somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফায়ার এলার্ম।

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হঠাৎ বেজে উঠল অচেনা শব্দের এলার্ম।
আগে কখন ও শুনিনি এমন।
তাই তাকাচ্ছি এদিক ওদিক। কি হল, কি হল।
ফায়ার এলার্ম। হতচকিত সবাই।
শুরু হয়েছে ছুটাছুটি।
কোন পথে কোন দিকে যাব দিশেহারা।
না, ফায়ার এক্সিটের দিকে ছুটছে সবাই।
আমি দৌড়াচ্ছি। দৌড়াচ্ছে রাসেদ, খালিক, নুসরাত ও।
ইস, ছোট্ট একটা গেট। তাও দীর্ঘদিনের অপরিচর্যা আর ধুমপায়ীদের অভয়ারন্য এই সিঁড়িটায় তো কোনদিন আছাড় খেতেও আসিনি।
প্রচন্ড ভীড়।
ধাক্কাধাক্কি।
আমি এমনিতেই দুর্বল। ভীড় দেখলেই নিরাপদ দুরত্বে থাকার মানুষ। আর! এখন দৌড়াতে হচ্ছে সেই আমাকেই।
নামছি।
নামছি সিঁড়ি বেয়ে রকেটের গতিতে হন্তদন্ত হয়ে।
ইতোমধ্যে চার তলায়।
না, আর যাওয়া যাচ্ছে না। ততক্ষনে আগুন পৌঁছে গেছে তিন তলা পর্যন্ত। আর যাওয়া যাচ্ছে না। অপশান দুটো-চার তলা থেকে লাফিয়ে নিচের টিনের চালে নতুবা আবার উপরের সিড়ি।
কিছু মানুষ বাঁচার আকুতি নিয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছে শূন্যে। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। নিচের দিকে তাকালেই তো আমার কলিজা ধড়পড় করে। আমি তো সেই লোক যে ট্রেনের নিচে পড়ার আশংকার মূহুর্তে ও বাস থেকে লাফ দিতে সাহস পাই না।
কি করব আমি।
মাথা একদম কাজ করছে না।
আবার ছুটছি উপরের দিকে।
উদ্ধারের জন্য হেলিকপ্টার আসবে নিশ্চয়ই। তারপর তো নিরাপদ।

আমি এখন বিশ তলার ছাদে। আগুন উঠছে ধীরে ধীরে।
ছাদের একপ্রান্তে এসে আগুনের খেলা দেখছি আমরা কিছু অসহায় মানুষ। আশায় আছি কখন হেলিকপ্টার আসে...।

আগুন বেড়ে উঠছে লেলিহান শিখা নিয়ে।
উপরে আমরা কিছু অসহায় মানুষ মৃত্যুর প্রহর গুনছি।
নিচে অগনিত দর্শক তাকিয়ে আছে হা করে, সাংবাদিকেরা ক্যামেরা হাতে। কেউবা মনে মনে দুয়া করছে প্রভুর কাছে।
সবাই অসহায়। জাহান্নামের যে দৃশ্যটা এতদিন মানসপটে আঁকা ছিল শুনে আর পড়ে, আজ তার স্বরূপ কিছুটা অনুভব করছি কাছ থেকেই। আজ সকালেও যে মানুষটি ছিলো কারো ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী কিংবা সন্তান। কিছুক্ষন পরেই সে পরিণত হবে একটা জীবন্ত লাশে। ফিরে আসবে বলে অপেক্ষায় ছিলো যে প্রিয়জন সে ফিরে পাবে একটা নিঃশব্দের কান্না।
আমিও যে ফিরে যেতে চাই হাসি নিয়ে প্রিয়জনের কাছে।
ফোন করি বাবাকে, "বাবা, তোমাদের সাথে হয়তো আর কথা হবে না"। ফোন দেই ভাইয়াকে, "শেষ বারের মত মোবাইলে কিছু টাকা পাঠিয়ে দাও। যতক্ষন সময় পাই সবার কাছ থেকে শেষ বিদায়টুকু নিই।"
একে একে ফোন দিচ্ছি ফরিদা, সাহিদা, সৈকত, রানু, নাসের, মুকুল আরো আরো প্রিয় ছোট ভাইবোন-দের--"যে ভাইয়াটাকে দেখেই তোদের আশংকা হত-এই বুঝি নতুন কোন জ্ঞান দিতে আসছে তার আজ বিদায় মূহুর্ত। আর হয়তো কোন দিন জ্ঞান দিতে আসবেনা ফিরে। শেষ সময়ে ক্ষমা করে দিস বিরক্তির ক্ষন গুলোকে ভুলে। ভাল থাকিস তোরা।"

