“ফেব্রয়ারীর স্নো ঝরা এই সকালে যতদুর চোখ যায় শুধু সাদা আর সাদা। এই শুভ্র স্নো যতদুর চাদর বিছিয়ে দিয়েছে আমার ততটাই ভালোলাগা এই বইয়ের প্রতিটা পাতায় পাতায়”
বই - আকাশ গঙ্গার তারা
লেখক - খন্দকার নাইমুল ইসলাম
প্রচ্ছদ - বিধান সাহা
প্রকাশক -চৈতন্য
খন্দকার নাইমুল ইসলাম ( মলাসইলমুইনা )লেখক হিসাবে এবছর আত্ব প্রকাশ করেছেন।২০২১ সালের বইমেলাকে সামনে রেখে উনার দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে। বই প্রকাশক হিসাবে উনি নতুন লেখক হলেও উনার লিখালিখির হাতেখড়ি সেই ছোটবেলা থেকে এটা আমরা ব্লগের অনেকেই জানি । উনি খুব পুরাতন ব্লগার না, আবার লিখেনও খুব কম তবু ব্লগে উনার একটা ইমেজ তৈরী হয়েছে সেটা একমাত্র উনার লেখা ব্যাতিক্রম ও উন্নত ভাষার মান আর অন্যদের পোষ্টে উনার রুচিশীল মনের সৃজনশীল কমেন্টের জন্য ।
আকাশ গঙ্গার তারা
-বইটি দেশ বিদেশের পটভূমিতে লিখা, গল্পগুলোর কাহিনী ও বিষয় বৈচিত্র্য আর অনুপম সুন্দর বর্ননা আমাকে মুগ্ধ করেছে।দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা,রহস্য ও রোমাঞ্চ, সুখ দুঃখ আর প্রেম ভালোবাসা সবকিছু মিলিয়ে আকাশ গঙ্গার তারা’র গল্পগুলোতে আমাদের জীবনের কথাই প্রকাশ পেয়েছে ।আকাশ গঙ্গার তারা’য় সুন্দর কথা মালায় সাজানো রকমারী স্বাদের মোট বারোটি গল্প আছে ।
১ - আকাশ গঙ্গার তারা' গল্পটা ২০১৯ ব্লগারস ডেতে সামহ্যোয়ারইন ব্লগের ব্লগারদের সাহিত্য সংকলন "বাঁধভাঙার আওয়াজ-এ প্রকাশিত হয়েছিল। ব্লগের অনেকেই এগল্পটা পড়েছেন তাই এটা নিয়ে আমি আর কিছু বলতে চাচ্ছি না । শুধু মনে গেঁথে থাকার মত কয়েকটা লাইন তুলে দিচ্ছি :
‘বৃষিট নেই । ট্রেন চলছে । বৃষ্টির পরে মেঘহীনআকাশ ঝিক মিক করছে অজস্র তারায়। স্বপ্নীল মাথাটা একটু বের করে দেখতে চেষ্টা করলো তারাগুলো। ওই দূর আকাশের তারা-গুলোই কিআকাশ গঙ্গার তারা? একটা জ্বলজ্বলে তারা মিটমিট করে যেন অনিমেষ দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়েআছে । ট্রেনের সাথে ছুটতে ছুটতে তারাটা যেন কথাবলতে চাইছে ওর সাথে । স্বপ্নীল তারাটার দিকেতাকিয়ে ফিস ফিস করে বলে, ‘শ্বেতা আমিবলেছিলাম তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।কোথাও যাই নি। আমি এখনো তোমাকে মনেরেখেছি । কিন্তু তুমি আমার জন্য থাকোনি---'।----(আকাশ গঙ্গার তারা)
২ - উৎসব, ভেজাল ,হ্যালুসিনেশন, পরিচয় এই চারটে গল্পে আমাদের সামাজিক , রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে হৃদয় ছোঁয়া বর্ণনায় পাঠকের মনে আনন্দের সাথে কিছু ভাবনাও উদয় হবে, উৎসব ও হ্যালুসিনেশন গল্পদুটোতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র কিছুটা রম্যের মাধ্যমেই তুলে ধরেছেন । আর ভেজাল তো ভেজাল - ই যা আমাদের দেশটাকে উত্তর থেকে দক্ষিন, পূর্ব থেকে পশ্চিম পুরোটাই গ্রাস করে ফেলেছে। শুধ সেটাই না ,এই গল্পে , দালালের মাধ্যমে প্রতারিত বিদেশ ফেরত এক যুবকের জ্বালা যন্ত্রনার কথা খুব বাস্তবতার নিরিখেই ফুটিয়ে তুলেছেন যা পাঠক হৃদয়কে আলোরিত করে ।
