somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

থট ডায়েরি

১৩ ই অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৫:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাইকোথেরাপি সম্পর্কে আমার ধারণা, বলা ভালো আকাঙ্খা ছিলো এমন, বিশাল একটা রুমের মাঝে গোল সাদা টেবিল, অপরপাশে সুন্দরী কাউন্সেলর তার মায়াবী কন্ঠে হিপনোসিস করছেন, মৃদু নীল আলো পুরো ঘর জুড়ে, লো ভলিউমে বাজছে ওরিয়েন্টাল মিউজিক, মেঘফুলের সুবাসে ঘরে রহস্যময় আবহ... কিন্তু বাস্তব মোটেই এমন না। পাশাপাশি কয়েকটা ঘর। ছোট ছোট। পাশের রুমের কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা না গেলেও কথোপকথন যে চলছে তা বোঝা যায়। নীরব সঙ্গীত, অপার্থিব সুগন্ধ, গোল টেবিল কিছুই নেই। তাও ভালো, অপরপাশে যে আছেন তিনি একজন নারী। আধবুড়ী, ক্ষয়াটে দাঁতের প্রায় পুরুষ নারী না, আমার বয়েসীই হবেন। তার নামটা অবশ্য সেকেলে, বিলকিস বানু। দেখতেও আহামরি কিছু না। গড়পড়তার ভেতরেও সাধারণ। ভীড়ের মাঝে একবার এই মুখ দেখলে চিনে রাখা দায়। বিলকিস বানুর কাছে আমি এসেছি দীর্ঘদিন ধরে লালন করা প্যানিক ডিজঅর্ডার এর ব্যাপারে কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে সাহায্য পাবার জন্যে। এতদিন অনেক চিকিৎসা করা হয়েছে, ওষুধে কাজ হয় ঠিকই, কিন্তু তা আমাকে অতিমাত্রায় নির্ভরশীল করে তুলছে। আমি কোন রাসায়নিক পদার্থ না যে মেডিকেশনের কেমিক্যাল রিএ্যাকশন দিয়ে স্বাভাবিক থাকবো। আমার দরকার একজন কাউন্সেলর অথবা গার্ডিয়ান এ্যাঞ্জেল, যার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে আমি নির্ভার থাকতে পারি। ভয়ের রোমশ পাঅলা মাকড়শাগুলো যেন আমার মনের ভেতর আর জাল বুনতে না পারে, ঘিরে যেন না ধরে...

