছি, উনিও নাসোর বান্দা কি আর করব বাসেই বসে থাকলাম।
অবশেষে উনি আমাদের মাইগ্রেশন অফিসের সামনেই একটা বাস স্টপেজে বাস থামিয়ে বল্লেন , তোমরা এবার যেতে পারবে ?
- আমি, জী পারব তবে তুমি একটু দাড়াও আমি তোমার সাথেই যাব। আমি শুধু বাস থেকে নেমে উনাদের রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়ে আসি।
- তুমি উনাদের সাথে যাবে না?
- না আমি তোমার সাথেই চলে যাব ।
- ওকে, আমি আছি, তুমি উনাদের পৌঁছে দিয়ে আস।
আমি বাস থেকে নেমে ভদ্রমহিলাকে ইশারায় মাইগ্রেশন দেখিয়ে বলি, ভাবী আপনি এখন ওদের নিয়ে যান, আমি এই বাসেই চলে যাই । উনি বলেন, আচ্ছা যাও।
আমি বাসে উঠে ড্রাইভাবের কাছাকাছি একটা সিটে বসি।
- তুমি কেন উনাদের সাথে গেলে না ? অন্তত অফিস পর্যন্ত উনাদের পৌঁছে দিতে পারতে।
- অফিস তো এখান থেকে দেখাই যাচ্ছে এটুকু উনি যেতে পারবে।
- উনারা তো নতুন মনে হয় ভাষা জানে না উনাদের তো হেল্প লাগবে ।উনারা তোমার কে হয়?
- উনারা আমার আত্বীয় না , একই দেশের এই আর কি।আর এখন উনাদের যেই হেল্প লাগবে সেটা মাইগ্রেশন অফিসের দায়িত্ব।
আরো অনেক প্রশ্ন উনি আমাকে করলেন মানে আমার নাম টাম কোথায় থাকি, কি করি এই সব, শেষে আমি উনাকে একটা প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা তুমি কেন অযাচিত ভাবে আমাদের হেল্প করলে?
উনার জবাব ছিল —
- আমি তোমাদের সাহায্য করেছি শুধু মাত্র ছোট বাচ্চা দুটোর জন্য তারা খুব কষ্ট পাচ্ছিল আর আমার সুযোগ ছিল তবু যদি আমি তোমাদের হেল্প না করতাম তাহলে সেটা হত অমানবিক। এটা আমাকে সারা জীবন কষ্ট দিত। এখন আমার মনে খুব প্রশান্তি লাগছে , খুব ভালো লাগছে আজকের দিনে কোন মানুষের জন্য একটু হলেও উপকার করতে পেরেছি আর এই ভালো লাগাটা আমার অনেকদিন পর্যন্ত থাকবে। তোমাকে একটা উপদেশ দেই, যদি তোমার সামনে সুযোগ আসে কোন মানুষের উপকার করার যদি সেটা খুব সামান্যও হয় বা তোমার একটু কষ্টও হয় তবু এই সুযোগ কখনো হাত ছাড়া করবে না, মানুষের উপকার করার মাঝে যেই শান্তি এটা তুমি আর কিছুতেই পাবে না।
কথায় কথায় আমরা চলে আসলাম আমাদের গন্তব্যে, আমি উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলাম সামনে।
আজ থেকে প্রায় এগারো বছর আগের ঘটনা, মাঝে মাঝেই মনে হয় সেই দিনের কথা।
আমি উনার উপকারের কথা ভুলিনি, যখনই মনে হয় নতুন করে মনের ভিতর উনার জন্য সম্মান তৈরী হয়। উনার উপদেশের কথাও ভুলিনি যদিও সব সময় পারি না, কিন্ত উনার কথাটা সত্য কোন মানুষের জন্য সামান্য উপকার করলেও মন ভালো লাগে ।
ফটো আমার এ্যালবাম থেকে নেয়েছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:২০