somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাতিঘরের সংবিধান

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ ভোর ৫:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বিশাল সমুদ্রের মাঝে একটা বাতিঘর ঠিক কতটা একাকী হতে পারে? ওহ আপনারা তো আবার বলবেন বাতিঘরের আবার একাকীত্ব কী! বাতিঘর কোন জীবিত বস্তু না। তাহলে ব্যাপারটা এভাবে ভাবুন, বছরের পর বছর, বছরের পর বছর সমুদ্রের অসীম বিস্তারের মাঝে একটি বাতিঘরে জীবনযাপন করছে একজন মানুষ। এখন ভালো শোনাচ্ছে? এখন একাকীত্ব আর বিষণ্ণতার সংযোগে গঠিত অনুভূতি আড়মোড়া ভাঙছে? সমুদ্রতীরে বসে থাকা আপনারা স্যান্ডেল খুলে রেখে পায়ের পাতা ভিজাতে ভিজাতে দূর থেকে দেখা ক্ষুদ্র আলোকবিন্দুর দিকে তাকিয়ে উদাস হন। আপনারা কয়েকদিনের জন্যে সমুদ্রে আসেন, দামী হোটেলে থাকেন, হালকা মিউজিকের সাথে প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে লবস্টার খান, প্রচুর ছবি তোলেন আর কেনাকাটা করেন। ঝিনুক-শামুক-কাঁকড়া দেখে উদ্বেলিত হন। কখনও কি ভেবে দেখেছেন অনন্তকাল ধরে একজন নিঃস্বঙ্গ মানুষ বাতিঘরে কীভাবে জীবন কাটাতে পারে? হ্যাঁ আমি তেমনই একজন একাকী মানুষ। তবে আমি কারো কাছে কোন অনুযোগ করছি না আমার একাকীত্ব নিয়ে। আপনাদেরকে এখানে আসার আমন্ত্রণও জানাচ্ছি না। আমার বাতিঘরে অনন্তকাল বন্দী থাকার গল্পটা আমি নিজেকে নিজে মনে মনে শোনাতেই ভালোবাসি। শ্রোতা হিসেবে অবশ্য অন্য কাউকে কল্পনা করে নিলে সুবিধে হয়। কখনও অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা শিশু, কখনও জবুথবু বৃদ্ধ, কখনও উদ্দাম আবেগী তাগড়া শরীরের যুবক। গল্প বলেই বেশ সময় কেটে যায় আমার!

অনন্তকাল ধরে বাতিঘরে বিচরণ মানে আবার ভেবে বসবেন না সৃষ্টির শুরু থেকে অসীমের শেষ সংখ্যা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। অসীম বা অনন্ত ব্যাপারটা নিয়ে আপনাদের ভাবনাটা একদম ছিরিছাদহীন, কাটখোট্টা। বিজ্ঞানীদের কথামত অতসব সমীকরণ আর অংক কষে অসীমের সংজ্ঞা জানতে হলে তবেই গেছি! সমুদ্র জানে অসীমের সংজ্ঞা। সমুদ্রের কাছে বইপত্র নিয়ে এসে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো অসীমের পাঠ নেয়। আপনারা অবশ্য উচ্চপ্রযুক্তির মাধ্যমে সমুদ্রের গভীরতা বা বিশালটা মেপে মোটা মোটা বইয়ে রেখে দিয়েছেন। কী হাস্যকর! এর থেকে হাস্যকর কিছু আর হতে পারে না। একাকীত্ব সমুদ্রকে দিয়েছে নীল রঙ, শঙ্খের হাহাকার থেকে প্রতিধ্বনিত হয় যে আর্তনাদ তা কেউ শোনে না। সেই রঙ আর শব্দ মাপার কোন যন্ত্র বা একক নেই।