-আমার সমস্যাটার শুরু বছর দশেক আগে। ২০০১ এ। তখনও হলে উঠিনি। নতুন ভর্তি হয়েছি ভার্সিটিতে। মেস ভাড়া করে থাকি বন্ধুদের সাথে। তখন আমি সিগারেটও খেতাম না। কপাল খারাপ, আমার রুমমেট দুইজন ছিলো চরম গাঁজাখোড়। গাঁজা খেয়ে তারা নিয়মিত উল্টাপাল্টা আচরণ করতো। আমার বিরক্তও লাগতো আবার মজাও লাগতো। তবে মনে হত যে ওরা অতি অভিনয় করছে। সামান্য একটু ধোঁয়া নিলে কী এমন হবে যে চারিপাশ বদলে যাবে? বিশ্বাস হতো না গাঁজার প্রতিক্রিয়ায় ওদের করা কর্মকান্ডসমূহ। আস্ত ভাঁড় মনে হতো একেকজনকে। এতে তাদের 'গাঁজানুভূতি'তে আঘাত করায় তারা আমাকে একদিন চ্যালেঞ্জ করে বসে।
-তারিখটা কত?
-জুনের শেষদিকে হবে।
-আচ্ছা বলে যান।
বিলকিস বানু তার চশমাটা কলম দিয়ে নাকের এক প্রস্থ ওপরে উঠিয়ে বলেন।
-তো আমি তাদেরকে টেক্কা দেয়ার জন্যে একটু বেশি পরিমাণেই ধোঁয়া গিলে ফেলি। প্রথমদিকে কিছুই মনে হচ্ছিলো না। ওদের ওপর হম্বিতম্বি করছিলাম কী ফালতু জিনিস খাইয়েছে কিছুই হচ্ছে না বলে। ওরা হাসছিলো খুব। আমারও হাসি পাচ্ছিলো। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিলাম আমি। তারপর হঠাৎ বুঝতে পারলাম যে এই হাসি তো স্বাভাবিক না! আমার অনুভূতির তীব্রতা বাড়তে লাগলো। মনে হচ্ছিলো যে মস্তিষ্কে কেউ একটা শক্তিশালী এ্যামপ্লিফায়ার লাগিয়ে দিয়েছে এবং তা হাসি ও কান্নাকে বিবর্ধিত করছে বহুগুন। হাসির পর্যায় দিয়ে শুরু, তারপর আমার কান্না পেলো খুব। ঢাকায় ফেলে আসা মা-বাবার জন্যে হুহু করে কাঁদতে লাগলাম। গান বাজছিলো পাশের রুমে। মনে হচ্ছিলো যে প্রতিটা ধ্বনির নূন্যতম একক আমার ব্রেইনের ভেতর দিয়ে পরিবাহিত হচ্ছে। ড্রামের একটা বিট, বেইজের সলো, গিটারের স্ট্রিং সব যেন আমার ব্রেইনের সাথে সার্কিট করে দেয়া। এত তীব্র, প্রবল, প্রকান্ড অনুভূতি নিতে আমার মন প্রস্তুত ছিলো না। আমি বর্নালি দেখতে শুরু করলাম। রঙের পর রঙ। আছে যাচ্ছে। পুরু রঙ, পুরোহিত রঙ, পুরোনো রঙ, নতুন রঙ এতরকম রঙ থাকতে পারে তা আমার ধারনায়ও ছিলো না। তখন থেকেই আমার প্যানিক এ্যাটাকের শুরু। গলাটা শক্ত হয়ে ছিলো। মনে হচ্ছিলো কেউ বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরে রেখেছে। ঢোঁক গিলতে পারছিলাম না। শরীর শীতল হয়ে আসছিলো। বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডটা ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো ধেঁয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দরজার দিকে। ওহ! কী ভয়ংকর অনুভূতি! আমার মনে হচ্ছিলো আমি মারা যাচ্ছি। মৃত্যু কেমন তা আমি জানি না, তবে মৃত্যুভয় হয়তোবা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক। কী হতো আমি মরে গেলে? জানি না। আমি শুধু জেগে থাকলাম সারারাত অকল্পনীয় আতঙ্কের অনুভূতি ধারণ করে। ভয়ংকর কিছু একটা ঘটার আশঙ্কায়। এরপর জানালা দিয়ে ভোরের আলো দেখার পর আমি স্বাভাবিক হই।
-হু। বেশ ভালো রকম প্যানিক এ্যাটাক হয়েছিলো আপনার দেখছি। তো এরপরে কী হলো?
-তখন থেকেই প্যানিক ডিজঅর্ডার আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। ঐ ঘটনার দুইদিন পরেই আমার প্যানিক এ্যাটাক হয় আবার। আবারও মনে হয় আমি মারা যাচ্ছি। আমাকে হার্ট ইনস্টিটিউটে নেয়ার পরে ওরা ইসিজি করে কিছু না পেয়ে একটা রিলাক্সেন ইনজেকশন পুশ করলো, আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। কিন্তু ভয় আমার পিছু ছাড়লো না। হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই আমার পৃথিবী অন্যরকম হয়ে যায়। বুকের ভেতর ঝড়মাদলের শব্দ শুনতে পাই। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। গলা শক্ত হয়ে আসে। আর সবচেয়ে ভয়ংকর যেটা, তা হলো আমার চারিপাশে যা আছে সবকিছুকে ভ্রম মনে হয়। মনে হয় আমি অন্য এক জগতের বাসিন্দা। বাকিরা সবাই মিলিয়ে যাবে একটু পর। কেউ একজন দৃশ্যের পাতা ওল্টাবে, তারপর...তারপর যে কী ঘটবে সেটা আমি জানি না, কিন্তু আমার নিউরনে নিউরনে সর্পিল তরঙ্গ বয়ে যায়, একেবেকে, একে একে আসে ভয়ের উপাদানেরা।
-আচ্ছা। প্যানিক এ্যাটাক আসলে কী জানেন? এটা হলো ব্রেইনের একটা মিসইন্টারপ্রিটেশন। অপব্যাখ্যা। ঘটনা ঘটতে থাকে একরকম, কিন্তু আপনার মস্তিষ্ক তা ধরতে না পেরে ভুল সিগন্যাল দেয়। অন্যেরা যেখানে গাঁজা খেয়ে মৌজে থাকে, সেখানে আপনি হন আতঙ্কগ্রস্ত। আমার কাউন্সেলিংয়ের উদ্দেশ্য হলো, আপনার এই অহেতুক ভয় দূর করা। ভয় মানুষ পেতেই পারে, এটা মানবীয় ব্যাপার, আপনার ক্ষেত্রে ভয় থেকে অন্যান্য বস্তু ছেকে তুলে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আপনাকে বুঝতে হবে যে হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া মানেই ভয়ানক কিছু না, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলেই আপনি মারা যাচ্ছেন না।
-তো এটা কীভাবে করবো?
আমার প্রশ্ন শুনে বিলকিস বানু হাসলেন একটু।
-আজ আপাতত এখানেই থাক।