অসহায় মানুষদের বেঁচে থাকার আকুতিভরা চিৎকারে আর শুনা যাচ্ছে না কিছুই। সময় ঘনিয়ে এসেছে। এখন শুধুই অপেক্ষা হারিয়ে যাওয়ার। ছাই হয়ে মিশে যাওয়ার বাতাসে, না ফেরার দেশে।

ছোট বেলায় মা'কে বলতাম, "মা, ধর আমি হারিয়ে গেলাম কিংবা কোন ছেলে-ধরা আমাকে নিয়ে গেল দূরের কোন দেশে। অনেক বছর পর ফিরে আসলে তুমি আমায় চিনবে? মা হাসতেন আর বলতেন-তোর বাম হাতের উপরের অংশে এই যে কাটা দাগটা এটা দেখে চিনে ফেলব। এছাড়া আরো কত কত দাগ মা দেখাতেন। কতগুলো তিল তোর মুখে-ঘাড়ে। তোকে চিনা তো খুবই সহজ কাজ। শুনে আমার ভাল লাগত। হারিয়ে গেলে কিংবা আহত নিহত হলে আমাকে স্বজনরা খুজে পাবে সহজেই।" কিন্তু আজ শংকা কাটছে না। আমাকে দেখে, আমার অগ্নিদগ্ধ ভূতের মত চেহারাটা দেখে কেউ কি চিনবে আমায়? খুঁজে পাবে আমার লাশ? হবে কি জানাজা? সব চিহ্ন গুলো তো আগুনের সাথে ভেসে যাবে বাতাসে।

কল্পনায় আর কিছু আসছে না। ধরেই নিতে হচ্ছে, একটু পর আমার শরীরে আগুন লাগবে। পুড়বে আমার পোশাক। হাহাকার করতে করতে নগ্ন হয়ে যাব আমি। না শুধু আমি না, সবার অবস্থা তো তাই। সুতরাং নগ্ন হওয়া নিয়ে ভাবার সময় এখন নেই। দাউ দাউ করা আগুনে পুড়ছে আমার দেহ। যে দেহটা এতদিন একটা মশা-ছারপোকার কামড় ও সহ্য করতে পারতো না। ছটপট করছি, বাঁচার আকুতি আর নেই। কষ্টটা যেন কম হয়। দুয়া করছি প্রভু যত তাড়াতাড়ি জানটা কবজ হয়, নিস্তেজ হয় দেহটা। পিপাসার্ত মন ভাবছে, কি হবে তার পর?
বৃদ্ধ বাবা আমার। লাশের জন্য এসে ফিরে যাবে শূন্য হাতে?
আমাকে না দেখে একসপ্তাহ থাকতে পারে না যে ভগ্নিপতিটি সে কি করবে? যে বোন আমার কোন দুঃখের খবরেও কাঁদে সুখের খবরেও অশ্রু ঝরায় সে হয়তো নির্বাক চেয়ে থাকবে আকাশ পানে। আমি আসবো আসবো করে যে ছোট্ট বোনটির নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ভাইয়া ভাইয়া চিৎকার করতে করতে ছুটে আসে বাড়ি থেকে অনেক দূ্র পথ,‌ জাপটে ধরে কোলে উঠে-সে হয়তো জানবেই না তার ভাইয়াটা আর কোন দিন ফিরে আসবেনা। আশাপাশের প্রিয় মানুষ গুলো যাদের আমি ভালবাসতাম অনেক অনেক বেশি, কিন্তু তারা বুঝত না। এখন হয়তো তারা ও বুকে অনুভব করবে চিন চিন ব্যথা, একটু শুন্যতা। বক বক করার কেউ একজন যেন নেই। কারো যেন থাকার কথা ছিল সকালে, সন্ধ্যায়, রাত ১১টা অবধি। কর্তা মহোদয়রা হয়তো বলবে। নিছক দূর্ঘটনা। কি আর করা। পরিবার কে দিব চার লাখ টাকা। নিয়ন্ত্রনের ফেরিওয়ালাদের কেউ কেউ হয়তো মনে মনে খুশিই হবে। যাক, কিছু মানুষ তো কমে গেল। সামষ্টিক চিন্তার মানুষ গুলোর জন্য এতো এক বিচ্ছিন্ন ঘটনাই। ২০ কোটি মানুষের দেশে এ আর কয়জন মানুষ। এ এমন কি...। ব্লগের বন্ধুরা তিন দিনের শোক, কালো পতাকা কিংবা অনলাইন মিলাদের আয়োজন করে শোকের পদ্য রচনা করবে হয়তোবা। বেঁচে যাওয়া সহকর্মীরা করবে মানব বন্ধন। সেখানে হয়তো পুলিশের সাথে হবে ধস্তাধস্তি, কেড়ে নিবে ব্যনার সরকারের পেটুয়া বাহিনী।আলোচনার ঝড় উঠবে মধ্যরাতের টকশো'তে ও। দু-চার দিনের ডিজিটাল শোক দেখিয়ে ভুলে যাবে সবাই। শুধু ভুলবে না কিছু মানুষ, সারা জীবন বয়ে বেড়াবে এই ক্ষত টুকু। বেদনাটুকু। তাদের শয়ন, স্বপন আর প্রহর গুলো কাটবে অশ্রু ঝরিয়ে। নিরবে নিভৃতে, বালিশের ভাঁজে মুখ লুকিয়ে। যাদের সোনালী স্পর্শে বেড়ে উঠেছি আমি। আমাকে নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখত অনেক অনেক। আমি ছিলাম যাদের একমাত্র অবলম্বন। তারা-আমার সে প্রিয় মানুষ গুলো। ভুলবে না আমার সে ভাই টিও যে মাস শেষে অপেক্ষায় থাকে কখন ভাইয়ার পাঠানো দুহাজার টাকা আসবে।
হয়তো খুশি হওয়াদের দলে যোগ দিবে জান্নাতের সিঁড়িতে অপেক্ষমান আমার মা।