আমি মনে করতে পারি না কবে এখানে এসেছি বা কী কারণে। আমার কী কোন শৈশব ছিলো? বাবা-মা ছিলো? আমি কি কোন ভয়ংকর অপরাধ করেছিলাম, যার কারণে আজ আমাকে প্রতিনিয়ত দীর্ঘশ্বাসের সাইক্লোনের সাথে যুদ্ধ করতে হচ্ছে? এত দুঃখ কোথায় পেলে তোমরা প্রিয় মানবজাতি? সন্তান হারানোর দুঃখ, প্রেমিকা বিচ্ছেদের দুঃখ, যুদ্ধে হাত পা হারিয়ে অথর্ব হয়ে যাবার দুঃখ... সাগরের জল এত নোনা কেন বলোতো? তোমাদের অশ্রূনীতি সমুদ্রের সংবিধান। বাতিঘর থেকে অনেকদূর দেখা যায়। শুধু জল আর জল। সেই জলের ভেতর উজবুক বিজ্ঞানীরা হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের পরমাণু খুঁজে পায়। আসলে সেখানে কি থাকে জানো তো? তোমাদের দুঃখকণা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কিন্তু অদৃশ্য কণা। তোমরা তা দেখতে পাবে কী করে? সমুদ্রের ধারে তো বিচ ভলিবল খেলছো অর্ধউলঙ্গ হয়ে মহামৌজে! না, সমুদ্রের পাশে আনন্দ করতে কোন দোষ নেই, সমুদ্র আপ্যায়নে কখনও ত্রুটি করে না। শুধু জেনে রেখো, তোমাদের সমস্ত অশ্রূ, কান্না, ঘাম, কালসিটে, রক্ত, প্রহারচিহ্ন, কালোপ্রহর সব নবজাত শিশুর কাঁথার মতো গুছিয়ে রাখে সমুদ্র। তারপর ঢেউয়ের দেরাজ থেকে সযতনে বের করে ছেড়ে দেয়। দুঃখী ঢেউরা তোমাদের এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। অনাদিকাল ধরে এই প্রক্রিয়া চলে আসছে। আর তোমরা সমুদ্রকে মাপছো মিটার-ফার্লংএর নিক্তিতে। যত্তসব!

বাতিঘরের স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করে যাচ্ছি যুগের পর যুগ। আমি এসব জানি। আমার কি কখনও ফিরে যেতে ইচ্ছে করে? আমি জানি না। বাতিঘরের নিঃসঙ্গ অচন্দ্রচেতন জীবন আমাকে মোহগ্রস্থ করে রেখেছে। হঠাৎ যখন রাতের বেলা তারাগুলো সব ক্লান্ত হয়ে নিভে গিয়ে সমুদ্রকে ভীতি উদ্রেককারী কালচে বর্ণে পরিণত করে, তখন আমি দেখতে পাই শিশুদের লাশ। সিরিয়া, প্যালেস্টাইন, ইরাক, কোথায় শিশুদের লাশ নেই? সমুদ্রের বিশাল গর্জনে মায়ের বুকফাঁটা কান্না ঢাকা পড়ে যায়। আমি কান চেপে ধরি তবুও। অনন্তকালের জন্যে নিয়োগ দেয়া হয়েছে আমাকে এখানে। মহাকালের কোন এক কোণা থেকে উঠে এসে দুঃখকণা হিসেব মিলিয়ে যেতে হবে আজীবন। সমুদ্রে যখন ঝড় হয় খুব, আমি বুঝতে পারি তোমাদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে গেছে আবার। ভালো কোন খবর বাতিঘরে আসে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি রেলিং ধরে। দুঃখকণার হিসেব রাখা ছাড়াও অন্য কাজ আছে আমার। বাতিগুলোতো আছেই তীরহারা নাবিকদের দিকনির্দেশনা দেবার জন্যে। আমার খুব কাছ থেকে যখন কোন জাহাজ চলে যায়, ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলি, "নিয়ে যাও আমাকে!"। ইচ্ছেটা অবদমন করতে অবশ্য বেগ পেতে হয় না মোটেও। সাধারণ মানুষদের মাঝে আমায় বড় বেখাপ্পা দেখাবে। নিজেকে অসাধারণ বলছি না অবশ্যই, তবে অন্যদের থেকে আলাদা তো বটেই। আমি ছাড়া আর কে যেচে পড়ে বাতিঘরে বাসস্থান গড়বে!

দিনের বেলায় উজ্জ্বল সূর্যালোকে যখন ডলফিনেরা খেলা করে আমার ইচ্ছে হয় পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে ডেকে নিয়ে এসে বলি, "দেখো, পৃথিবীটা কত সুন্দর!" কিন্তু আমার বলার কেউ নেই। আমায় কেউ দেখতে পায় না। খুব চেষ্টা করলে হয়তো পেতো। কিন্তু কার এত দায় পড়েছে মাঝসমুদ্রে ভুলজোনাকের মত মিটমিটিয়ে থাকা এক গম্বুজের ভেতর বিষাদমোম দিয়ে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করা একজনকে খুঁজতে?

