বছর পাঁচেক আগের কথা।মফস্বল শহর।এই শহরেই একটি দোতলা বাড়িতে ভাড়া থাকতেন শরিফুদ্দিন ভূঁইয়া।সরকারি চাকুরে।ভালোই কাটছিল সময়। বড় মেয়ে স্নিগ্ধা কোমল স্বভাবের আর ছোট মেয়ে রিপা চনচল প্রকৃতির। স্ত্রী নাজমা বেগম মিশ্র প্রকৃতির।পরিস্থিতি বুঝে সকলের সাথে ব্যাবহার করেন।চাকরি ছাড়াও সংসারে সামাল দেবার মতো অনেক কিছুই আছে যা সকল গৃহিনীর পোষায় না।আমাদের নাজমা বেগম বিচক্ষণ প্রকৃতির।সংসারের বাকি তিনজনের মনমর্জি নিয়ে তাকে চলতে হয়।শরিফুদ্দিন লোকটা ভালো তবে রগচটা।হুটহাট করে রেগে যান।এই পঞ্চাশোর্ধ লোকটিকেও কঠিন ভাবে সামলাতে হয় নাজমা বেগমকে।বড় মেয়ে স্নিগ্ধা কম কথা বলে।তাই তাকে বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে।মনের কথা মুখ ফুটে কাউকে বলেনা।আর ওর এই না বলাটাই কখনো কখনো পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে।অপরদিকে রিপাকে বোঝা অনেকটা সহজ।সব কথা অবলীলায় বলে দেয়। মা নাজমা বেগম রিপাকে নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। তার ভাবনা বড় মেয়ে স্নিগ্ধাকে নিয়ে। ওর উদাস চাউনি, মনের না বলা কথা, ভেতরের কষ্ট ফুটে ওঠে ওর হাসিতে। তাও কিছু বলতে পারেনা নাজমা বেগম। প্রকাশ করেনা কিন্তু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পান তিনি।
এই পরিবারের অনেক বর্ণনাই দেওয়া হল। ওদিকে পড়ে রইল চৌধুরী পরিবার। তাদের কথা না বললে গল্পের আসল কাহিনীটাই জানা হবে না। জামিল চৌধুরী। এই এলাকার নামীদামী লোক। সকলেই তাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করেন। তার পরিবারে তিনি, তার স্ত্রী রেবা এবং একমাত্র ছেলে শোভন। উচ্চ বংশীয়। আভিজাত্যের সাইনবোর্ড অনেকটা তাকে গুরুগম্ভীর করে তুলেছে।
জামিল চৌধুরীর একমাত্র ছেলে ভালোবাসতো স্নিগ্ধাকে। একই সাথে ওরা পড়ালেখা করতো। স্নিগ্ধা এতোটাই গুটিয়ে থাকতো যে কোনোদিন শোভনের ভালোবাসার দিকে ফিরে তাকাবার সুযোগ হয়নি। স্কুলের ক্লাস, প্রাইভেট, বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া, পড়া— এর বাইরে অন্যকোনো জগৎ তার ছিল না। হ্যাঁ, ছিল। একটি অভ্যাস ছিল যেটা না বললে পাঠকগণ আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন।
বই পড়া ছিল স্নিগ্ধার একমাত্র শখ, পাশাপাশি লেখালেখি করা। একদিন সকালে খবরের কাগজে স্নিগ্ধার একটি লেখা বেরিয়েছে। লেখাটি পড়ে শোভনের মনে হলো এ বুঝি ও নিজেই। ওকে নিয়েই হয়তো স্নিগ্ধা লিখেছে। মুখে বলে না, তাতে কি! ও সত্যি আমাকে ভালোবাসে।
বিধি বাম! তাও সত্যি নয়!
স্কুলে আসতেই শোভন ওর দিকে এগিয়ে এলো। আর ও পাশ কটিয়ে চলে গেল। হতাশ হলো শোভন। ওরা তখন এস.এস.সি. দেবে। এভাবে কেটে গেলো আরো দু’টি বছর। দু’জনেই দুটি কলেজে ভর্তি হয়েছে। যোগাযোগও নেই।
হঠাৎ একদিন বাস টার্মিনালে দেখা দু’জনের। দু’জনেই একই জায়গায় ফিরবে। কলেজ ছুটি।
শোভন আজও লালন করে স্নিগ্ধাকে। বুকের মধ্যে ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্টটা অনেক দিনের। আজও ঠিক তেমনই ভালোবাসে মেয়েটিকে। কিন্তু মেয়েটির কি কঠিন মূর্তি! শোভনকে দেখে একটু হাসলো। কথা বলার প্রয়োজনও মনে করেনি। শোভন কষ্ট পায়। ভীষণ কষ্ট।
সেদিন দুজন একই বাসে ওরা ফিরেছে। কিন্তু কারো সাথে কথা হয়নি। শোভন এই দু’বছরে ওকে অনেক খুঁজেছে। কিন্তু পায়নি। আর আজ কাছে পেয়েও হারালো।
আরো বছর চারেক পরের কথা। শোভন বাংলাবাজার যাচ্ছিল বই কিনতে। পথে স্নিগ্ধার সাথে দেখা। এই প্রথম স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে কথা বলল।
কেমন আছো শোভন?
ভালো। তুমি?
আমি ভালো আছি। কি করছো এখন?
এইতো একটা কলেজে জয়েন্ট করেছি মাত্র। তুমি?
আমিও কলেজে জয়েন্ট করেছি। বাংলা পড়াই।
শোভনের খুব ভালো লাগল। কোনোদিনও স্নিগ্ধা এত কথা বলেনি। এই প্রথমবার, এই প্রথমবার স্নিগ্ধা এতো কাছে এসে আপনজনের মতো কথা বলছে। এর কিছুক্ষণ পর দু’জনে বিদায় নিল। যাবার সময় দু’জন দু’জনার মোবাইল নম্বরও নিল। শোভন ভীষণ খুশি। আজ ও বাসায় গিয়ে স্নিগ্ধাকে ফোন দেবে। মনের অনেক কথা বলবে। না বলা কথা.. যা এতো দিন লালন করেছে…
ঘড়ির কাটায় রাত দশটা বাজে। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ভারি কন্ঠে বলে উঠল, হ্যালো কে বলছেন, প্লিজ?
শোভন হতভম্ব হয়ে গেল। এতো রাতে স্নিগ্ধার ঘরে কে এই পুরুষ মানুষটি? মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় অনেক কিছু। বুকের মধ্যে অজানা কষ্ট হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। নিজেকে সামলে আমতা আমতা করে বলল,
আমি শোভন, স্নিগ্ধার ক্লাসমেইট।
ও আচ্ছা। আমি ওর হাজবেন্ড। আমি আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনাদের সাথে তো আজ দেখা হয়েছিল তাই না? এই নিন স্নিগ্ধার সাথে কথা বলুন।
স্নিগ্ধা মোবাইলটা ধরতেই ও পাশ থেকে শোভনের মোবাইলটা আপনা আপনি বিছানায় পড়ে গেলো। কথা বের হচ্ছে না। ও পাশ থেকে কিছুক্ষণ হ্যালো-হ্যালো বলে মোবাইলটা রেখে দিল……….
এরপর আর কোন দিন দুজনার দেখা হয়নি…
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০২০ দুপুর ২:৩৪