[কয়দিন ধরেই কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। তার উপর দেখছি আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া সারি সারি লাশ, ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে আহত নিহত মানুষের স্তুপ, স্বজনদের গগণবিদারী আহাজারি। খুঁজে না পাওয়া অনেক বনি আদমের স্বজনরা হন্যে হয়ে ফিরছে কোথায় পাব তারে...। ১১১ আর ১৫ এর বাইরে আরো কত লাশ...। দেখতে গিয়েছিলাম চট্রগ্রামের ভেঙ্গে পড়া সেই ফ্লাইওভার। এখনো গার্ডারটি পড়ে আছে পুকুরে। সবাই ধারনা করছে গার্ডারের নিচে এখনো আছে অনেক হতভাগার লাশ। ধারণা না সত্যিই। কারণ, যেখানে সবসময় আড্ডা দিত কমপক্ষে শ'দুয়েক মানুষ। ১৫ সেখানে ডাহা মিথ্যা ছাড়া কিছু নয়। যে গার্মেন্টস এ কাজ করে তিন হাজার মানুষ। ১১৫ এর গল্প সেখানে তামাশাই বটে। কিন্তু সংখ্যা কম দেখানোর রাজনীতি যে কি বিভৎস তা দূর থেকে কিছুটা ধারণা করা গেলেও কাছে না গিয়ে অনুমান করা অসম্ভব। ১১১ আর ১৫ এর আড়ালে যারা তাদের নিয়ে ভাবার সময় আর কারোই হবে না শুধু অল্প কিছু মানুষ ছাড়া।