বর্তমান সময়ে নেট ছাড়া জীবন আমরা কল্পনাই করতে পারি না, এই নেটের কল্যানে দুনিয়াটা আমাদের হাতের মুঠোয় কিন্ত এর কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে , পাওয়ার আনন্দও আমাদের ভুলের কারনে সারা জীবনের কষ্টে পরিনত হতে পারে সেটাই উঠে এসেছে এই গল্পে।সাবলীল লিখা আর নান্দনিক বর্ণনায় গল্পটা চমৎকার।
৩- জাঙ্ক ই-মেইল বিদেশের পটভূমিকায় একটা চমৎকার গল্প । লেখার মুন্সিয়ানায় এটা বইয়ের অন্যতম সেরা গল্প । শুরুতে গল্পটা পড়তে পড়তে খানিকটা ভুতুড়ে মনে হতে পারে কিন্তু পড়া এগুবার সাথে সাথে সেই ভাবনার অবসান হবে । তখন গল্পটা ভুতের,রোমাঞ্চকর, না ভালবাসার গল্প সেটা নিয়ে দ্বন্দ্বে পরে যাবেন।সেই দ্বন্দ্বটা খুব সহজেই কাটবে না লেখার স্টাইলের জন্যই ।
৪ - জ্যোতিষী, মানুষের জীবনের সব কিছু যখন শেষ হয়ে যায়, কোন আশাই আর অবশিষ্ট থাকে না তখনোও মানুষ স্বপ্ন দেখে, প্রত্যাশা করে তার জীবনে অলৌকিক ভাবে হলেও যেন সব ঠিক হয়ে যায়। গল্পের নায়ক প্রৌঢ় করিম সাহেবও তেমন যুবক বয়সে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলা একজন। করিম সাহেবও জানেন তার ভালোবাসার মানুষ আর কখনো ফিরবে না, তার ফেরা অসম্ভব তবু সে আশা করে অলৌকিক কিছু ঘটবে তার জীবনে | কোন একদিন তার ভালোবাসার মানুষের সাথে তার দেখা হবেই I যুবক থেকে সে প্রৌঢ়ত্বে পৌছেছে তবু সে অপেক্ষায় আছে কোনো অলৌকিকত্বের । কত চমৎকার একটা গল্প!
৫ - প্রিয়রবাসু, জলছবি ,সেলফোন, নোটবুক — প্রেমের সফলতা নাকি মিলনে নয় । কিশোরী বয়সে যেদিন এই কথাটা কারো মুখে প্রথম শুনেছিলাম সত্যি খুব ভাবনা এসেছিল মনে সফলতা যদি মিলনে না হয় তাহলে প্রেমিক - প্রেমিকা যে কোন মূল্যে ভালোবাসার মানুষকে পেতেই হবে এমন আকুলতা কেন,আর এটা নিয়ে পরিবারের সাথেও কত দ্বন্দ্ব হয়। বয়স বাড়ার সাথে কিছুটা বুঝতে পারলেও লেখকের এই গল্পগুলো পড়ার পর আমার কাছে সেটা এখন পরিস্কার।বাস্তবতার কারনে ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া হয়নি কিন্ত দীর্ঘদিন পরে ও ভালোবাসার মানুষের জন্য মনের ভিতরে হাহাকার আছে , হৃদয়ে রক্তক্ষরন হয়, কখনো চোখের কোনে অশ্রু জমে, লেখক খুব সুন্দর কথার গাঁথুনী আর বুননে সুন্দর ভাবেই সেটা ফুটিয়ে তুলেছেন।
গল্পগুলো প্রেম ভালোবাসার হলেও বর্তমানে সময়ে স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে ভালোবাসার সস্তা বা খোলামেলা কোন বর্ণনা নেই , শালীনতার সাথেও যে প্রেমের গল্প লিখা যায় এই গল্পগুলো তারই উদাহারন । সাথে আছে ইতিহাসের বর্ণনা, প্রাকৃতিক দৃশ্যের মনোমুগ্ধকর বর্ননা । গল্প পড়ার সময় নিজের অজান্তেই মনের জানালায় ভেসে উঠে সে সব দৃশ্য । দুইটা গল্পের আমার ভাললাগা কিছু অংশ -
আসলে আমরা মহাপুরুষ হতে পারিনা কখনো ।--- আমরানিজেরদের দুঃখ, নিজেদের কষ্ট সব সময়ের জন্য ভুলেযেতে পারিনা । নিজেদের দুঃখ কষ্টগুলো শুধু নিজেদেরমধ্যে পুষে রাখি । ভুলে থাকার ভান করি । ---কিন্তু কোনোকারণ পেলেই সেই কষ্টগুলো আবার পাহাড়ি নদীর জলেরমতো ছলছল করে মনের ভেতর বইতে শুরু করে I ----(প্রিয়বরাসু)