বিলকিস বানুর হাসি আমাকে অভয় দেয়। হ্যাঁ আমি তো তাই খুঁজছিলাম। এমন একজন, যার কাছে সব খুলে বলা যায়, যে আমার কথা বুঝবে, যার ওপর আমি নিজেকে পূর্ণরূপে সমর্পণ করতে পারি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে বিলকিসের প্রেমে পড়বো। সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রেমে পড়াটা খুব হাস্যকর শোনাচ্ছে, তবে আমার পরিকল্পনার সাথে খুব মিলে যায়। যদি আমি তার ওপর প্রবল আকর্ষণ অনুভব করি, তাকে দেবীসম ভাবি, তাহলেই কেবল সম্ভব নিজেকে তার প্রতি পুরোপুরি সঁপে দেয়া। আর পুরোপুরি সমর্পণ করলে তাহলেই না তার কাউন্সেলিং কাজে আসবে!

দ্বিতীয় দিন বিলকিস আমার ওপর নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালেন। বেশ কয়েকটা কাগজে প্রশ্নের জবাব দিতে হলো টিক মেরে। ফলাফল নিরীখ করে তিনি জানালেন যে আমার ভেতর বিষণ্নতা নেই, কিন্তু এ্যাংজাইটি এবং ফোবিয়া ভীষণ মাত্রায় আছে। স্যাচুরেশন লেভেল অতিক্রম করে গিয়েছে। সে আমাকে ছোটখাট প্রশ্ন করা শুরু করলো।
-আচ্ছা আপনার প্যানিক এ্যাটাক সাধারণত কোন কোন সময়ে হয়?
-নির্দৃষ্ট কোন সময় নেই। যখন তখন হতে পারে। আসলে এখন আমার সেরকমভাবে হয় না, কিন্তু "হতে পারে" এই ভাবনাটাই আমাকে আতঙ্কিত করে রাখে।
-আতঙ্কিত হলে আপনি কিভাবে পরিস্থিতির মোকাবেলা করেন?
-বিছানায় শুয়ে থাকলে বালিশ আঁকড়ে ধরি। আশেপাশে কেউ থাকলে তার কাছে গিয়ে কথা বলি। কেউ না থাকলে ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলি প্রিয় কারো সাথে।
-হু। আপনার মাসল তখন স্টিফ হয়ে যায়, প্যানিক এ্যাটাকের সময়। স্বাভাবিক আচরণ করতে থাকলে ধীরে ধীরে ওগুলো রিল্যাক্স হতে থাকে। আপনিও মুক্তি পান। আর কিছু করেন?
-আমি লেখালেখি করি। লিখতে আমার ভালো লাগে। অনেকসময় লিখতে লিখতে আমি ভুলে থাকি এই আতঙ্ক।
-বেশ ভালো। ক্রিয়েটিভ রাইটিং এসব ক্ষেত্রে খুব হেল্পফুল হয়। আমি কি আপনাকে কোন থট ডায়েরির কথা বলেছিলাম?
-না তো!
-আচ্ছা বেশ। আপনাকে এখন আমি একটা থট ডায়েরি দিবো। সেখানে আপনি আপনার সমস্যার সময়, তীব্রতা, স্থায়ীত্ব, ব্যবহারের পরিবর্তন, শারীরিক পরিবর্তন, সব লিখে রাখবেন ঠিক আছে? আমি এক সপ্তাহের রিপোর্ট দেখে ব্যবস্থা নেবো।
সে একটা কাগজে কথাগুলো উল্লেখ করে সুন্দর করে ছক কেটে আমাকে দেয়। তার হাতের লেখা বেশ সুন্দর। তারপর আবার প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতে থাকে।
-আপনি কখনও কারো সাথে মিলিত হয়েছেন?
-মানে কী!
বুঝেও না বোঝার ভান করি আমি দুষ্টুমির হাসিটা চেপে রেখে।
-মানে ফিজিকাল ইনভলভমেন্ট। সেক্স। সেক্স নিয়ে আপনার কোন সমস্যা আছে?
-নাহ। আমি এ ব্যাপারে অতি দক্ষ।