২০ তলা ভবনের ১৬ তলায় আমার অফিস। লিফট এ উঠি-নামি আনন্দেই। অনুভব হয় না ঠিক কত উপরে আমি। ইদানিং কাঁচের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাই। বুকটা কেমন দুরু দুরু করে। ফায়ার এলার্ম আর ফায়ার এক্সিট এর সিঁড়িটা দেখে আসি। হা এই তো পথ। স্বান্তনা দিই নিজেকে। না, তেমন সমস্যা নেই। ডেস্কে এসে বসি। চেষ্টা করি মনোযোগ দেয়ার। তবু ধড়পড়ানি কমছে না বুকের.........।] হঠাৎ বেজে উঠল অচেনা শব্দের এলার্ম।
আগে কখন ও শুনিনি এমন।
তাই তাকাচ্ছি এদিক ওদিক। কি হল, কি হল।
ফায়ার এলার্ম। হতচকিত সবাই।
শুরু হয়েছে ছুটাছুটি।
কোন পথে কোন দিকে যাব দিশেহারা।
না, ফায়ার এক্সিটের দিকে ছুটছে সবাই।
আমি দৌড়াচ্ছি। দৌড়াচ্ছে রাসেদ, খালিক, নুসরাত ও।
ইস, ছোট্ট একটা গেট। তাও দীর্ঘদিনের অপরিচর্যা আর ধুমপায়ীদের অভয়ারন্য এই সিঁড়িটায় তো কোনদিন আছাড় খেতেও আসিনি।
প্রচন্ড ভীড়।
ধাক্কাধাক্কি।
আমি এমনিতেই দুর্বল। ভীড় দেখলেই নিরাপদ দুরত্বে থাকার মানুষ। আর! এখন দৌড়াতে হচ্ছে সেই আমাকেই।
নামছি।
নামছি সিঁড়ি বেয়ে রকেটের গতিতে হন্তদন্ত হয়ে।
ইতোমধ্যে চার তলায়।
না, আর যাওয়া যাচ্ছে না। ততক্ষনে আগুন পৌঁছে গেছে তিন তলা পর্যন্ত। আর যাওয়া যাচ্ছে না। অপশান দুটো-চার তলা থেকে লাফিয়ে নিচের টিনের চালে নতুবা আবার উপরের সিড়ি।
কিছু মানুষ বাঁচার আকুতি নিয়ে নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছে শূন্যে। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। নিচের দিকে তাকালেই তো আমার কলিজা ধড়পড় করে। আমি তো সেই লোক যে ট্রেনের নিচে পড়ার আশংকার মূহুর্তে ও বাস থেকে লাফ দিতে সাহস পাই না।
কি করব আমি।
মাথা একদম কাজ করছে না।
আবার ছুটছি উপরের দিকে।
উদ্ধারের জন্য হেলিকপ্টার আসবে নিশ্চয়ই। তারপর তো নিরাপদ।

আমি এখন বিশ তলার ছাদে। আগুন উঠছে ধীরে ধীরে।
ছাদের একপ্রান্তে এসে আগুনের খেলা দেখছি আমরা কিছু অসহায় মানুষ। আশায় আছি কখন হেলিকপ্টার আসে...।

আগুন বেড়ে উঠছে লেলিহান শিখা নিয়ে।
উপরে আমরা কিছু অসহায় মানুষ মৃত্যুর প্রহর গুনছি।
নিচে অগনিত দর্শক তাকিয়ে আছে হা করে, সাংবাদিকেরা ক্যামেরা হাতে। কেউবা মনে মনে দুয়া করছে প্রভুর কাছে।
সবাই অসহায়। জাহান্নামের যে দৃশ্যটা এতদিন মানসপটে আঁকা ছিল শুনে আর পড়ে, আজ তার স্বরূপ কিছুটা অনুভব করছি কাছ থেকেই। আজ সকালেও যে মানুষটি ছিলো কারো ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী কিংবা সন্তান। কিছুক্ষন পরেই সে পরিণত হবে একটা জীবন্ত লাশে। ফিরে আসবে বলে অপেক্ষায় ছিলো যে প্রিয়জন সে ফিরে পাবে একটা নিঃশব্দের কান্না।
আমিও যে ফিরে যেতে চাই হাসি নিয়ে প্রিয়জনের কাছে।
ফোন করি বাবাকে, "বাবা, তোমাদের সাথে হয়তো আর কথা হবে না"। ফোন দেই ভাইয়াকে, "শেষ বারের মত মোবাইলে কিছু টাকা পাঠিয়ে দাও। যতক্ষন সময় পাই সবার কাছ থেকে শেষ বিদায়টুকু নিই।"
একে একে ফোন দিচ্ছি ফরিদা, সাহিদা, সৈকত, রানু, নাসের, মুকুল আরো আরো প্রিয় ছোট ভাইবোন-দের--"যে ভাইয়াটাকে দেখেই তোদের আশংকা হত-এই বুঝি নতুন কোন জ্ঞান দিতে আসছে তার আজ বিদায় মূহুর্ত। আর হয়তো কোন দিন জ্ঞান দিতে আসবেনা ফিরে। শেষ সময়ে ক্ষমা করে দিস বিরক্তির ক্ষন গুলোকে ভুলে। ভাল থাকিস তোরা।"