আমি স্মৃতিনশ্বরতায় আক্রান্ত, তবে কোনো এক পাপের কৃতকর্ম বহন করে চলতে হচ্ছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কী পাপ করেছিলাম আমি? খুন? ধর্ষণ? কারো মনে আঘাত দেয়া? কিচ্ছু মনে নেই। শুধু এটা জানি সাগরের বিশাল জলরাশির প্রতিটি ঢেউয়ের একটা করে কাহিনী আছে। আমি ইদানিং ঢেউয়ের গঠন এবং প্রকৃতি দেখে তার কাহিনী বোঝার চেষ্টা করি।

আমার চারিপাশে মনমরা ঢেউ, বিষাদী ঢেউ, জোনাকখুন ঢেউ, আকাশাকাঙ্খী ঢেউ, সিগালের ডানার স্মৃতিরুদ্ধ ঢেউ, টুনামাছের আঁশটে গন্ধা ঢেউ। ঢেউয়ের মাঝেই লুকিয়ে থাকে কেউ। আমি, তুমি, তোমরা, আপনারা, ছোট্ট বাবুটা, বয়স্ক লোকটা, সুক্রন্দসী তরুণী, বেবাক বিবাগী যুবক। আমার ঢেউটা কোথায়? কবেই হারিয়ে গেছে! সময়ের সাথে ঢেউয়ের তুলনা দিয়ে তোমরা যে প্রবচন বানিয়েছো "সময় এবং ঢেউ কারো জন্যে অপেক্ষা করে না" এটা খুব সত্যি। আমি অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু খুঁজে পাই নি। চলে গেছে সে ঢেউ মহাসাগরের মহাজাগতিক আহবানে। এসব দেখেশুনে আমার নিঃসঙ্গতা বেড়ে চলে। অযুতমরুপথ পাড়ি দেয়া তৃষ্ণার্ত মানুষের মত পিপাসা লাগে, সঙ্গপিপাসা।

মাঝেমধ্যে আমার সাঁতার কাটতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় জল কেটে কেটে পটু সামুদ্রিক প্রাণীর মত গভীরে ডুব দিয়ে আবার উঠে আসতে। কিন্তু আমি কোথাও যাই না। কোথাও যাবার নিয়ম নেই আমার। এই নিয়ম কে তৈরি করেছে জানি না, তবে আমার মনের মধ্যে তা লহরিত হয়ে গেছে। প্রায়শ্চিত্তকাল হয়তো একদিন শেষ হবে, সেইদিন আমি সমুদ্রতটে গিয়ে অন্যদের মতো লাফালাফি করবো, বিচ ভলিবল খেলবো, সস্তায় শুঁটকি মাছ কিনবো, ঝিনুকের মালা রেখে দেবো কারো জন্যে...

কেন যেন মনে হয় এমন "কারো জন্যে"ই আমার এই নির্বাসনদন্ড। ছিলো কি এমন কেউ? আমি কি তাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম? কষ্ট দিয়েছিলাম খুব? সে কী ন্যুব্জ লতার মত হেলে পড়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলো? জানার কোন উপায় নেই। সেরকম কেউ থাকলে সে ঢেউ হয়ে চলে গেছে মহাসাগরে। এই আকর্ষণ অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। সময় এবং ঢেউয়ের মত না হলেও মানুষও অপেক্ষার ক্ষেত্রে খুব পারঙ্গম ছিলো কখনও এমন শুনি নি।