আরো কিছু কথাবার্তার পর সেদিনের সেশন শেষ হয়। সে আমাকে নিঃশ্বাসের একটা অনুশীলন আর শরীর রিলাক্স রাখার জন্যে ইয়োগা জাতীয় একটা ব্যায়াম দেয়। এগুলো পরে আমার বেশ কাজে লেগেছিলো।

-নিঃশ্বাস নিন বুক ভরে, নেবার পর পাঁচ পর্যন্ত গুনুন। তারপর নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকুন। ধীরে ধীরে। প্রতিটি প্রশ্বাসের সাথে মনে মনে বলুন আরাম... আরাম...আরাম...

থট ডায়েরিটায় খুব ফর্মালি অনুভূতিগুলোর শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে। জিনিসটা এরকম,

Date & Time

Situation/Event

Thought

Feeling (0-100%)

Physical Change

Behavior Change

প্রথমদিন আমিও খুব ফর্মালভাবেই লিখি।

Date & Time- ১৩/১০/১৩

Situation/Event- বাসের জন্যে বসে ছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে। বাস আসছিলো না। আমার সাফোকেটেড লাগতে থাকে। বুক কাঁপতে থাকে।

Thought- মনে হচ্ছিলো আমি আরেকটা জগতে চলে যাচ্ছি। যেমনটা হয় আর কী সচরাচর।

Feeling (0-100%)- তেমন ইনটেন্স না। ৫০%

Physical Change- নেই।

Behavior Change- নেই।

আমার নিত্যদিনের জীবনে এসব এখন একদম গা সওয়া হয়ে গেছে। পুরোপুরি শিথিলায়ন আমার শরীরের কপালে নেই! তবে এভাবেই গুড়িগুড়ি এগিয়ে আসে আতঙ্ক এবং মৃত্যুর ঝান্ডাধারী।
এইতো সে আসছে! গুটিগুটি পায়ে না, জোর কদমে। আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমার খুব তেষ্টা পাচ্ছে। চারিপাশের সবকিছু বদলাতে শুরু করেছে!

১৪/১০/১৩

প্যানিক এ্যাটাক!

অনেকদিন পর তার রুদ্ররূপ নিয়ে আবির্ভূত হলো সগৌরবে। তার দাপুটে আগমনের পাগলাঘন্টি বাজতে শুরু করলে পড়িমরি করে দৌড় দিতে থাকে আমার স্বজন, সম্বল, স্বপ্ন, সহ্য, স্বস্তি। আজ আমি তোমার সাথে লড়বো ডিয়ার প্যানিক এ্যাটাক! আমার কাছে ব্রহ্মাস্ত্র আছে। বিলকিসকে চেনো? বিলকিস। দেখতে অসাধারণ। একদম দেবীদের মতো। তার ঠোঁটে সবসময় পিচফলের লালরঙ আর গোলাপের সুবাস লেগে থাকে। তার কালো চোখের গভীরতায় মহাবিশ্ব তলিয়ে যেতে পারে। তার খাড়া নাক দেখে তাকে গ্রীকদেবী বলে ভ্রম হয়। তার স্তন এখনও দেখিনি আমি। ভালোবাসা এখনও একপাক্ষিক এবং প্লেটোনিক। কিসের প্লেটোনিক! আমি তার স্তন দেখবো। তার সুডৌল স্তন হাতে পুরে নিপলে কামড় দেবো। প্যানিক এ্যাটাকের সময় আমার কখনও ইরেকশন হয়নি। কিন্তু এইবার আমি উত্থিত হই। স্বমেহনের সম্মোহনে সন্ত্রাসী আতঙ্কের সর্দার পালিয়ে যায়। আমি জয়ী হই!