অসহায় মানুষদের বেঁচে থাকার আকুতিভরা চিৎকারে আর শুনা যাচ্ছে না কিছুই। সময় ঘনিয়ে এসেছে। এখন শুধুই অপেক্ষা হারিয়ে যাওয়ার। ছাই হয়ে মিশে যাওয়ার বাতাসে, না ফেরার দেশে।

ছোট বেলায় মা'কে বলতাম, "মা, ধর আমি হারিয়ে গেলাম কিংবা কোন ছেলে-ধরা আমাকে নিয়ে গেল দূরের কোন দেশে। অনেক বছর পর ফিরে আসলে তুমি আমায় চিনবে? মা হাসতেন আর বলতেন-তোর বাম হাতের উপরের অংশে এই যে কাটা দাগটা এটা দেখে চিনে ফেলব। এছাড়া আরো কত কত দাগ মা দেখাতেন। কতগুলো তিল তোর মুখে-ঘাড়ে। তোকে চিনা তো খুবই সহজ কাজ। শুনে আমার ভাল লাগত। হারিয়ে গেলে কিংবা আহত নিহত হলে আমাকে স্বজনরা খুজে পাবে সহজেই।" কিন্তু আজ শংকা কাটছে না। আমাকে দেখে, আমার অগ্নিদগ্ধ ভূতের মত চেহারাটা দেখে কেউ কি চিনবে আমায়? খুঁজে পাবে আমার লাশ? হবে কি জানাজা? সব চিহ্ন গুলো তো আগুনের সাথে ভেসে যাবে বাতাসে।

কল্পনায় আর কিছু আসছে না। ধরেই নিতে হচ্ছে, একটু পর আমার শরীরে আগুন লাগবে। পুড়বে আমার পোশাক। হাহাকার করতে করতে নগ্ন হয়ে যাব আমি। না শুধু আমি না, সবার অবস্থা তো তাই। সুতরাং নগ্ন হওয়া নিয়ে ভাবার সময় এখন নেই। দাউ দাউ করা আগুনে পুড়ছে আমার দেহ। যে দেহটা এতদিন একটা মশা-ছারপোকার কামড় ও সহ্য করতে পারতো না। ছটপট করছি, বাঁচার আকুতি আর নেই। কষ্টটা যেন কম হয়। দুয়া করছি প্রভু যত তাড়াতাড়ি জানটা কবজ হয়, নিস্তেজ হয় দেহটা। পিপাসার্ত মন ভাবছে, কি হবে তার পর?
বৃদ্ধ বাবা আমার। লাশের জন্য এসে ফিরে যাবে শূন্য হাতে?
আমাকে না দেখে একসপ্তাহ থাকতে পারে না যে ভগ্নিপতিটি সে কি করবে? যে বোন আমার কোন দুঃখের খবরেও কাঁদে সুখের খবরেও অশ্রু ঝরায় সে হয়তো নির্বাক চেয়ে থাকবে আকাশ পানে। আমি আসবো আসবো করে যে ছোট্ট বোনটির নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ভাইয়া ভাইয়া চিৎকার করতে করতে ছুটে আসে বাড়ি থেকে অনেক দূ্র পথ,‌ জাপটে ধরে কোলে উঠে-সে হয়তো জানবেই না তার ভাইয়াটা আর কোন দিন ফিরে আসবেনা। আশাপাশের প্রিয় মানুষ গুলো যাদের আমি ভালবাসতাম অনেক অনেক বেশি, কিন্তু তারা বুঝত না। এখন হয়তো তারা ও বুকে অনুভব করবে চিন চিন ব্যথা, একটু শুন্যতা। বক বক করার কেউ একজন যেন নেই। কারো যেন থাকার কথা ছিল সকালে, সন্ধ্যায়, রাত ১১টা অবধি। কর্তা মহোদয়রা হয়তো বলবে। নিছক দূর্ঘটনা। কি আর করা। পরিবার কে দিব চার লাখ টাকা। নিয়ন্ত্রনের ফেরিওয়ালাদের কেউ কেউ হয়তো মনে মনে খুশিই হবে। যাক, কিছু মানুষ তো কমে গেল। সামষ্টিক চিন্তার মানুষ গুলোর জন্য এতো এক বিচ্ছিন্ন ঘটনাই। ২০ কোটি মানুষের দেশে এ আর কয়জন মানুষ। এ এমন কি...। ব্লগের বন্ধুরা তিন দিনের শোক, কালো পতাকা কিংবা অনলাইন মিলাদের আয়োজন করে শোকের পদ্য রচনা করবে হয়তোবা। বেঁচে যাওয়া সহকর্মীরা করবে মানব বন্ধন। সেখানে হয়তো পুলিশের সাথে হবে ধস্তাধস্তি, কেড়ে নিবে ব্যনার সরকারের পেটুয়া বাহিনী।আলোচনার ঝড় উঠবে মধ্যরাতের টকশো'তে ও। দু-চার দিনের ডিজিটাল শোক দেখিয়ে ভুলে যাবে সবাই। শুধু ভুলবে না কিছু মানুষ, সারা জীবন বয়ে বেড়াবে এই ক্ষত টুকু। বেদনাটুকু। তাদের শয়ন, স্বপন আর প্রহর গুলো কাটবে অশ্রু ঝরিয়ে। নিরবে নিভৃতে, বালিশের ভাঁজে মুখ লুকিয়ে। যাদের সোনালী স্পর্শে বেড়ে উঠেছি আমি। আমাকে নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখত অনেক অনেক। আমি ছিলাম যাদের একমাত্র অবলম্বন। তারা-আমার সে প্রিয় মানুষ গুলো। ভুলবে না আমার সে ভাই টিও যে মাস শেষে অপেক্ষায় থাকে কখন ভাইয়ার পাঠানো দুহাজার টাকা আসবে।
হয়তো খুশি হওয়াদের দলে যোগ দিবে জান্নাতের সিঁড়িতে অপেক্ষমান আমার মা।