বাতিঘরের রাত বড় রহস্যময়। রাতে এখানে জোছনার ফেনিল ঢেউ এসে রূপকথা হয়ে যায়। দুঃসাহসী জেলে তার ডিঙি নৌকো করে মাছ ধরতে চলে আসে মাঝসাগরের উত্তাল অংশে। কখনও কখনও দূর থেকে বিলাসবহুল জাহাজের বিত্তবান যাত্রীদের কলরব শোনা যায়, কখনও খালাসীরা মাতাল হয়ে হেঁড়ে গলায় গান ধরে। আমার বাতিঘরের মোমবাতিগুলো লেন্সে প্রতিফলিত হয়ে তাদের আলো দেখায়। সবকিছু মিলেমিশে আলোকপোকায় পরিণত হয়ে ছোট্ট একটা উড়ালদর্শন দিয়ে যায় আমার নিবাসে। কিছু জ্বলনোন্মুখ পতঙ্গ স্বেচ্ছায় নিজেদের বিলিয়ে দেয় তীব্র আলোর ঝলকানিতে। আমার বাতিঘরের আলো এমন না। মন্দ্রসপ্তক বাজিয়ে চলা আলোকপতঙ্গগুলোও এমন না। তারা আবার জলে চলে যায়। ঢেউ হয়ে যায়। ঢেউয়ের কণা হয়তো বা কোনো সার্ফারের গায়ে লাগে। হ্যাঁ, রাতের বেলা সার্ফিং করতে আসে এমন সাহসী মানুষও আছে! এসব দেখে আমার নিযুতমরুপথ পাড়ি দেয়া অভিযাত্রীর মত তৃষ্ণা জাগে। জলের তৃষ্ণা না, সঙ্গোপনে জমিয়ে রাখা সঙ্গতৃষ্ণা।

তবে আমি জানি, আমি এসব কখনও পাবো না। আমি অভিশপ্ত। মাঝসমুদ্রে আলোকপ্রদায়ী ঘরের ভেতর অন্তরীণ হয়ে থেকে সময়ের ঋণ মেটাতে হবে। কত সময় নিয়েছিলাম আমি নষ্ট করার জন্যে? খুব বেশি পরিমাণ নিঃসন্দেহে। সুদের হারও বেশ চড়া।

নির্জনতার একটা সৌন্দর্য আছে। আমার বাড়ির পাশে হকার এসে ইনিয়েবিনিয়ে পণ্য বিক্রীর বিজ্ঞাপন করে না, পাশের বাড়ি থেকে ঝগড়া, সোহাগ বা শীৎকার শুনতে হয় না। তাই বলে এমন ভয়ংকর অনন্ত নির্জনতা? মাঝেমধ্যে তা অসহনীয় হয়ে ওঠে। একেকটা দিন যায় এমন। সাগর থাকে নিস্প্রভ, দিকভ্রান্ত জাহাজের নাবিকদের দেখা মেলে না, ডলফিনরাও আসে না কসরৎ দেখাতে। তখন আমি বিলীন হয়ে যাই। তখন আমার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় এই নির্জনতার কোমল বাহু ধরে বসে থাকি। অনুনয় করি, "প্রিয় নির্জনতা, আমায় নির্জন করে দিয়ে চলে যেয়ো না"। এত বছরের, কত তার হিসেব রাখি নি, সম্ভবও না, একাকী জীবন যাপনের ক্ষেত্রে নির্জনতাই আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিলো। যেহেতু একা থাকাটাই ভবিতব্য জেনেছিলাম আমি, তাই আশেপাশের মোহনীয় চিত্রকল্পকে অনায়াসে অগ্রাহ্য করে নির্জনতার পাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থেকে ফিসফিসিয়ে বলতে চাই আমার বেদনার কথা। সমুদ্র আর সময়ের মত নির্জনতাও অসীমকে ধারণ করতে পারে। সমুদ্রের কাছ থেকে আমি প্রতিদিন বুঝে নিই প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন অশ্রুগাঁথার ঢেউয়ে রূপান্তর। নির্জনতা আমার পাশে বসে অথবা আমার চারিপাশে ঘুরঘুর করে জানিয়ে দেয় পরম একাকীত্ব অসম্ভব। যার কিছু নেই, চালচুলো, আয়-রোজগার, সন্তান-সন্তদি, তার আছে নির্জনতা। এতদিন ধরে আমি যা বুঝেছি, একাকীত্বের পরম সীমা না থাকলেও তার একটি পরিপৃক্তিক পর্যায় আছে। সেই দরজায় করা নাড়তে পারে খুব কম মানুষ। আমি কীভাবে যেন কড়া নেড়ে এই ঘরে ঢুকে পড়লাম!