থট ডায়েরি লেখার এই ভঙ্গিটাই ভালো। আমি বিলকিসের দেয়া শ্রেণীকরণ কেটে দিয়ে নিজের মত করে লিখতে থাকি।

বিলকিস আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো আমার কোন যৌনসমস্যা আছে কী না। না না, নেই! এসে দেখে যাও বিলকিস, দেখে যাও আমার পৌরুষ। শক্ত করে চেপে ধরে ললিপপের মতো মুখে নাও। বিলকিস! আহ! তুমি সুন্দর! তুমি সুন্দর! তুমি সুন্দর!

হচ্ছে! সমর্পণ প্রক্রিয়া চমৎকারভাবে সম্পাদিত হচ্ছে। আমার স্বত্তাকে বিলকিসের কাছে পুরোপুরি মেলে ধরলেই নির্বাণ মিলবে। থট ডায়েরি এখন আর ওসব নিয়ম মেনে লেখা যাবে না। আমি আমার তীব্র অনুভূতির কথা লিখবো। বিলকিসের প্রতি অব্যাখ্যনীয় আকর্ষণের কথা লিখবো। যে ভয় ব্যাখ্যা করা যায় না, ঠিক তেমনই এক অবাক ভালোবাসা।

১৪, ১৫ এবং ১৬ তারিখেও প্রায় একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হয়। ভয়দল আসে, বিলকিস আসে। সবশেষে বিলকিস ওদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে, চুমু খায়। বিলকিস! অপূর্ব সুন্দরী বিলকিস!
১৭/১০/১৩

প্যানিক এ্যাটাক নেই। বিলকিসও আসছে না। কী হবে আমার? ভয় থেকে ভালোবাসার সেতু পার হচ্ছিলাম কেবল, এতে এত বিপত্তি! বিলকিসের প্রতি ভালোবাসার তীব্রতায় সব উড়ে যাচ্ছে। আসছে না কুচক্রী ভয় আর শুভানুধ্যায়ী যৌনতা। কী করব আমি? সিগারেট টানলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। গাঁজা সংশ্লিষ্ট ঐ ঘটনার পর ধোঁয়া জাতীয় যেকোন দ্রব্যই আমাকে আতঙ্কিত করে তুলতে পারে মাঝে মাঝে। তাই করবো নাকি? সিগারেট টানলে আমার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে, বুক কাঁপে, ভয় লাগে। এত রাতে সিগারেট পাবো কোথায়? বাবার ঘর থেকে একটা চুরি করে আনা যায়! আমি পা টিপে টিপে বাবার ঘরে গিয়ে পুরো এক প্যাকেট বেনসন নিয়ে আসি। বুক ভরে ধোঁয়া নিতে থাকি। ধোঁয়ার আড়াল পেয়ে উল্লসিত ভয়তন্ত্র তার সৈন্যবাহিনীকে পাঠায় সাদা সাপের ক্যামোফ্লেজে। আমার বুকে ধরাস ধরাস শব্দ হতে থাকে। চারিপাশের সবকিছু অবাস্তব মনে হয়। ভয় করে, খুব ভয়। বিলকিস, তুমি কোথায়? তুমি এসো। অনুভূতির গতিমুখ বদলে দাও! সাদা সাপটাকে মেরে ফেলো তোমার গোলাপী ব্রা খুলে পেঁচিয়ে ধরে। বিলকিস! অবশেষে আমি তোমার স্তন দেখলাম! তোমার অন্যান্য অঙ্গের মত এটাও নিখুঁত। তুমি নিখুঁততমা, তুমি মহোত্তর, তুমি দেবী, তুমি মহান ত্রাণকর্তা। তোমাকে আমি ভালোবাসবো, তোমাতে উপগত হবো, অবশেষে প্রণাম করবো। তারপর? বিসর্জন দেবো? দুর্গা দেবীকে যেমন করে ওরা ভাসিয়ে দেয়?