[কয়দিন ধরেই কেমন অস্থিরতা কাজ করছে। তার উপর দেখছি আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়া সারি সারি লাশ, ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে আহত নিহত মানুষের স্তুপ, স্বজনদের গগণবিদারী আহাজারি। খুঁজে না পাওয়া অনেক বনি আদমের স্বজনরা হন্যে হয়ে ফিরছে কোথায় পাব তারে...। ১১১ আর ১৫ এর বাইরে আরো কত লাশ...। দেখতে গিয়েছিলাম চট্রগ্রামের ভেঙ্গে পড়া সেই ফ্লাইওভার। এখনো গার্ডারটি পড়ে আছে পুকুরে। সবাই ধারনা করছে গার্ডারের নিচে এখনো আছে অনেক হতভাগার লাশ। ধারণা না সত্যিই। কারণ, যেখানে সবসময় আড্ডা দিত কমপক্ষে শ'দুয়েক মানুষ। ১৫ সেখানে ডাহা মিথ্যা ছাড়া কিছু নয়। যে গার্মেন্টস এ কাজ করে তিন হাজার মানুষ। ১১৫ এর গল্প সেখানে তামাশাই বটে। কিন্তু সংখ্যা কম দেখানোর রাজনীতি যে কি বিভৎস তা দূর থেকে কিছুটা ধারণা করা গেলেও কাছে না গিয়ে অনুমান করা অসম্ভব। ১১১ আর ১৫ এর আড়ালে যারা তাদের নিয়ে ভাবার সময় আর কারোই হবে না শুধু অল্প কিছু মানুষ ছাড়া।

২০ তলা ভবনের ১৬ তলায় আমার অফিস। লিফট এ উঠি-নামি আনন্দেই। অনুভব হয় না ঠিক কত উপরে আমি। ইদানিং কাঁচের দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাই। বুকটা কেমন দুরু দুরু করে। ফায়ার এলার্ম আর ফায়ার এক্সিট এর সিঁড়িটা দেখে আসি। হা এই তো পথ। স্বান্তনা দিই নিজেকে। না, তেমন সমস্যা নেই। ডেস্কে এসে বসি। চেষ্টা করি মনোযোগ দেয়ার। তবু ধড়পড়ানি কমছে না বুকের.........।]
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:৪৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×