ইদানিং আমার চিন্তাধারা পরিবর্তিত হয়েছে। আমি কী আসলেই কোন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি এখানে, নাকি দুঃখের বহুমাত্রিক অবগুন্ঠণে হাজারো স্বত্ত্বা জড়ো হয়েছে একসাথে? নইলে একেকদিন কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি একেকরকম উত্তর পাবো কেনো? কেনোই বা চোখের সামনে ভেসে উঠবে নানাবিধ পরস্পর সম্পর্কহীন দৃশ্যপট? না, আমি কোনো সম্মিলিত স্বত্তা হতে চাই না! আমি স্বকীয় হবো। দৃশ্য পরম্পরায় নিজেকে বেছে নিব খুব যাচাই বাছাই করে। সেদিন বুঝতে পারবো আমি স্ত্রী হন্তারক নাকি সুদখোর মহাজন, নাকি জগৎসংসারের শক্তিশালীতম সঙ, যার খেলনা হলো নাপাম বোমা আর যুদ্ধবিমান। এমনতর চিন্তায় আমি যখন উদভ্রান্ত, তখন আমার প্রিয় নির্জনতা দূরের পাহাড় থেকে পাখিদের সুর এনে দিয়ে কলমীলতার মোড়কে করে উপহার দেয়। সেই সুর শুনে অনেকদিন পর আমি নির্জনতার সৌন্দর্য বুঝতে পারি। নিজেকে বাতিঘরের "দুঃখরক্ষক" হিসেবে মেনে নিয়ে ঢেউগুলো গুনতে, চিনতে থাকি। প্রতিটা ঢেউ যেন আমাকে এসে বলে যায়, "তুমি একা! তুমি একা! তুমি একা! আমাদের সমস্ত বেদনা তোমাকে বহন করে যেতে হবে প্রতিদিন। অনন্তকাল!"

আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। একটা বিচিত্র রকম ঢেউ বারবার ফিরে ফিরে আসছিলো সন্ধ্যার পর। এরকম সাধারণত হয় না। মানুষ তার দুঃখ-কষ্ট মুছে ফেলতে খুব বেশি সময় নেয় না। মৃত্যুর মত পরম দুঃখজনক ব্যাপারও একসময় উৎসবে রূপান্তরিত হয়। ঢেউ হয়ে চলে যায় মহাসাগরের অমোঘ আকর্ষণে। কোথা থেকে আসছে এই ঢেউটা? আমি গভীরভাবে এর উৎস নিরীখে উন্মুখ হই।

ঐ যে...

ঐ যে বসে আছে একটা দম্পতি অথবা প্রেমিকযুগল। সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটা অবধি টানা বসে রয়েছে এখানে। ওদের হয়েছে টা কী!

*
-বিথী, দুরে একটা আলোকবিন্দু দেখতে পাচ্ছো?
-হ্যাঁ, কি ওটা? বাতিঘর নাকি?
-হু। আচ্ছা আমরা সমুদ্রে একটা ঘর বানাই চলো! এই বাতিঘরের মতো।
-চলো বানাই!
-চিন্তা করে দেখেছো, এই বিশাল সাগরের মাঝে ছোট্ট একটা বাতিঘর... হয়তো বা খুব ছোট না, দূর থেকে দেখছি বলে এমন লাগছে; এখানে যদি কোন মানুষ একলা থাকে দিনের পর দিন, তাহলে কেমন অনুভূতি হবে তার?
-ভাবতেই পারছি না!
-আসলেই ভাবতে পারার মতো না। পৃথিবীতে অনেকরকম অনুভূতি আছে, তার কয়টা আমরা ধরতে পারি? আমরা খুব মোটা দাগে নামকরণ করেছি, আনন্দ, বেদনা, সুখ, দুঃখ ইত্যাদি। কিন্তু এই যে আমরা কক্সবাজারে এলাম, জোছনায় সমুদ্র দেখলাম, দূরের বাতিঘর নিয়ে পরিকল্পনা করলাম, এসবকে তুমি কোন নির্দৃষ্ট অনুভূতির ছকে ফেলতে পারবে?
-আসলেই তো। ঠিক বলেছো। বাতিঘরের ব্যাপারটা আমাকেও একটা অদ্ভুৎ অনুভূতি উপহার দিচ্ছে। হুহু করে উঠছে বুকটা। সমুদ্রের ঐশ্বরিক বিশালতার মাঝে ছোট্ট একটা বাতিঘর, তাতে একজন মানুষ, দিনের পর দিন...কীভাবে থাকতে পারবে!
-উঠবা না?
-না আরো কিছুক্ষণ বসি।
-রাত বারোটা বাজে কিন্তু। সেই সন্ধ্যা থেকে বসে আছি।
-কী হয়েছে তাতে?
-তাই তো! কিছুই হয় নি। আচ্ছা ধর ঐ বাতিঘরটাতে যদি আমি চলে যাই? কীভাবে যাওয়া যায় এখান থেকে?
-বুঝেছি, তোমাকে সমুদ্রগ্রস্থতায় পেয়েছে। এমন মুহূর্তে এরকম হতেই পারে। আমি তোমাকে বাধা দেবো না। যা ইচ্ছা কর। এসময় কোন ইচ্ছায় বাধা দিতে নেই। আমি নিজেও সমুদ্রগ্রস্থ এখন। সমুদ্র যা বলবে আমরা তাই করবো।
-তোমার কি খুব আনন্দ হচ্ছে বিথী?
-আনন্দ হবে কেন?
-মানুষজন মধুচন্দ্রিমায় সমুদ্রযাপন করতে আসে তো আনন্দের জন্যেই!
-আমার সেরকম কিছু মনে হচ্ছে না। ভেতর থেকে একটা মহান বিষণ্ণতা উঠে আসছে।
-মহান বিষণ্ণতা! বেশ ভালো নাম দিয়েছো।
-হ্যাঁ, কিন্তু এই বিষাদ কষ্ট দেয় না। ভাবতে শেখায়, ভালোবাসতে শেখায়, উপলদ্ধি করতে শেখায়। আনন্দের চেয়ে বহুগুন সুন্দর এই বিষাদ।
তারা দুইজন একে অপরের হাত ধরে থাকে। মহান বিষাদের বশবর্তী হয়ে তারা দু ফোঁটা অশ্রূ বিসর্জন দেয় সমুদ্রে।