১৮/১০/১৩
নাহ বিলকিস, তুমি বড্ড বেড়ে গেছো। দেবীদের ধরে রাখা যায় না। তাদেরকে বিসর্জন দেয়াটাই নীতি। তুমি আমাকে এভাবে অধিগ্রহণ করতে পারো না। তোমার খোলাচুল উড়ে আমার মুখে পড়লে আমি বাজপাখির মত উড়াল দেই আকাশে, অনেক ওপর দিয়ে। তোমার ঠোঁট আমার ঠোঁটে স্পর্শ করলে ভেজা ভেজা অনুভূতিটা হাজার বৃষ্টিরাতের গানের সুর পাল্টে দেয়। তোমার চোখের দিকে তাকালে আমি দেখি শ্বাপদেরা দুর্বার গতিতে এগিয়ে আসছে আমাকে ছিন্নভিন্ন করবে বলে। তোমাকে আর সুন্দর হতে দেয়া যাবে না।

১৯/১০/১৩
পরশুদিন তোমার সাথে আমার কাউন্সেলিং সেশন। তার আগে শেষবারের মত থট ডায়েরিটায় কিছু লিখি। ওটার আর দরকার নেই আমার। তোমাকে আমি পেটাবো, ভীষণ পেটাবো। পিটিয়ে পিটিয়ে মুখ, চোখ, নাক থ্যাতলা করে দেবো। কেউ তোমাকে আর চুমু দেবে না, ভালোবাসবে না। তোমার চেহারা এতটাই বিকৃত করে দেবো যে নরকের অধিপতিও শিউরে উঠবে তোমাকে দেখে। আমার জীবন আমি নিয়ন্ত্রণ করবো। তুমি না। তাই তোমাকে সরে যেতে হবে আমার জীবন থেকে। তুমি সবকিছুতে খুব ফিটফাট, সিস্টেমেটিক। আমিও সেরকম হবার চেষ্টা করছি। তোমাকে সেই ভয়ংকর পিটুনিটা দেবো ২১ তারিখে। কাউন্সেলিং শেষ হবার পরে যখন তুমি বাসায় ফেরার জন্যে হাতিরপুলের সরু গলিটায় ঢুকে যাবে তখন। অস্ত্রপাতি ভালোই মজুদ আছে। চেইন স, জ্যাকহ্যামার, ছুরি, চাপাতি, চেহারা বিকৃত করে দেবার জন্যে এসিডও আছে। অবশ্য এসব সাথে নিয়ে আমি তোমার চেম্বারে যাবো না। কেন এমন করছি তার ব্যাখ্যাটা দিয়েছি, তারপরেও যদি মনঃপুত না হয় তাহলে শোন, প্যানিক এ্যাটাককে আমি জয় করেছি তোমার মাধ্যমে। আমার কাছে তীব্রতম ভয়ের অনুভূতি ছিলো সেটাই। এখন তুমি আমাতে গেড়ে বসেছো, তোমাকেও যদি এভাবে শেষ করে দিতে পারি তাহলে আমার জীবনে আর কোন বাধা থাকবে না। আমি হবো সমস্যামুক্ত অফুরান প্রাণশক্তির অধিকারী একজন মানুষ। দেখা হবে ২১ তারিখে। থট ডায়েরি পড়ে শেষ করার আগেই আমি চলে যাবো। সাবধানে থেকো না। ভবিতব্য মেনে নাও।

২০শে অক্টোবর আমি বেশ ফুরফুরে মেজাজে কাটালাম। বাজার করলাম। টবে পানি দিলাম। রান্নাঘরের কাজে সাহায্য করলাম। ছাদে উঠে মেয়েদের সাথে টাংকি মারলাম। বহুদিন এমন ভালো দিন কাটাই নি আমি। তবে এর চেয়েও ভালো দিন কাটবে কালকে...