কিছু কিছু মুহূর্ত মনের গহীনে জলছবি হয়ে থাকে ।স্মৃতিরকিছু ব্যাপার মনে হয় মনের ভেতর ওয়াটার কালারে আঁকাথাকে। ধূসর হয় না। ওয়াটার কালারের আঁকা ছবির মতোইযতই দিন যায়, যতই পুরোনো হয় ততোই উজ্জ্বল হয় I দিনে দিনে উজ্জ্বল থেকে আরো উজ্জ্বলই হতে থাকে ।সময় সেই স্মৃতিগুলোতে বিস্মৃতির কোনো ছাপ ফেলতেপারে না।মনের ভেতর বসত করা সেই ছোট ছোট মুহূর্তেরস্মৃতিগুলো পোড়ো বাড়ি হয়ে ভেঙে পড়েনা কখনো।ভালোবাসা জমে জমে হয় থাকে স্মৃতির প্রাসাদ । ---( জলছবি)
৬ - ভালবাসার ঘ্রান বইয়ের সব শেষ গল্পট। এই গল্পটা এই বইয়ের ব্যাতিক্রম একটা গল্প।গল্পের ভিতরের গল্পটা আসল গল্প হলেও আর সেটা বিরহের হলেও সামনের গল্পটা হ্যাপিএন্ডিং হয়েছে এই বইয়ে এই একটা মাত্র গল্পে । যেমন ভাষার বুনন তেমন সুন্দর কাহিনী আমি পরে এতটাই মুগ্ধ হয়েছি সেটা আমি প্রকাশ করতে পারবো না। শুধু আমার মনকে নারিয়ে দেয়া কিছু অংশ তুলে দিলাম ।
“ওহাইও রিভারের তীর ঘেঁসে ফ্লোরেন্সের এক হোটেলেরফিফটিন্থ ফ্লোরে আমাদের বাসার রাত কেটে ছিল । রাতে আমি রুমে ঢুকে দেখি ক্লান্ত লিজা বেডে শুয়ে ঘুমিয়ে গেছে।আমি ওর কপালে আলতো একটু চুমু দিতেই ও চোখ দুটো খুলে আমার গলা জড়িয়্ ধরে বলেছিল,’ আমি তোমার স্লিপিং বিউটির অরোরা। তোমার লাভ কিসেই আমার ঘুমভাংলো।’----
মরচুযারির এই পরাবাস্তব পরিবেশে,অন্যদের উপস্থিতি সব ভুলে আমি লিজার কপালে আলতো একটা চুমু দিলাম, যদি সেদিনের মতো লিজা জেগে উঠে ! কিন্ত না, লিজাচোখ মেলে আমাকে দেখলো না ।
চোখের কয়েক ফোটা অশ্রু আমার শাসনের বাধ না মেনে লিজার মুখে ঝরে পরল । আর তখন একটা খুব আশ্চার্য ঘটনা ঘটল। লিজার শরীরে দেওয়া প্রিজারভেটিভফরমালডিহাইডের তীব্র গন্ধ ছাপিয়ে লিজার গা থেকে হাল্কা গোলাপের গন্ধ এসে আমার নাকে লাগলো ।মুহুর্তের মধ্যেই সেই হাল্কা গন্ধটা ভোরে ছড়িয়ে যাওয়া সান রাইজের আলোর মতোই আমাকে সব দিক থেকে ঘিরে ধরলো । ….”
ক্যাবিক ভাষা, ক্রেয়েটিভ কাহীনি ,প্রাকৃতিক দৃশ্যের নান্দনিক বর্ণনা, সব কিছুই আমার কাছে খুব খুবই ভালো লেগেছে, তবে যেটুকু আমার কাছে আরো একটু অন্য রকম হলে আরো ভালো লাগতো ।
১ - পরিচয় গল্পটা যতটা সুন্দর নামটা আমার কাছে মনে হয়েছে আরো একটু ক্যাব্যিক নাম হলে গল্পের ভালোলাগাটা আরো বেশী হত ।
২ - অনেকগুলো গল্পে নায়িকার শ্বেতা নাম ও তিনটা গল্পে নায়কের স্বপ্নিল নামটা এসেছে , আমার কাছে প্রতিটা গল্পে নায়ক নায়িকার নাম ভিন্ন হলে ভালো হত ।
৪ - শেষ গল্প ভালোবাসার ঘ্রান পড়ার পর মনে হল সত্যি এই বইয়ের প্রতিটি পাতায় পাতায় জরিয়ে আছে ভালোবাসার ঘ্রান, “আকাশ গংগার তারা “ নামটাও সুন্দর তবু কেন যেন মনে হচ্ছে যেই বইয়ে এত ভালোবাসা ছড়িয়ে আছে সেই বইয়ের নাম ভালোবাসার ঘ্রান হলে মন্দ হত না।
বই সম্পর্কে কিছু ইনফরমেশন —
১২৪ পৃষ্টার বইটির মূল - মাত্র ১৮৮ টাকা
অনলাইন অর্ডার করতে পারেন রকমারী ডট কম এ।
এছাড়া বই পাবেন ঢাকা,চট্টগ্রাম ও সিলেট বাতিঘরে।
আমাদের জীবন অত্যান্ত ব্যাস্ত তার উপর আছে করোনা আর বর্তমানে আলজাজিরার ঝামেলা এইসব কিছু ভুলে থাকার জন্য আজই সংগ্রহ করুন আপনার কপিটি । ব্যাস্ততা ও ঝামেলা যুক্ত এই জীবনে কিছুটা হলেও আনন্দের ছোঁয়া পাবেন ।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৫৮