*
হু! অদ্ভুত ঢেউয়ের ব্যাপারটা বুঝলাম এবার। কিছু কিছু মানুষ থাকে এরকম ঘোরে পাওয়া। অথবা সমুদ্র তাদের মধ্যে একটা ঘোর সৃষ্টি করে।
*
-বিথী, আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছে ওই বাতিঘরটায়। এমন অসহ্য একাকীত্বের প্রতিকৃতি আমি আর দেখি নি।
-চলো যাই।
মাঝরাতে এমনিতেই সমুদ্রতট ফাঁকা থাকে। তারপরেও যে কয়েকজন ছিলো অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো দুই তরুণ-তরুণীর সমুদ্রে নেমে যাওয়া।

*
ঢেউগুলো খুব দ্রুতগতিতে আসছে এবার। আছড়ে পড়ছে বাতিঘরের গম্বুজে। ওরা কী চায়! ওরা কী সত্যি আসবে এখানে? মুক্তি দিবে আমাকে এই অসহনীয় একাকীত্ব থেকে? সঙ্গী হবে আমার?
*
বিথী এবং রেজোয়ান এক অদ্ভুত অনুভূতির জালে আঁটকা পড়ে গেছে। বাতিঘরটা তাদের মোহগ্রস্থ করে রেখেছে। কিন্তু বাস্তবতা জানে তারা। তাই আর খামোখা আবেগের তোড়ে ভেসে গিয়ে মৃতদেহে পরিণত হতে চায় না। ঢেউ এসে তাদেরকে ধাক্কা দেয়, তারা পড়ে যায়, আবারও উঠে দাঁড়ায়। সামনে এগোয় না, পেছনেও ফিরে যায় না।