-আর ইউ কমপ্লিটলি আউট অফ ইয়োর মাইন্ড? কী লিখেছেন এসব?
-ম্যাডাম, এটা হোমটাস্কের খাতা না। জটিল সাইকোলজ্যিকাল পর্যবেক্ষনের ব্যাপার। এখানে আমার মনে যা এসেছে তাই লিখেছি। সেইমত ব্যবস্থা নিন এখন।
-আমি ভাবতেও পারি নি যে কেউ এমন ভয়ংকর এবং কুৎসিত চিন্তা করতে পারে!
-এটা বললে তো হবে না! মানুষের মন নিয়ে আপনার কাজ। মনের অন্ধকার দিকগুলো আপনার চেয়ে আর কে ভালো জানে? আর আপনিই তো বলেছিলেন ক্রিয়েটিভ রাইটিং আমার ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক হবে। এখন আমার স্টিফ লাগছে। আপনি বরং নিঃশ্বাসের নতুন কোন ব্যায়াম করান।
বিলকিস মাথা ধরে থাকে। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলে মনে হয় বুকের ওঠানামা দেখে। ঘামছে খুব।
-কাম অন বিলকিস ম্যাডাম! এত ঘাবড়ে গেলে চলবে? ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের একটু ঝলক না হয় দেখালাম আপনাকে। এটা সত্যি ভেবে এমন ভয় পাচ্ছেন কেন?
বিলকিস বড় একটা শ্বাসের ঢেলা গেলে। চোখেমুখে স্পষ্টতই আতংক। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়।
-আপনার বোধ হয় প্যানিক এ্যাটাক হচ্ছে, না হলেও কাছাকাছি। রিলাক্স! নিঃশ্বাস নিন বুক ভরে, নেবার পর পাঁচ পর্যন্ত গুনুন। তারপর নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকুন। ধীরে ধীরে। প্রতিটি প্রশ্বাসের সাথে মনে মনে বলুন আরাম... আরাম...আরাম...
বিলকিস আমার কথামত কাজ করে কিছুটা ধাতস্থ হয়।
-আমাকে আপনি আক্রমন করবেন না তো?
মৃদু হেসে আমি মাথা নাড়াই। যার নেতিবাচক বা ইতিবাচক দুই অর্থই ধরে নেয়া যায়!

মেয়েটা আসলে বোকা! এতকিছুর পরেও সেই হাতিরপুলের গলি দিয়েই যাচ্ছে শর্টকার্ট মারতে! ঈদের বন্ধে ওই এলাকাটা প্রায় ফাঁকা। আমার কর্ম সম্পাদনের জন্যে সরঞ্জামাদী হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে সহযোগীরা। আমি ওদের কাছ থেকে অস্ত্র আর এসিডের ব্যাগটা নিয়ে বিলকিসের দিকে এগুই...


*
আগামীকাল আমার কাউন্সেলিং সেশনের চতুর্থ সিটিং। বিলকিস বলেছে একটা থট ডায়েরি মেইনটেন করতে। আমি একটু মাতবরি করে ক্রিয়েটিভ রাইটিং এর প্রতি তার উৎসাহকে কাজে লাগিয়ে ওপরে উল্লেখিত বস্তু দাঁড় করিয়েছি। এতদিন ধরে যা লিখলাম বিলকিস তা পড়ে কী ভাববে? ভয়ের খোলস ছুড়ে ফেলা কোন কামুক উন্মাদ সাইকোপ্যাথের গহীন গোপন ইচ্ছার কথা, নাকি শুধুই লেখালেখি প্যানিক ডিজঅর্ডারকে এড়ানোর জন্যে?

বিলকিসের কথা আমি কী করে বলবো, আমি নিজেই কি তা জানি!
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:৫৮
৭১টি মন্তব্য ৭১টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নেতানিয়াহুও গনহত্যার দায়ে ঘৃণিত নায়ক হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নিবে

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩৮

গত উইকেন্ডে খোদ ইজরাইলে হাজার হাজার ইজরাইলি জনতা নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
দেখুন, https://www.youtube.com/shorts/HlFc6IxFeRA
ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহুর এই হত্যাযজ্ঞ ইজরায়েলকে কতটা নিরাপদ করবে জনসাধারণ আজ সন্দিহান। বরং এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×