*
এ কী দেখছি আমি! একটা নতুন বাতিঘর! অনেক অনেক দূরে অবশ্য। আলোকবিন্দুর মত লাগছে দেখতে। অবশেষে তারা পারলো! মহান বিষণ্ণতাকে ধারণ করা যা তা ব্যাপার না। তাদের ঢেউগুলো জমে জমে আস্ত একটা বাতিঘর হয়ে গেছে! এরকম নির্মাণ প্রচেষ্টা অবশ্য আমি আগেও দেখেছি। কিন্তু সবই ভেস্তে গেছে। ভেসে গেছে প্রবল স্রোতে। সমুদ্রের সাথে কোন চালাকি চলে না। সমুদ্র ভন্ড অথবা সাময়িক আবেগকে স্থান দেয় না। ওদেরটা সাময়িক মোহ না, খাঁটি সামুদ্রিক অনুভূতি। ওদের সাথে অবশ্য আমার দেখা হবে না কখনও। বাতিঘরনিবাসীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের নিয়ম নেই। পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ, কষ্ট এবং অমানবিকতার বিরুদ্ধে যারা দাঁড়ায়, যারা পরের এসব অনুভূতিকে নিজের মনে করে তারাই মহান সমুদ্রে বাতিঘর স্থাপন করতে পারে। বাদামবিক্রেতা ছেলেটা চড় খেয়ে কাঁদলে তারা দোষী ব্যক্তিকে দু-কথা শুনিয়ে দেয়। সিরিয়ায় বোমা হামলা হলে তাদের বুক ডুকরে ওঠে। পাশের বাড়ীর কাজের মেয়েটা গৃহকর্ত্রী কর্তৃক নিগৃহীত হলে তারা মানবাধিকার কমিশনের কাছে যায়। ওদেরটা দেখে এখন একটু একটু বুঝতে পারছি আমার এখানে আসার কারণ। প্রায়শ্চিত্তের জন্যে না, কিছু বোকামানুষী কাজকারবারই আমাকে এখানে টেনে এনেছে। সেসব আমার নিজের কাছেই থাকুক না হয়...

*
-বাবা, তুমি কাঁদছো কেন?
-মমতাজের জন্যে খারাপ লাগছে মা। খবর দেখনি? তিনি বীরাঙ্গনা ছিলেন। পাকিস্তানীরা তার ওপর এমন অত্যাচার করেছিলো যে তাকে ৫ বার অপারেশন করেও সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বিকল্পভাবে তলপেটে পায়ুনালী স্থাপন করে কৃত্রিম পাইপ দিয়ে মলত্যাগ করছেন ৪০ বছর।
মমতাজ কে আজও প্রতিদিন ২০০ টাকার ঔষুধ খেতে হয়, যা তার বৃদ্ধ ও দরিদ্র স্বামী যোগাড় করতে হিমশিম খায়।

বলেন আনোয়ার সাহেব।
-এই শোন তুমি কিন্তু এইবার আর বেতন থেকে কোন টাকা কাউকে সাহায্য করার জন্যে দিবা না। এত পরোপকারী হতে তোমাকে কে বলেছে? প্রতি মাসে হিসেবের টাকা থেকে বাড়তি কিছু যাচ্ছেই সম্পূর্ন অপরিচিত মানুষদের কাছে!

স্ত্রীর কথা শুনে তিনি বিব্রত হাসি হাসেন। আর মিথ্যে করে না বলেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বীরাঙ্গনা মমতাজের মর্মন্তুদ দূর্দশার কথাই তার আগে মনে হয়। কিছু একটা করা দরকার, কিন্তু তার বড় একা লাগে। "সে যাই হোক, ধার করে হলেও তাকে টাকা দেবোই" প্রতিজ্ঞা করেন তিনি।
-ইস রে! কারেন্ট চলে গেলো একদম সিরিয়াল শুরু হবার সময়!

*
বিথী, রেজোয়ান আর আনোয়ার সাহেব মমতাজের প্রাপ্য সম্মান এবং চিকিৎসার জন্যে প্রেসক্লাবের সামনে অনশন করছেন। বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে তামাশা দেখছে।

*
"আমি মনে হয় বুঝতে পেরেছি কেন আমি এখানে" বাতিঘরনিবাসী ভদ্রলোক নতুন দুটো বাতিঘরের দিকে সন্তুষ্টচিত্তে চেয়ে থেকে ভাবেন। যোগাযোগ, লৌকিকতা এসবের বালাই নেই অবশ্য তাদের মাঝে। নির্ঝঞ্জাট একলা জীবনই তাদের পছন্দ। মাঝেমধ্যে অবশ্য সমুদ্রের গভীর থেকে অক্টোপাস এসে তাদের পরিপার্শ্ব চেপে ধরে রেখে এখান থেকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। কখনও কখনও তারা একটু দুর্বল হলেও ঠিকই মাটিতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকেন প্রলোভন অগ্রাহ্য করে। কিছু কিছু মানুষের জন্যে বাতিঘরজীবনই শ্রেয়তর।


#বোল্ড করা অংশটুকু আম্মানসুরার মুক্তিযুদ্ধের বীভৎস হামলার শিকার মমতাজের জন্য একটু মমতা হবে কি? লেখাটি থেকে নেয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৪০
৭৪টি মন্তব্য ৭৪টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×